সাধকের যাত্রায় কর্মযোগের গুরুত্ব
সদগুরু ব্যাখ্যা করছেন কেন একজন সাধকের নির্দিষ্ট স্তরের বিকাশের জন্য কর্ম প্রয়োজন হতে পারে এবং কিভাবে আমাদের কাছে কর্মের মাধ্যমে সেবা বা শাসন করা দুইয়েরই বিকল্প রয়েছে।

প্রশ্ন: সদগুরু, আমি কীভাবে কর্ম বা কর্মযোগের ঊর্ধ্বে যাবো? ব্যক্তিগতভাবে, আমার কোনও কিছু করার কোনও তাগিদ নেই। আমার মনে হয়, আমি যেন এক কর্মহীন, নিষ্ক্রিয়তার দিকে ভেসে চলে যাই |
সদগুরু: যখন পরম সত্য কে উপলব্ধি করাই একজনের জীবনের একমাত্র লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তাঁর কাছে কর্ম অর্থহীন হয়ে যায়। একবার কর্ম অর্থহীন হয়ে গেলে, কোনও ধরনেরই আত্ম-পরিচয় আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না।কিন্তু এখন, আপনি যে অবস্থায় আছেন, তাতে কর্মের এখনো প্রয়োজন আছে। আপনি এখনও সেই পর্যায়ে পৌছননি যেখানে আপনি কর্মের সীমা অতিক্রম করতে পারবেন। আপনি কাজ ছাড়া থাকতে পারবেন না। সুতরাং, এখন আপনার কাছে যা সবচেয়ে ভালো বলে মনে হয়, সেই ধরনের কর্মই করুন এবং পরিস্থিতির প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করুন।যে ব্যক্তি কর্ম জানেন না – সত্যিকারের, তীব্র কর্ম – তিনি কখনো কর্মহীনতায় যেতে পারবেন না। যদি সেটা করার চেষ্টা করেন, তবে নিষ্ক্রিয়তা শুধু অলসতায় পরিণত হবে। যাঁদের জীবন সবসময় বিশ্রামে কাটে, তাঁদের বিশ্রামের বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু সেটা সত্য নয়। যাঁরা জ্বলন্ত আগুনকে অনুভব করেননি, তাঁরা জলের শীতলতাও অনুভব করতে পারবেন না। যে মানুষেরা সারাজীবন উদ্যমহীনভাবে, শিথিলভাবে কাটিয়েছেন, তাঁরা কখনোই অন্য পথটি জানতে পারবেন না। সুতরাং অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য তীব্র কার্যকলাপ, আপনার প্রাণশক্তিকে ফুটন্ত অবস্থায় আনতে এবং আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তারপর, এই প্রাণশক্তিকে অন্য মাত্রায় রূপান্তরিত করা খুব সহজ। এটাই কর্মের আসল উদ্দেশ্য। একজন সাধক এই কারণেই কর্মকে বেছে নেন। এমনিতেও আমাদের কাজ করতেই হবে। আমরা অ্যাডলফ হিটলারের মতো কর্ম করব নাকি মহাত্মা গান্ধীর মতো সেই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা আমাদের হাতেই রয়েছে। ব্যাপারটা এতটাই সহজ। এমনিতেও আমাদের কর্ম করতেই হবে, তাই কর্মের ধরনটা বেছে নিয়ে সেটাকে আন্তরিকভাবে করা যাক।
শাসন নাকি সেবা – আপনার পছন্দ কোনটা?
আপনি কি বিশ্বের অধিকর্তা হতে চান, নাকি এই বিশ্বের সেবা করতে চান? শেষপর্যন্ত, এটাই আসল পছন্দ। সাধারণত, সবাই বিশ্বকে শাসন করতে চান। কিন্তু যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই উদ্যমহীন, তাই শুধু নিজের পরিবারকে শাসন করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করতে পারেন না! কিন্তু তাঁদের আসল ইচ্ছা হল বিশ্ব শাসন করা। সেটা করার জন্য তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা বা তীব্রতা নেই। নয়ত, তাঁরাও সম্ভাব্য হিটলার হতেন।
শাসন করা বা সেবা করা, এই দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে হবে। যে কাজটাকে আপনি সবচেয়ে বেশি ঐশ্বরিক ও আত্ম-উপলব্ধির কাছাকাছি মনে করেন, সেটাই করুন। প্রতিটি মুহূর্তে চরম তীব্রতার সাথে সেটা করুন, এক মুহূর্তের জন্যও বিরতি না দিয়ে। তাহলে, এমন একদিন আসবে, যখন আর কর্মের প্রয়োজন থাকবে না। যদি আপনি সত্যিই এই “নিষ্ক্রিয়তা” ব্যাপারটা জানতে চান, তাহলে কর্ম করা কী সেটা আগে আবিষ্কার করতে হবে। আপনি তো সেটাই এখনও করেননি। প্রত্যেক জাগরণের মুহূর্তে, আর এমনকি ঘুমের মধ্যেও, শারীরিকভাবে আর মানসিকভাবে অনবরত আমি নিজেকে উৎসর্গ করার কাজটা করে চলেছি। শুধুমাত্র সেটার জন্যই, আমার জীবনে এত কিছু ঘটেছে। এটা আমার কাছে বিশেষ কিছু না হলেও আমি এটা নিয়ে দিনের চব্বিশ ঘন্টাই পড়ে থাকি তাই এটা এত প্রবল হয়ে উঠেছে। এর একটি ভিন্ন ধরনের শক্তি আছে। এটাই ত্যাগের আসল অর্থ। শুধু এই ত্যাগ থেকেই ভেতরে এবং বাইরে এমন কিছু ঘটে যা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
এইভাবেই পৃথিবীর প্রতিটি শক্তিশালী ব্যক্তি তৈরী হন। এটাই হল সত্যিকারের শক্তিশালী সত্ত্বা সৃষ্টি করার বিজ্ঞান। এটা শাসন করার শক্তি নয়। এই শক্তি এমন নয় যে যেকোনো মুহূর্তে তা কেড়ে নেওয়া যায়। কেউ এটা কেড়ে নিতে পারেনা, কারণ যে পরিস্থিতিতেই আপনাকে রাখা হোক না কেন, আপনি সেই একই কাজ করবেন। শাসন করতে চাইলে, সিংহাসনে বসতে হবে। যদি কেউ আপনাকে সেই আসন থেকে টেনে নামিয়ে দেয়, আপনি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু এই শক্তি তেমন নয়। যেখানেই আপনাকে রাখা হোক – স্বর্গ বা নরক – আপনি শুধু আপনার কাজ করে যাবেন। এটা কর্মফল থেকে আপনাকে মুক্তি দেবে। আর একবার কর্মফল থেকে মুক্তি পেয়ে গেলে, কর্মটা আপনা-আপনিই ঘটবে। কর্ম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কাজ করা থামানোর আর প্রয়োজন পড়বে না। সেটা নিজে থেকেই বিলীন হয়ে, অদৃশ্য হয়ে যাবে। একবার আপনার জীবন থেকে কর্মফলের আশা সম্পূর্ণভাবে চলে গেলে, কর্ম নিজে থেকেই ঘটবে। আপনাকে তার জন্য কিছু করতে হবে না।
“কাজ করুন তারপর পেট ভরুন”
একটি জেন মঠে, এক বৃদ্ধ গুরু ছিলেন। তাঁর বয়েস আশির ও বেশি হবে। প্রত্যেক দিন, তিনি বাগানে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতেন। জেন মঠগুলিতে বাগানের পরিচর্যা করা সাধনার অন্যতম একটা অংশ। প্রত্যেক দিন, লোকেরা অনেকটা সময় বাগান পরিচর্যায় কাটান। বছরের পর বছর ধরে এই গুরু সেই একই কাজ করে চলেছিলেন। এখন তাঁর বয়েস আশির বেশি। বয়েসের সাথে তিনি দুর্বল হয়েছেন, কিন্তু তবুও থামেননি। সারাটা দিন, তিনি বাগানে কাজ করতেন। অনেকবার তাঁর শিষ্যরা তাঁকে থামানোর চেষ্টা করেছে, “আর কাজ করতে হবে না, আমরা সবাই আছি, আমরা করে নেবো” । কিন্তু তিনি থাকতেন না, যতটা পারতেন, ততটাই করতেন। তাঁর শারীরিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা হয়ত কমে গিয়েছিল, কিন্তু তীব্রতা কিছুমাত্র কমেনি।
তো একদিন তাঁর শিষ্যরা তাঁর যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়ে রাখলো, কারন তিনি শুধু সেই যন্ত্রপাতি দিয়েই কাজ করতেন। সেদিন, তিনি খেলেন না। পরের দিন, আবার তিনি দেখেন কোনো যন্ত্রপাতি নেই, তাই সেদিনও তিনি খেলেন না। তৃতীয় দিনও, দেখলেন কোনো যন্ত্রপাতি নেই; তিনি আবারও না খেয়েই রইলেন। তখন শিষ্যরা সবাই ভয় পেয়ে গেল, “ওহ! আমরা যন্ত্রপাতি লুকিয়ে রেখেছি বলে উনি রেগে গেছেন। উনি খাচ্ছেন না।”তাই তারা আবার য্ন্ত্রপাতিগুলোকে যথাস্থানে রেখে দিল। চতুর্থ দিনে তিনি কাজ করলেন আর খাবারও খেলেন। তারপর সন্ধ্যাবেলায়, তিনি শিক্ষা দিলেন, “কাজ করো, তারপর পেট ভরো।” তারপর তিনি ফিরে গিয়ে মারা গেলেন। সেটাই তাঁর শেষ দিন ছিল। চারদিন উপোস করাটা তাঁর পক্ষে বেশি হয়ে গেছিল; কিন্তু শেষ দিনে তিনি কাজ করলেন, খেলেন, তারপর দেহ রাখলেন, আর সহজ শিক্ষা দিয়ে গেলেন, “কাজ করো, তারপর পেট ভরো।” এইধরনের মানুষের জন্য, কর্ম এইরকমই। নরক, স্বর্গ, পৃথিবী, যেখানেই তাঁকে রাখা হোক না কেন, তিনি ঐরকমই থাকবেন। একবার আপনি এরকম হয়ে গেলে, আপনি বাহ্যিক পরিস্থিতির থেকে মুক্ত।
শুধুমাত্র চোখ বন্ধ করে, আপনি মুক্ত হবেন না। যে মুহূর্তে চোখ খুলবেন, সবকিছু আবার ফিরে আসবে আর আপনাকে আবার ঘিরে ফেলবে। যদি পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ে বসে থাকেন, তাও মুক্ত হবেন না। কর্মকে নিঃশেষ করে ফেলতে হবে। এটাই হল এর থেকে মুক্তির উপায়।
সম্পাদকের নোট: মিস্টিকস মিউজিংস গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। দুর্বল হৃদয়ের জন্য নয়। এই বইটি নির্ভয়ে আমাদের ভয়, রাগ, আশা এবং সংগ্রামকে ছাপিয়ে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার পথ দেখায়। সদগুরু আমাদের যুক্তির শেষ প্রান্তে নিয়ে যান এবং জীবন, মৃত্যু, পুনর্জন্ম, কষ্ট, কর্ম এবং আত্মার যাত্রা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করেন।নমুনা পিডিএফ ডাউনলোড করুন বা ই-বুকটি ক্রয় করুন।


