আরেকটু বৃহৎ একটা জীবন
সদগুরু কৃষ্ণের জীবনের একটা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে কৃপা, কর্ম এবং আধ্যাত্মিকতার পথে সাধকের জীবনের প্রকৃতি কেমন হয় সেই বিষয়ে আলোচনা করছেন।

সদগুরু কৃষ্ণের জীবনের একটা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে কৃপা, কর্ম এবং আধ্যাত্মিকতার পথে সাধকের জীবনের প্রকৃতি কেমন হয় সেই বিষয়ে আলোচনা করছেন।
প্রশ্নকারী: সদগুরু, আমরা যদি ধরে নিই কৃষ্ণ স্বয়ং ঈশ্বর ছিলেন, তাহলে তাঁর ভক্তরা এত অসুবিধার সম্মুখীন কেন হয়েছিলেন? এমনকি আপনি আমার জীবনে আসার আগে অবধি, আমার জীবন বেশিরভাগ মানুষের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল। এমনকি এখনও মানুষ আমার জীবন নিয়ে ঈর্ষান্বিত, কিন্তু সেটা অন্যভাবে। আসলে, এই যাত্রাটা আমার কাছে বেশ চড়াই- উতরাই ভরা। কৃপা যদি আমাদের জীবনকে আরও সহজ না বানায়, তাহলে তা থেকে কাজ কী?
সদগুরু: আপনি জানেন, বলরামও এইরকমই একটা প্রশ্ন করেছিলেন যখন তাঁদের মথুরা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল, তাঁরা বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলেন, এবং খাবার আর বিশ্রাম কোনটাই ঠিকঠাক হচ্ছিল না, তারা অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন বলরাম প্রশ্ন করলেন: “এইসব ঘটনা আমাদের সাথে কেন ঘটছে, তাও যখন তুমি আমাদের সাথে রয়েছ?” কৃষ্ণ উত্তরে বলেছিলেন, “জীবন যখন বিরাট মাপে ঘটছে, তখন অভিযোগ করো না।” আপনি জীবনের কিছু পরিস্থিতিকে ভালো আর কিছু পরিস্থিতিকে খারাপ, বা কিছু পরিস্থিতিকে কাম্য এবং কিছু পরিস্থিতিকে অবাঞ্ছিত হিসেবে ভাবেন বলেই আপনার মনে হয় এসব আপনার সাথে কেন ঘটছে, এর পরিবর্তে আপনি যদি জীবনকে কোন বিকৃতি ছাড়া দেখেন তাহলে এই প্রশ্নগুলো উঠবে না। যে মুহূর্তে আধ্যাত্মিক ধারায় পা রাখবেন, জীবন একটা বড়ো মাত্রায় ঘটতে আরম্ভ করবে, যেন সবকিছু দ্রুত গতিতে ছুটছে। যদি একটা জিনিসকে ভালো, আরেকটাকে খারাপ হিসেবে চিহ্নিত না করেন, তাহলে দেখবেন, যেটা হচ্ছে তা হলো জীবন প্রচন্ড তীব্রতায় গতিশীল। ভালো আর খারাপ বলে কিছু নেই। শুধুই জীবন ঘটছে। কিছু মানুষ সেটা উপভোগ করেন - আর কিছু মানুষ ভোগেন।
সবাই যাতে জীবন উপভোগ করতে পারে - আমাদের উচিত তা নিশ্চিত করা। এই পৃথিবীতে মূলত যা কিছু ঘটছে, তার আসলে কোনও গভীর তাৎপর্য কিন্তু নেই। এমনকি যদি বজ্রপাত হয় এবং আমরা সবাই সেই বজ্রাঘাতে পুড়েও যাই, তাও আমি একে কোনও মর্মান্তিক ঘটনা বলব না, শুধু বলবো “এটা একটা ঘটনা”। “তাহলে ঈশা ফাউন্ডেশনের কী হবে, আমার পরিবার, আমার সন্তানদের কী হবে?” আমরা যদি হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে যাই তাহলে তাদের সবার জন্যও, জীবন এক বৃহৎ মাত্রায় ঘটবে। আমি চাই আপনারা ভালো-খারাপের ধারণার ঊর্ধ্বে উঠে এটাকে দেখুন। জীবন প্রচন্ড তীব্রভাবে ঘটছে – এর বেশি আর কিছু না।
আপনি যদি আধ্যাত্মিক হতে চান, তার মানে স্বাভাবিকভাবেই আপনি আরও বৃহদাকার একটা জীবন খুঁজছেন। প্রকৃতপক্ষে, জীবনে যা কিছু অর্জনের চেষ্টা করেন, তা আরও বড় একটা জীবন পাওয়ারই প্রচেষ্টা। জীবনকে একটা ফলের সঙ্গে তুলনা করলে বলা চলে - যদি জীবনের শুধু একটা টুকরো খান, তা খেতে হয়তো মিষ্টি হবে, কিন্তু পরিমানটা সব সময় সীমিতই থাকবে। যদি একটি কেক থেকে শুধুমাত্র উপরের ক্রিমটুকু খেয়ে বেঁচে থাকেন, কিছু সময় পর সেই মিষ্টতা বিষের মতন মনে হবে। আপনি বললেন, “আমার জীবন বেশিরভাগ মানুষের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল”, কিন্তু আপনি নিজে জানেন সেটা কতটা শূন্য ছিল। যে মানুষদের কাছে গাড়ি নেই তাঁরা মনে করেন যাঁদের গাড়ি আছে তাঁরা খুবই ভাগ্যবান। গাড়ি নিঃসন্দেহে আরামদায়ক এবং সুবিধাজনক, কিন্তু সেটা বিরাট কোনও সৌভাগ্য নয়। যদি গাড়ির কোনো অস্তিত্বই না থাকত, তাহলে কেউই গাড়ি কেনার ইচ্ছা রাখতেন না। সমস্যাটা হল, অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করায়, যেমন, “ওঁর এটা আছে, আমার নেই?” এই মানসিকতায়। ” যাঁদের কাছে গাড়ি নেই, তাঁরা যদি গাড়ির মালিকদের সাথে নিজেদের তুলনা না করেন, তাহলে হাঁটা বা সাইকেল চালানোকে একেবারেই কোনও অংশে কম মনে হবে না। যখন আপনি বলছেন, “আমার জীবন সকলের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল”, উক্তিটা মূলত কিন্তু প্রাণ বা জীবনের জন্য করা হয়নি - উক্তিটা আপনার সামাজিক পরিস্থিতির জন্য করা।
জীবন মানে - আমি বলতে চাইছি আপনার অস্তিত্বের কথা এই আপনার সত্তা। এই মুহূর্তে, আপনি যে বিভিন্ন জিনিসকে জীবন বলে ভাবছেন সেগুলোকে একটু গভীরে দেখলে পাওয়া যাবে জীবনের সাথে কোনও সম্পর্কই তাদের নেই। এগুলোর বাস্তবের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই – এটা কেবল একটা মানসিক অবস্থা। সমস্ত কষ্টই সেই অসুস্থ মানসিকতার ফল।
যখন আপনি আধ্যাত্মিক পথে যাত্রা করেন তখন আপনার ভিতরের পরিস্থিতি খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। এর অনেকগুলো কারণ আছে। একটা মূল কারন হল আপনার প্রারব্ধ; মানে এই জন্মের জন্য বরাদ্দ কর্ম। সৃষ্টি খুবই কৃপা ময়। যদি এই জন্মে আপনার গোটা কর্মের ভান্ডার যে সঞ্চিত, তা আপনাকে দিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে আপনি মারা পড়তেন। আপনাদের মধ্যে অনেকজন তো এই জন্মেরই অনেক স্মৃতি ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। ধরুন, আমি আপনাদের গত একশো জন্মের স্মৃতি খুব তীব্রভাবে মনে করিয়ে দিলাম, তখন আপনাদের মধ্যে বেশিরভাগ জনই সেইসব স্মৃতির বোঝা বইতে না পেরে এখানেই প্রাণ ত্যাগ করবেন। সেইজন্য, প্রকৃতি আপনাকে যেটা সামলাতে পারবেন সেই পরিমানই কিছুটা প্রারব্ধ হিসাবে বরাদ্দ করছে। যদি আপনি প্রকৃতি নির্ধারিত প্রারব্ধ অনুযায়ী চলেন, আর ধরুন আপনি নতুন কোনও কর্ম সৃষ্টি করলেন না, এরকম অবস্থায় একশো জন্মের কর্মকে ক্ষয় করতে হয়তো আপনার কম করে একশো জন্ম লাগবে। কিন্তু যেহেতু নতুন কর্মও আমরা সৃষ্টি করে চলি তাই সেই একশো জন্মের প্রক্রিয়ায়, হয়ত আপনি আরও হাজার জন্মের জন্য যথেষ্ট কর্ম জোগাড় করে ফেলবেন।
যখন আপনি আধ্যাত্মিক পথে অগ্রগামী, তার মানে আপনি নিজের পরম লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য একটু তাড়ায় আছেন। আপনি আরও একশো বা হাজারবার জন্ম নিতে চান না, আপনি নিজের গতি বাড়াতে চান। আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করার অর্থ হলো আপনি জীবনকে বিশাল মাপে অনুভব করতে ইচ্ছুক। একবার যখন আপনি এসে আমার কাছে বসেন, এটা আমার আশীর্বাদ - জীবন মানে যা কিছু তা সবই যেন আপনার সাথে ঘটে। “যদি মৃত্যু ঘটে?” সেটাও চমৎকার। যদি সেখানে পৌঁছাতে ৭৫ বছর লাগানোর বদলে আপনি ৩৫ বছরেই সেখানে পৌঁছে যান, সেটা কি চমৎকার নয়? এটা শুধু যুক্তির প্রশ্ন নয় – এটাই জীবনের সত্য। হুবহু এই উক্তিটাই কৃষ্ণ গীতাতে করছেন: যদি তাদেরকে উপযুক্ত পরিস্থিতি প্রদান করা যায়, তবে তাঁরা যেন শীঘ্রই সেখানে পৌঁছাতে পারেন। "তামিল ভাষায় একটি অপূর্ব কবিতা আছে এক বালযোগী ও একজন মেয়ের যে এক মহান ভক্ত ছিল, তাদের বিবাহকে ঘিরে। তাঁরা ৩০০০ অতিথিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এক বিশাল বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর, সেই বালযোগী, যিনি একজন অসাধারণ কবিও ছিলেন, ভক্তিভাবপূর্ণ সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করেন। সকলে একাগ্রচিত্তে তাকে শুনছিলেন —তার অভিপ্রায়ও ছিল এটাই। সেই মুহূর্তে, যখন সকলের মন পুরোপুরি তাঁর প্রতি নিবিষ্ট, তখনই তিনি উপস্থিত সকলের মুক্তির এক মহাজগতিক ঘটনা ঘটালেন—তাঁরা সকলেই সেই বিবাহ মণ্ডপেই শরীর পরিত্যাগ করলেন। বহু শতাব্দী পর এক কবি এক করুণ বিলাপ করে বলেন: ‘তারা যদি আমায় সেই বিবাহে নিমন্ত্রণ করত, তবে আজ এই সংগ্রাম আমাকে করতে হতো না। আমিও তখনই পৌঁছে যেতাম লক্ষ্যে। আমি কয়েক শতাব্দী দেরিতে এসেছি। হায়, আরেকটি এমন বিবাহ কি আমার জন্য হবে না?”
একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে ৩০০২ জন ব্যক্তির মৃত্যুটা তাঁর কাছে মর্মান্তিক ঘটনা মনে হয়নি। বাল যোগীর উপস্থিতিতে সকলের একইসময়ে মুক্তিলাভ করাটা তাঁর কাছে একটা পরম সৌভাগ্য। একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি কোনও ঘটনাকে ভালো বা খারাপ হিসেবে দেখেন না – তাঁর একমাত্র চিন্তা হল জীবন কতটা তীব্রভাবে ঘটছে। ভালো আর খারাপ হল সামাজিক ধারণা – এর সাথে জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই। যখন আপনি এক বিশেষ পথের দীক্ষা গ্রহণ করেন, তখন আপনি আর কেবল প্রারব্ধের খেলায় বাঁধা থাকেন না। যদি আপনি একশো টা জীবনের কর্মফল একসাথে এই মুহূর্তে গ্রহণ করতে চান, তবে স্বাভাবিকভাবেই আপনার জীবন তীব্রতার সঙ্গে ঘটবে। যদি আপনি মনের স্থির ভাব বজায় রাখতে পারেন, তাহলে দেখবেন আপনার জীবনে যে ঘটনাই ঘটুক না কেন, সেটা আপনাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদি এই সম্ভাবনাটা দেখতে না পান, আর নিজের সামাজিক পরিস্থিতির দ্বারা যদি প্রভাবিত হয়ে পড়েন, তাহলে জীবনের দ্রুতগতির কারণে, আপনি ভাবতে পারেন জীবনে অনেক গন্ডগোল হচ্ছে, কিন্তু আসলে তা নয়।
“ইতিবাচক” শব্দকে ভুল বোঝার অনেক সম্ভাবনা থাকে, কারণ আপনার মন সব সময় সেই নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করে। আমি সচেতনভাবেই নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করি, কারণ আপনি সেটাকে ভুল বুঝতে পারবেন না। আপনি আধ্যাত্মিক হলে তার অর্থ হল, মূলত, আপনি এখন যেমন আছেন সেটাকে শেষ করে ফেলতে চান। একই কথা সুন্দরভাবে বললে দাঁড়ায়: আপনি মুক্তি খুঁজছেন। নিজের পরম প্রকৃতিকে খুঁজছেন, ঈশ্বরকে খুঁজছেন, আপনি সীমাহীন হয়ে যেতে চান। সীমাহীন হতে চাওয়ার মানে, আপনি এখন যেভাবে বেঁচে আছেন, সেটার অন্ত চান। একবার এই ইচ্ছা প্রকাশ করলে, এবং আপনার মধ্যে সেই প্রয়োজনীয় শক্তি নিবেশ করা হলে, আপনার সাথে এমনকিছু ঘটতে শুরু করবে, যা আপনি এখন যেমন আছেন সেই বর্তমান অবস্থাকে শেষ করতে চাইবে। তার মানে এই নয় যে, আপনার সাথে খারাপ জিনিস ঘটবে। শুধু এই যে, জীবন খুব দ্রুত-গতিতে এগোবে, অবিশ্বাস্য গতিতে।
তাহলে, কৃপা কী? এই অস্তিত্বের মধ্যে, শক্তির বিভিন্ন অভিব্যক্তি বা প্রকাশ আছে। কৃপা কাজ করে সূর্যের আলো রূপে, বাতাসের রূপে, মাধ্যাকর্ষণ রূপেও। মাধ্যাকর্ষণ আপনাকে নিচে টানার চেষ্টা করছে; বাতাস আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে; সূর্য আপনাকে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছে – কৃপা আপনাকে এই গ্রহ থেকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। এগুলো নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করে বললে এরকম বলা হয়। এই একই জিনিস ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করে বললে দাঁড়ায়, পৃথিবী আপনাকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করছে; বাতাস আপনাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে; সূর্য আপনাকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছে – কৃপা আপনার বৃদ্ধি বা উন্নতি চাইছে। নেতিবাচক শব্দগুলোই ব্যবহার করা যাক, কারণ তাহলে আপনি সেগুলোর প্রতি আসক্ত হবেন না। আপনি এখন যে সীমাবদ্ধতাগুলোয় আটকা পড়ে আছেন, কৃপা আপনাকে সেগুলো থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে। সেই সীমাবদ্ধতাগুলোর মধ্যে পড়ে এই গ্রহ, মানুষজন, দেহ, মন, আবেগ - সবকিছু। আপনি যদি কৃপা কে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন, আর তা নিজের কাজ করতে শুরু করে আপনাকে টেনে তুলতে থাকে, কিন্তু একইসঙ্গে আপনি যদি নিজের নোঙ্গর সেখানেই নামিয়ে রাখেন, তাহলে আপনি নিজের জন্য অনাবশ্যক সংগ্রাম তৈরী করবেন। আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার কারণে যদি জীবন দ্রুত গতিতে ঘটতে থাকে, সেটা ঠিক আছে। যদি সংগ্রাম চলে, তার মানে শুধু এই যে, আপনি নিজেকে টেনে তোলার জন্য কৃপা কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কিন্তু যদি নিজের নোঙ্গর নামিয়ে রেখেছেন – এরকম করলে, স্বাভাবিকভাবেই, আপনি সংগ্রাম করবেন।
Editor’s Note: Sadhguru explores the life and path of Krishna. Watch the Leela series, available as a free webstream – one part every week.