দুটি পর্বের প্রথমটিতে, সদগুরু স্বপ্নের প্রকৃতি, এবং কীভাবে কর্মের জট খোলার সাথে এটা জড়িত তা ব্যাখ্যা করেছেন।

সদগুরু: যখন একজন মানুষ স্বপ্ন দেখেন, আমরা তাকে বলি কল্পনা। যখন একদল মানুষ স্বপ্ন দেখেন, সেটা হয়ে ওঠে সমাজ। যখন সমগ্র সৃষ্টি স্বপ্ন দেখে, সেটাকে সাধারণত বাস্তব বলে মেনে নিই। স্বপ্ন একধরনের বাস্তবতা, আর বাস্তবতাও একধরনের স্বপ্ন। স্বপ্নের সবচেয়ে ভালো দিক হল, জেগে উঠলেই, সেটা শেষ হয়ে যায়। তথাকথিত বাস্তবও সেরকমই – আপনি জেগে উঠলে, সেটা শেষ হয়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, যদি ঘুমন্ত অবস্থায় আপনার দেহের স্থিতি মাপা হয়, সেটা জাগ্রত অবস্থায় থেকে সামান্য নিচের স্তরে থাকবে – ধ্যানের অবস্থার মতনই। তো, ঘুম হল জাগরণেরই আরেকটু শিথিল অবস্থা, বা জাগরণ হল ঘুমের আরও উত্তেজিত অবস্থা।

এটা কি এক ধরনের কথার খেলা, এক ধরনের বিনোদন যে আমরা ভাবতে পারি, “আচ্ছা, স্বপ্ন আর জাগ্রত অবস্থা একই, বাস্তব আর স্বপ্ন একই?” তা নয়। আপনার ইন্দ্রিয়গুলো যেভাবে আপনাকে ব্যাখ্যা করে দেয়, আপনি বাস্তবকে শুধু সেভাবেই জানেন। বাস্তব আসলে যেমন, আপনি সেভাবে জানেন না। তো আপনি যাকে “বাস্তব” বলছেন, সেটাও আপনার মনের একটা ব্যাখ্যা, যাকে “স্বপ্ন” বলছেন, সেটাও আপনার মনের একটা ব্যাখ্যা। আপনার মনে যা ঘটছে, সেটা আরেক ধরনের বাস্তব। আমরা সেটাকে বলতে পারি “মনস্তাত্বিক বাস্তব”. বেশিরভাগ মানুষের জন্য, তাঁদের চিন্তা-প্রক্রিয়ার চেয়ে তাঁদের স্বপ্ন অনেক বেশি শক্তিশালী। দুৰ্ভাগ্যবশতঃ তাঁরা বেশিরভাগটাই মনে রাখতে পারেন না।

কর্মের জট ছাড়ানো

জীবনে আগে যা ঘটে গেছে তারই পাক খোলার প্রক্রিয়া হিসেবে জীবনকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমরা যখন বলি, “আপনার জীবন এখন যেমন, তার কারণ আপনার কর্ম”, তার মানে শুধু এটাই, অতীতে যা ঘটেছে তার পাক খোলার প্রক্রিয়াই হলো আপনার জীবন। কিন্তু জীবনের পরিস্থিতি আপনার ভেতরের কর্মের সঙ্গে ভালভাবে খাপ নাও খেতে পারে। যদি আপনি চোখ খুলে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করেন, আর সেটাকে সত্যি বানানোর জন্য জগতের সহযোগিতা চান, জীবন হতাশাপূর্ণ হয়ে উঠবে, কারন জগৎ আপনার স্বপ্নের সাথে সহযোগিতা করবে না। তাদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে। স্বপ্নের মধ্যে, আপনার কর্মের পাক খোলার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। কর্মের এই অচেতন পাক খোলাকে অতিক্রম করে আপনার জীবন যদি একটা সচেতন প্রক্রিয়া হয়ে উঠতে পারে, শুধুমাত্র তখনই জাগ্রত অবস্থা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হবে। অতীতে যা ঘটেছে তার পাক খোলার মধ্যেই যদি জীবন সীমাবদ্ধ থাকে, তবে অবশ্যই স্বপ্নের মধ্যে সেটা করা অনেক ভালো।

স্বপ্নে কী কর্ম জমা করা সম্ভব? আপনি যা কাজ করছেন তার কারণে কর্ম জমা হচ্ছে না। কাজের পিছনে ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যের কারণে এটা হয়।

যোগীক সংস্কৃতিতে, শিব, অর্থাৎ মহাদেবকে বর্ণনা করা হয়েছে পরম নিদ্রা, নয়তো পরিপূর্ণ জাগ্রত অবস্থার প্রতীক হিসেবে। সম্পূর্ণ সচেতন সত্ত্বার এই দুটোই অবস্থা: হয় তিনি অস্তিত্বহীন, নয়ত তিনি জাগ্রত। তাঁর জন্য এর মাঝামাঝি কোনও বাস্তবতা নেই কারণ পাক খোলার মতো কিছু না থাকলে শুধুমাত্র স্থিরতা এবং জাগরণ থাকবে। কোনও স্বপ্নের অবস্থা থাকবে না। “স্বপ্ন” বলতে শুধুমাত্র আমি ঘুমন্ত অবস্থার কথা বলছি না, যখন আপনার চোখ খোলা থাকে, তখনও আপনি স্বপ্নের অবস্থায় আছেন। এই মুহূর্তে, আপনি যেভাবে সৃষ্টিকে অনুভব করছেন, তা আসলে একেবারেই স্বপ্নময়। জগৎ যেমন আছে, আপনি তা সেভাবে দেখছেন না।

স্বপ্নের ক্ষমতা এবং স্বপ্নের দুর্বলতা একইসাথে উপস্থিত। যিনি স্বপ্নে হারিয়ে আছেন, তাঁর জন্য এটা খুব শক্তিশালী। যিনি একটু দূরত্ব থেকে এটাকে দেখছেন, তাঁর জন্য এটা খুবই তুচ্ছ। স্বপ্নের সাথে আপনি কী ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তার উপর এটা নির্ভর করছে।

তো স্বপ্নের মধ্যে কি কর্ম জমা করা সম্ভব? আপনি যা কাজ করছেন তার জন্য কর্ম জমা হচ্ছে না। কাজের পিছনে ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যের কারনে এটা হয়। স্বপ্নে কি কোনও ইচ্ছা করা সম্ভব? আপনি কি ঠিক করতে পারেন, “আজ আমি এই ধরনের স্বপ্ন দেখবো?”

 না। স্বপ্নে কোনও ইচ্ছা করা সম্ভব না। তাই স্বপ্ন খালি পাক খোলার প্রক্রিয়া। এমনকি দিনের বেলায়ও বেশিরভাগ সময়ে আপনি অতীতের কর্মেরই জট ছাড়াচ্ছেন। আপনার রাগ, আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, হতাশা, ভালোবাসা, আসক্তি, ঘৃণা, এগুলোর বেশিরভাগই শুধু কর্মের প্যাঁচ খোলা, আপনার ইচ্ছায় নয়। একমাত্র যখন এগুলো থামানোর চেষ্টা করবেন তখনই এটা বুঝতে পারবেন। ধরা যাক, গতকাল আপনি কারুর উপর ভীষণ রেগে গেছিলেন, তাই আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছেন, “আমি এই ব্যক্তির উপর রাগ করতে চাই না।” কিন্তু যখন দেখা হবে, দেখতে পাবেন আপনি আবার তাঁর উপর রাগ করছেন। স্পষ্টতই সেটা আপনার ইচ্ছায় ঘটছে না। বেশিরভাগ সময়ে, আপনি অতীতে যা ঘটেছে তার উল্টোটা করছেন। একমাত্র যখন নিজেকে রূপান্তর করার চেষ্টা করবেন, তখনই এটা বুঝতে পারবেন। কর্মের প্রক্রিয়ার পাক খোলার ঘটনাটা এতটাই আসল মনে হয়, ভ্রম হয় যেন আপনি নিজেই এটা ঘটাচ্ছেন। “কর্ম” বলতে আমরা বলছি, এটা আপনিই ঘটাচ্ছেন। যদি কেউ বিশ্বাস করেন, তিনি যা করছেন, সবটাই নিজের ইচ্ছায়, এই ধারণাই আসলে অজ্ঞতার প্রাথমিক স্তর।

নিজস্ব স্বার্থ হারানো

একটি মন্ত্র আছে- “সবই তুমি, মহাদেব, সবই তুমি। আমার পাপ আমার মনের কাজ, আমার কর্ম আমার দেহের কাজ—তাহলে আমি কোথায়? আমি অস্তিত্বহীন। সবই তোমার।” যদি কোনও সত্যিকারের ভক্ত এই কথা বলেন, সেটা একটা চমৎকার উপলব্ধির অবস্থা। যদি মন একথা বলে, সেটা একটা কুৎসিত ছলনা। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই যখনই ঘটনা তাঁদের মনঃপূত হয় না, সঙ্গে সঙ্গে অন্য কিছুর উপর বা অন্য কারুর উপর দোষ চাপাতে শিখে গেছেন। যদি আপনার যা কিছু পছন্দ আর অপছন্দ, নিজের ব্যর্থতা আর নিজের সাফল্য সবটাই যদি অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারেন তবে সেটা ঠিক আছে। যদি আপনার মঙ্গল আর অমঙ্গল দুটোই কাউকে দিয়ে দিতে পারেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যদি শুধু অমঙ্গলটুকু দিতে চান, মঙ্গলটুকু নয় – সেটা আরেকজনের সাথে খুবই খারাপ একটা চুক্তি করা হবে। একমাত্র একজন গন্ডমূর্খ ছাড়া কেউই এই চুক্তিতে রাজি হবেন না।

যতই মূর্খ মানুষ হোক না কেন, নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে ভীষণ বুদ্ধিমান। মানুষ যত বেশি বুদ্ধিমান হয়, ততই সে নিজের স্বার্থ নিয়ে কম চিন্তিত থাকে। মানুষ যত অল্পবুদ্ধি, ততই সে নিজের স্বার্থ নিয়ে চতুর হয়ে ওঠে। এটা কখনও লক্ষ্য করেছেন? এই সীমিত “নিজস্ব স্বার্থে” আবদ্ধ থাকা আসলে একেবারেই বোকামি। এটি শুধু একটি ব্যক্তির জন্য নয়, পুরো মানবজাতির জন্যও এক বড় ক্ষতি। যখন মানুষ সমগ্র মহাবিশ্বের মহিমায় অংশ নিতে পারত, তখন সে আটকে থাকে নিজের ছোট্ট অস্তিত্বে—যা আসলে তেমন মূল্যবান কিছু নয়। যখন বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি পায় আর বিভিন্ন বৈচিত্রময় জিনিসকে দেখতে শুরু করে, তখন মানুষ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে এতটা ব্যস্ত থাকে না। যদি কারুর প্রজ্ঞা সত্যিই ফুটে ওঠে, তাঁর আর কোনও স্বার্থই নেই।

ঈশা ব্লগ থেকে সর্বশেষ আপডেট পান। টুইটার, ফেসবুক, আরএসএস বা ব্রাউজার এক্সটেনশন—আপনার পছন্দমতো মাধ্যম বেছে নিন।