স্বপ্ন এবং কর্ম – পর্ব ২
এই দুটি পর্বের দ্বিতীয়টিতে, সদগুরু স্বপ্নের প্রকৃতি এবং কর্মের বন্ধন খোলার সাথে তার সম্পর্ককে নিরীক্ষণ করছেন।

দুটি পর্বের দ্বিতীয়টিতে, স্বপ্নের প্রকৃতি এবং কর্মের পাক খোলার সাথে তার সম্পর্ককে সদগুরু নিরীক্ষণ করছেন।
সদগুরু: কর্ম বলতে অনেককিছু বোঝায়। আমরা কর্ম নিয়ে বিভিন্নভাবে কথা বলি, মানুষের বোঝার ক্ষমতা অনুযায়ী। কর্ম অর্থাৎ কাজ। কার কাজ? “আমার কাজ।” প্রথমে এটা বোঝা দরকার, “আজ যা খুলছে, তা খুলছে কারণ এটাকে আমিই আগে জট পাকিয়েছিলাম।” পাক খোলার কাজটা একেবারেই স্বয়ংক্রিয় বলে মনে হয়। “আমার কোনও অংশগ্রহণই লাগে না। এটা নিজে থেকেই ঘটে চলেছে। আমার রাগ নিজে থেকে ঘটছে, চিন্তা নিজে থেকে ঘটছে, ভাবনা নিজে নিজেই ঘটছে।” এগুলো ঘটানোর জন্য এমনকি জড়িত হওয়া বা কোনও ইচ্ছা করারও প্রয়োজন হয় না। এগুলো এমনিই নিজে নিজে ঘটছে। দেখে মনে হয় যেন অন্য কেউ এসব করছে। কিছু সময়ের জন্য নীরবতায় থেকে, যদি নিজের মনকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করেন, দেখবেন মনে হবে যেন আপনার উপর কেউ ভর করেছে। যেন মন নিজে নিজেই কাজ করছে। কিন্তু এটা শুধু আপনার করা কাজের পাক খুলছে।
তাহলে, জীবন কি শুধুই জট পাকানো আর স্বপ্ন শুধুই জট খোলা? না। জীবন এই জট পাকান আর খোলার মিশ্রণ। আপনি যত অচেতন, তত বেশি জট খুলে যাচ্ছে। যদি আপনি আংশিক সচেতন হয়ে ওঠেন, তবে জট পড়ার কাজ অনেক বেশি ঘটবে। আর যদি আপনি সম্পূর্ণরূপে সচেতন হয়ে যান, তখন জট খুব দ্রুত গতিতে খুলবে,জট পরা একদমই বন্ধ থাকবে। আসলে,আংশিক সচেতনতা সর্বদাই জট খোলার চেয়ে জট লাগায় বেশি। উদাহরণস্বরূপ, একজন সরল চাষী সহজেই তাঁর কর্মের জট খুলে চলেছেন। তিনি কর্মের খাতায় খুব একটা কিছু জমা করছেন না। তিনি ভোরে ওঠেন, জমি চাষ করেন, খামারের পশুদের পরিচর্যা করেন, এইসব সহজ-সরল কাজ যা তাঁর সারাদিনের করণীয় সেগুলো করেন, ব্যাস। তিনি সেখানে বসে চিন্তা করছেন না, পরিকল্পনা করছেন না কীভাবে জগৎকে জয় করা যায়। তাই তাঁর জীবনে মূলত কর্মের জট খোলার কাজ চলছে। তিনি কোনও পাক লাগাচ্ছেন না এমনটাও নয়, কিন্তু সেটা পাক খোলার চেয়ে বহুগুন কম, কারণ তাঁর জীবনের প্রকৃতি খুব বেশি পাক লাগানোর সুযোগ দেয় না; বেশিটাই খোলা, কিন্তু একবার শিক্ষিত হয়ে গেলে, আপনার পাক খোলা আর পাক লাগানো অনেকটাই মিলেমিশে যায়, আপনি একইসঙ্গে পাক খোলা আর জট পাকানোয় সক্ষম হয়ে ওঠেন।
শিক্ষার ভূমিকা
একটা স্তরে, আপনার চিন্তা-ভাবনাগুলো অচেতনভাবে নিজেদের নিঃশেষ করছে। আরেকটা স্তরে, আপনার কিছু ইচ্ছা পূরণ করার আছে। এটা সর্বদাই মানুষের সাথে ঘটে চলেছে। আমি পুরো দোষটা শিক্ষার ঘাড়ে ফেলতে চাই না, কিন্তু সাধারণত, এর কারণ হল যে ধরনের শিক্ষা আপনি পেয়েছেন – সেটা আপনার মধ্যে খুব জোরালো ইচ্ছা তৈরী করে। এখনকার শিক্ষা কিছু জানার প্রক্রিয়া নয়, কিছু উপলব্ধি করার প্রক্রিয়া নয়, নিজের দেহ আর মনকে সর্বোচ্চ দক্ষতায় নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া নয়। এটা আপনার মধ্যে খুব জোরালো কিছু ইচ্ছা আর উচ্চাকাঙ্খা তৈরী করে।
শিক্ষিত মানুষেরা সীমাহীন চাহিদায় ভুগছেন। তাঁরা পেটপুরে খেয়ে শান্তিতে বসে ঘুমাতে পারেন না। না। খেতে খেতে, তাঁরা ব্যবসার আলোচনায় ব্যস্ত। সেটা এই কারণে নয় যে তাঁরা পৃথিবীর দায়িত্ব নিয়েছেন, কিছু সৃষ্টি বা নির্মাণ করার, নিজের এবং অন্যদের জীবনকে সুন্দর বানানোর। না। তাঁরা যা ছাইভস্ম করছেন সেটাই আরও বেশি করে করতে চান, কারণ কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়াই খুব জোরালো ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কর্ম সৃষ্টি করার এটি একটি শক্তিশালী যন্ত্র হল: ইচ্ছা। ইচ্ছাই কর্ম সৃষ্টি করে, কাজ নয়।
কর্মের প্রক্রিয়ায়, কাজের মাধ্যমেই জট খুলছে। জোরালো ইচ্ছার কারণে জট লাগছে। আপনি নিজেকে যত বেশী গুরুত্ব দেন, আপনার ইচ্ছাও তত জোরালো হয়ে ওঠে। ইচ্ছা বলতে আমি কোনও মহৎ ইচ্ছার কথা বলছি না – আমি বলছি জোরালো ইচ্ছার কথা। আপনি যখন রেগে যান, আপনি জট খুলতেও পারেন, আবার জট লাগাতেও পারেন। হয়ত আপনি রাগে ফেটে পড়ে আবার ঠান্ডা হয়ে গেলেন। অথবা আপনি রাগে ফেটে পড়ে একটা ইচ্ছা তৈরী করলেন: “জানেন আমি ওর সাথে কী করতে চাই?” এবার জোরদার পাক লাগতে শুরু করবে। রাগ হল একটা বিস্ফোরণ। আপনার ভিতরে কোন কিছু ঘটেছে যার জট রাগ থেকে খুলছে। রাগ ঘৃনাকে জন্ম দিতে পারে। ঘৃণা হল একটা ইচ্ছা। রাগ কোন ইচ্ছা ধারন করে ঘৃণার সৃষ্টি করে। ঈর্ষা হয়তো জট খুলতে পারে, আমরা বলতে পারি যে দ্বেষ এক ধরনের ইচ্ছা - ঈর্ষার সঙ্গে কোন ইচ্ছার মিল হয়ে এর সৃষ্টি হয়। এবার ধরুন, নিজের মধ্যে কিছুটা শীতলতার ভাব থাকলে, রেগে গেলেও, কাউকে ঘৃনা করলেও, আপনি নিজের রাগ বা ঘৃনাকে বাইরে প্রকাশ করলেন না। আপনি শীতল মুখে অনেক মাথা গরম করা কাজ করেন, তাই না? যেমন লালসা হল একধরনের জট খোলা। আবার গভীর আসক্তি একধরনের ইচ্ছা তাই এটা জট লাগায়।
তথাকথিত অভিজাত
আপনার ভিতরে যা কিছু চিন্তা-ভাবনা চলছে, তার সবটা বাইরে প্রকাশ করলে, আপনাকে প্রায় বর্বর মনে হবে। সেটাকে পালিশ করার জন্য, আপনি ইচ্ছা তৈরী করেন – সেটাই পাক লাগানো। এই তথাকথিত আভিজাত্য একপ্রকার আত্মহত্যা, এতে পাক খোলার চেয়ে অনেক দ্রুত পাক লাগতে থাকে, কারন মন দু-মুখী হয়ে যায়। একটা স্তরে, সে নিজের পাক খুলছে, আবার আরেকটা স্তরে তার নিজের কিছু ইচ্ছাও আছে। আপনি দেখবেন, তথাকথিত অভিজাত মানুষেরা – “অভিজাত” বলতে আমি বলছি সামাজিকভাবে অভিজাত মানুষদের কথা, সত্যিকারের অভিজাতদের কথা নয় –তাঁরা সবসময়েই সাধারণ মানুষদের চাইতে অনেক বেশি কষ্ট ভোগ করেন। সাধারণ মানুষদের রাগ, ঘৃণা আর পক্ষপাত খোলামেলাভাবে প্রকাশিত হয়। তাঁদের অসভ্য মনে হতে পারে, কিন্তু চালাকির দিক দিয়ে তাঁরা তথাকথিত অভিজাতদের অনেক নিচে। বেশি অভিজাত মানুষেরা, প্রথমে অন্যকে ঠকাতে শেখেন। কিছু সময় পর, তাঁরা ওস্তাদ হয়ে ওঠেন, তখন এমনকি নিজেদেরও ঠকাতে পারেন। তাঁদের ইচ্ছেগুলো এমনকি নিজের কাছেও প্রকাশ পায় না।
শিক্ষা এই ক্ষমতাকে বাড়ায় কারন সেটি আপনাকে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে পরিচয় করায়, কিন্তু মানুষের মন কীভাবে কাজ করে, কীভাবে এর বিবর্তন হয়, কী করলে এর আসল রুপ বিকশিত হয়, কী করলে এটা কুৎসিত হয়ে যায় – এইসব বিষয়গুলি একদমই গভীরভাবে দেখা হয় না। সবধরনের তথ্য সবধরনের মানুষের সামনে এমনিই সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই সাধারণত, দুৰ্ভাগ্যবঃশত মানুষ শিক্ষার সাহায্যে নিজেদের কর্মের জট আরও পাকিয়ে তুলছেন। তাঁদের চারপাশের দুনিয়ার ব্যাপারে, বা বিভিন্ন তথ্যের দিক দিয়ে তাঁরা হয়ত অনেক বেশি জানেন, কিন্তু জীবনের প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে বোঝার দিক দিয়ে শিক্ষিত মানুষেরা অশিক্ষিতদের চেয়ে অনেক অজ্ঞ। ভারতের কোনও সরল অশিক্ষিত চাষীর বাড়িতে যদি যান, তাঁর জীবনের বোধ, নিজের দেহের বোধ, শারীরিক আরামের বোধ, কার সাথে কী কাজ করবে আর কী করবে না তার বোধ, পৃথিবীর বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষেরা অশিক্ষিতদের চেয়ে অনেক অজ্ঞ। ভারতের কোনও সরল অশিক্ষিত চাষীর বাড়িতে যদি যান, তাঁর জীবনের বোধ, নিজের দেহের বোধ, শারীরিক আরামের বোধ, কারুর সাথে কী কাজ করবে আর কী করবে না তার বোধ, পৃথিবীর বেশিরভাগ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট এবং বুদ্ধিদীপ্ত। কারণ তাঁর মাথায় অত বিভ্রান্তিকর চিন্তা নেই। তাঁর মাথা অত ঢিলে নয়, যেটা শিক্ষিত মানুষদের একটা বড় অংশের সাথে ঘটেছে। এর সম্পূর্ণ দোষ শিক্ষার এমনটা নয়, আসলে এর কারণ হল কীভাবে শিক্ষাকে নিজের সত্যিকার মঙ্গলের কাজে লাগানো যায় সেসম্পর্কে কোনও সঠিক নির্দেশিকা নেই। তাই দুৰ্ভাগ্যবঃশত, শিক্ষা যার কিনা অন্তরের শক্তি আনার কথা ছিল, মনের স্বচ্ছতা আনার কথা ছিল, তা জীবনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও বিভ্রান্তি এনেছে। ছিল, তা জীবনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও বিভ্রান্তি এনেছে।
তাই জাগরণ আর স্বপ্ন – এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য না করাই ভালো। আমি চাই আপনি হয় এই দুই অবস্থাকেই স্বপ্ন হিসেবে দেখুন, অথবা দুটি অবস্থাকেই জাগরণের আলাদা স্তর হিসেবে দেখুন। এটা একধরনের স্বপ্ন, ওটা আরেকটু গভীর স্বপ্ন। বা এটা একধরনের বাস্তব, ওটা আরেকধরনের বাস্তব। এভাবে দেখলে, আপনি দুটোকেই জট লাগানোর বদলে জট খোলার প্রক্রিয়ায় পাল্টে ফেলতে পারেন।
ঈশা ব্লগের নতুন আপডেটগুলো পান।
টুইটার, ফেসবুক, আরএসএস বা ব্রাউজার এক্সটেনশন — যেটি আপনার পছন্দ, সেটি বেছে নিন।


