ভারতীয় সংস্কৃতিতে, কোনও বসে থাকা বা শুয়ে থাকা ব্যক্তির উপর দিয়ে যেতে বারণ করা হয়। এটা কি শুধুমাত্র একটা প্রথা, নাকি এর পিছনে কোনও বিজ্ঞান আছে? সদগুরু এর উত্তর দিচ্ছেন।

সদ্গুরু: আসলে এটা শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয়, এটা সমস্ত প্রাণীদের জন্যই। ভারতে, মানুষজন সাধারণত ঘুমন্ত কুকুরকেও ডিঙিয়ে  যান না।

যদি আপনার জীবনের অনুভব শুধুমাত্র ভৌতিক মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে আপনি ভাববেন মানুষের সীমানা তার ত্বক অবধিই। যদি নিজের জীবনের অনুভবকে আরো একটু বাড়িয়ে তোলেন, দেখতে পাবেন মানুষের সীমানা তার ত্বকের বাইরেও বিস্তৃত – কতটা বিস্তৃত সেটা নির্ভর করছে ব্যক্তিটি কেমন তার উপর। যতবেশি সময় চোখ বন্ধ করে বসবেন, তত “বেশি মোটা” হয়ে যাবেন – কোনও বস্তু হিসেবে মোটা নয় – আপনি স্বয়ং বড় হয়ে উঠবেন। যত কম চিন্তা করবেন, আপনার উপস্থিতি তত বড় হয়ে উঠবে।

যত বেশি সময় চোখ বন্ধ করে বসবেন, তত “বেশি মোটা” হবেন – কোনও বস্তু হিসেবে মোটা নয় – আপনি স্বয়ং বড় হয়ে উঠবেন।

বেশিরভাগ মানুষ একমাত্র ঘুমের সময়েই নিজের ভিতরে কিছুটা শান্তি আর ভারসাম্য অনুভব করেন। ঘুমই তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে গভীর অবস্থা। এভাবে বেঁচে থাকা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। গভীর ঘুমে থাকলে তাঁরা কিছুটা শান্তিপূর্ণ আর ভারসাম্যপূর্ণ থাকেন। জেগে থাকা অবস্থায়, তাঁদের ছিন্নভিন্ন দশা।

তাই যখন কেউ শুয়ে থাকে, তখন তাঁরা আসলে কিছুটা “বড়” হয়ে যায়। বিশেষ করে যদি শক্ত মেঝে বা শক্ত কোনো কিছুর উপর শুয়ে থাকে, তখন যে দিকটায় শরীর লেগে থাকে সেই পাশে শক্তির বিস্তার হওয়ার জায়গা থাকে না। স্বাভাবিকভাবেই শক্তি ওপরে ছড়িয়ে যায় যেখানে ফাঁকা জায়গা আছে। ফলে শক্তি চারদিকে না থেকে শরীরের উপরে প্রায় 50% থেকে 100% পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে থাকে।

দীর্ঘায়িত শক্তি-শরীর

ধরুন অনুমান করে নেয়া যাক, আপনার শক্তি-শরীর আপনার দেহ ছাড়িয়ে এক ফুট অবধি বিস্তৃত। শুয়ে থাকা অবস্থায় এর বিস্তার দেড় থেকে দুই ফুটের কাছাকাছি যেতে পারে। আপনার অজান্তেই শক্তি-শরীরের কিছুটা পরিষ্কার এবং বৃদ্ধি স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে চলেছে। এই সময়গুলোতে মানুষজন আপনার থেকে একটু বেশি দূরত্বে থাকেন – সেটা শুধু শ্রদ্ধার খাতিরে নয়, শুধুমাত্র সেই মুহূর্তে আপনার শক্তি-শরীরের বিস্তারের কারনে। এটা এরকমই হওয়া উচিত – সেই মুহূর্তে এটাই দরকার। প্রয়োজনীয় সংবেদনশীলতা থাকলেই, আপনি স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়গুলো বুঝতে পারবেন। বলতে পারেন, এটা একটা বিশেষ জন্মগত গুন, আমি সেটা অস্বীকার করব না। কিন্তু একইসঙ্গে, মানুষের কাছে এই ধরনের বিশেষ সংবেদনশীলতা নেই তার একটা বড় কারন হল, তাঁরা কোনকিছুতে মন দিতে পারেন না। আর কোনকিছুতে মন দিতে না পারার কারন হল, তাঁরা নিজের চারপাশের জীবন সম্পর্কে উদাসীন।

yআপনার শক্তি-শরীর আপনার দেহ ছাড়িয়ে এক ফুট অবধি বিস্তৃত। শুয়ে থাকা অবস্থায়, এটা আন্দাজমত দেড় থেকে দু-ফুট অবধি যেতে পারে।

ছোটবেলায় পাঁচ-ছয় বছর বয়সে আমি বাড়িতে বসে কোনওকিছুর দিকে কিংবা অনেকসময় কোনও বস্তু ছাড়াই তাকিয়ে থাকতাম। অনেক পরে আমি জানতে পারি, যোগে একটা মুদ্রা আছে যেখানে আপনি এমনিই তাকিয়ে থাকেন, কোনো বস্তু ছাড়াই। কোনও উঁচু বা নিচু নেই। কোনও কিছু থাকা বা কিছুই না থাকা, দুইই আপনার কাছে সমান – আপনি শুধুই তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ, আমার মা সামনে দিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম আমি তাঁকে দেখতে পেতাম, কিন্তু পরেরবার যখন যেতেন, তিনি পুরো ঝাপসা আর একটু বড় হয়ে দেখা দিতেন। আবার যখন যেতেন, তিনি প্রায় স্বচ্ছ এবং আরও বড়।

তারপর আমার বাবা আসতেন। আমি তাঁর দিকে খালি দৃষ্টিতে তাকাতাম। তিনি আমার চোখের সামনে অঙ্গভঙ্গি করতেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি বলতেন, “পড়াশোনা করছিস না কেন?” বা ঐরকম কিছু। আমি শব্দগুলো শুনতাম না আমি খালি তাকিয়ে থাকতাম, আর সবধরনের জিনিস দেখতে পেতাম। যেধরনের আকৃতি দেখতে পেতাম, তার উপর নির্ভর করে আমি বুঝে যেতাম উনি কী বলতে চাইছেন। উনি দুশ্চিন্তায় ভুগতেন, যেভাবে এই ছেলেটা তাকিয়ে আছে, ওনার মনে হত আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যদি আপনি যথেষ্ট মনোযোগ দেন, আপনি নিজেও এটা অনুভব করতে পারবেন।

আপনার চারিপাশে কি ঘুরে বেড়াচ্ছে?

যৌগিক দেহতত্বে, আপনার অস্তিত্বের তিনটি ভৌতিক মাত্রা আছে – ভৌতিক শরীর, মানসিক শরীর আর শক্তি-শরীর – অন্নময় কোষ, মনোময় কোষ আর প্রাণময় কোষ। আমরা খাদ্য হিসাবে এই পৃথিবী থেকে যা ভৌতিক উপাদান নিই, তা দিয়ে ভৌতিক শরীর তৈরী। মানসিক শরীরও আপনি চারপাশের পৃথিবী থেকে যা উপাদান নিচ্ছেন, তা দিয়ে তৈরী, কিন্তু এই উপাদানগুলি আরও সূক্ষ। তথ্য, স্পন্দন, ধ্বনি আর বিভিন্ন প্রভাব দিয়ে আমরা মানসিক শরীর বানাই।

সচেতন মানুষেরা অন্য কারুর কর্মে হোঁচট খেতে বা পা দিতে চান না। কারুর উপর দিয়ে যাওয়া মানে আসলে, আপনি একরকম তাঁদের কর্মে ঢুকে পড়ছেন।

ভৌতিক শরীর যেহেতু ভৌতিক উপাদান দিয়ে তৈরী, সেটা কিছুটা যথাযথ রূপ নিতে পারে। বেশিরভাগ মানুষের মানসিক শরীরের কোনও সুস্পষ্ট রূপ নেই। তাঁরা যা জোগাড় করেছেন সেসম্পর্কে নিজেরাই সচেতন নন। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে, মনের বিষয়বস্তুর 1% ও সচেতন নয়। 99% অচেতনভাবে জোগাড় করা, তাই মানসিক গঠনটা বেশ বিক্ষিপ্ত। গোটা ব্যাপারটাই জগাখিচুড়ি। যদি আপনি নিজের মানসিক আকৃতিকে সচেতনভাবে একটা গঠন দিতে পারেন, এবং পরিস্থিতির প্রয়োজন অনুযায়ী গঠনটা বদলাতে পারেন, তবে আপনার মন একটি জাদুকরী যন্ত্র হয়ে উঠবে।

আপনার শক্তি-শরীরও অনেক তথ্য বহন করে। আপনার ভিতরে কী ধরনের তথ্য আছে সেটার উপর নির্ভর করে এটা কী রূপ নেবে। ভৌতিক শরীরের স্তরে তথ্যকে বলা হয় জীনতত্ব। একইভাবে, মানসিক কাঠামোতে তথ্য আছে, শক্তি-কাঠামোতেও তথ্য আছে।

যে মানুষরা সচেতন, তাঁরা আপনার মানসিক শরীর বা শক্তি-শরীরের উপর হোঁচট খেতে চাননা। আমরা জানিনা কোনও ব্যক্তি কী ধরনের কর্ম বহন করছেন, কিন্তু তাঁরা যখন ঘুমোচ্ছেন, বা ঘুমোতে যাচ্ছেন, তখন অচেতন কর্মের কার্যকলাপ চরমে থাকে। তখন যেহেতু সচেতন কাজ বন্ধ থাকে, তাই অচেতন কাজ চরমে চলতে থাকে। যে মানুষরা সচেতন, তাঁরা অন্য কারুর কর্মে হোঁচট খেতে বা ঢুকে পড়তে চান না। কারুর উপর পা দেয়া মানে আসলে, আপনি একরকম তাঁদের কর্মে ঢুকে পড়ছেন ।

নিজের “জিনিসপত্র” সামলানো

নিজের জিনিসপত্র সামলানোই যথেষ্ট কঠিন, তাই তাই অন্য কারুর জিনিসপত্র তুলে নেয়া আসলেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এইকারনেই একবার আধ্যাত্মিক সাধনার পথে এলে, ব্রহ্মচারী হিসেবে, কাউকে আলিঙ্গন করা হয় না – “নমস্কার” করাই যথেষ্ট। আমরা আপনার কর্মের উপর হোঁচট খেতে চাই না। সেটা ভালো হোক বা খারাপ হোক,আমরা তা আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাই না। যখন আপনার গুরু আপনার নির্দিষ্ট কর্মের জন্য একটা কৌশল স্থির করেছেন, সেটাকে সবধরনের মানুষের সাথে মিশিয়ে ফেলা উচিত না। নয়ত, সেটা অনাবশ্যকভাবে জটিল হয়ে উঠবে।

কারুর উপর দিয়ে যাবেন না। তাঁদের পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন। এটা সম্মানেরও চিহ্ন।

যদি সবজায়গা থেকে অনেক তথ্য নিতে থাকেন, কর্মের প্রক্রিয়াটা খুব জটিল হয়ে ওঠে। আর আপনার কর্মের জন্য যে কৌশল তৈরী করা হয়েছে সেটা কাজ করবে না, যদি আপনি অনবরত সেটাকে অন্য কারুর সাথে মেশাতে থাকেন। যাঁরা গুরুতর সাধনায় লিপ্ত, তাঁরা অনেকসময় একাকী গুহায় বা ঐধরনের জায়গায় চলে যান, তার কারন হল, তাঁরা জিনিসগুলোকে জটিল বানাতে চান না। তাঁরা নিজের কর্মের জটিলতা উপলব্ধি করেছেন, তাই সেটাকে আরও বেশি জটিল বানাতে চান না।

এইজন্যই কারুর উপর দিয়ে যাওয়া উচিত নয়। আপনি তাঁকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন। এটা সম্মানেরও চিন্হ। তাছাড়াও, কারুর উপর দিয়ে গেলে, তাঁর শান্তিভঙ্গ হতে পারে। কারুর শক্তি-শরীরের উপর উপদ্রব করলে, তাঁরা হয়ত তক্ষুনি জেগে উঠবেন না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হবেন।

এসবকিছুই জীবনের এক মৌলিক বোধ থেকে আসছে। আপনি যাই করুন না কেন – কোনো ব্যবসা চালাচ্ছেন, বিয়ে করেছেন, বাচ্ছা বড় করছেন, যুদ্ধ লড়ছেন – এই দেশে সকলের জন্য একটাই লক্ষ্য – পরম মুক্তি। মুক্তিই একমাত্র লক্ষ্য। সমগ্র সংস্কৃতি একে ঘিরেই ঘটিত। যাতে অন্য কারুর কর্মে আপনি হোঁচট না খান, তারজন্য অনেক কৌশল বানানো হয়েছিল। আপনার কাছে যা আছে তার জটিলতা আপনি জানেন, তাই নতুন কিছু জোগাড় করতে চান না। নিজের ধাঁধাটা সমাধান করতে পারলেই, যথেষ্ট। আরও জটিল বানানোর প্রয়োজন নেই।

সদগুরু এই জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দেখেন এবং বিশ্লেষণ করেন কেন এই সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। ছবি, গ্রাফিক্স এবং সদগুরুর অনুপ্রেরণাদায়ক কথার মাধ্যমে হাজির হচ্ছে—আপনি যে রূপে আগে কখনো ভারতকে দেখেননি, সেই অনন্য রূপের ভারত।

Bha-ra-ta: The Rhythm of a Nation

ভা-র-ত: দ্য রিদম অফ এ নেশন

এই লেখার একটি সংস্করণ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ইশা ফরেস্ট ফ্লাওয়ার-এর এপ্রিল 2015 সংখ্যায়। এটি আপনি “নিজের ইচ্ছেমতো মূল্য দিন, ন্যূনতম কোনো সীমা নেই” ভিত্তিতে পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করতে পারেন অথবা প্রিন্ট সংস্করণের সদস্যপদ নিতে পারেন।