প্রশ্ন: কথায় বলে, মরলেও অভ্যাস যায় না। শিশুবস্থায় আমাদের যে প্রবণতাগুলো তৈরি হয়, সেগুলো কি আমরণ থাকে?

সদগুরু: আসুন এটাকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। একটা অভ্যাস তৈরি করার মূল কারণ হল আপনার জীবনে যাতে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আসে – এটা জীবনের কিছু অংশকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলে। সেটার ব্যাপারে আপনাকে আর ভাবতে বা চিন্তা করতে হয় না। আপনি সেটা এমনি এমনি করে ফেলতে পারেন। 

একজন মানুষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ বা আত্মরক্ষার কৌশল হিসাবে, স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে কিছু অভ্যাস তৈরি করতে হয়, কারণ, অন্য পশুদের মত আমাদের বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য স্থির বেঁধে দেওয়া নয়। অন্য পশুদের বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য স্থির বাঁধা। দুটি কুকুরের মধ্যে, বা দুটি বিড়ালের মধ্যে খুব কমই পার্থক্য লক্ষ্ম করা যায়। তাদের নিজের নিজের ব্যক্তিত্ব থাকলেও তাদের বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য পূর্বনির্ধারিত। আমাদের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত অংশটা খুবই খুবই কম। মানুষদের জন্য প্রায় সবকিছুই উন্মুক্ত। এইকারণে, শিশু অবস্থায় নিজের কিছু প্যাটার্ন তৈরি করে আপনি নিজের ভিতরে একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করেন।

প্যাটার্নগুলি থেকে বেরিয়ে আসা

প্রত্যেক শিশু টিকে থাকা বা বেঁচে থাকার জন্য কিছু কিছু অভ্যাস তৈরি করে। এটা হল বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি। এইসব প্যাটার্নের সাহায্যে, কাজ করাটা একটু সহজ হয়ে যায়। এটা বাচ্চাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সাধারণত, বড় হতে হতে বাচ্চারা এইসব প্যাটার্ন থেকে বেরিয়ে আসে, আর এই বেরিয়ে আসাটা নির্ভর করে আপনি তাঁদের চারপাশে কতটা খোলামেলা পরিবেশ দেন ও সচেতনতা তৈরি করতে পারছেন, তার উপর। মানুষ পরিবর্তিত হয় অভিজ্ঞতা অথবা শিক্ষার মাধ্যমে। মাত্র তিন বছরের জন্য বাইরে গিয়ে ফিরে আসার পর বাবা-মারা নিজের সন্তানদের চিনতেই পারেন না – মানুষ এমন নাটকীয়ভাবে পাল্টে যেতে পারে। তাঁদের সবকিছু পাল্টে যায়, একটা ভিন্ন মাত্রার অভিজ্ঞতা অর্জনের কারণে।

যদি কেউ আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করে, তার সমস্ত অভ্যাসই দূর হয়ে যাবে। কারণ ভালো এবং খারাপ অভ্যাস বলে কিছুই নেই।

যাঁরা ভীতিপূর্ণ আর সর্বদাই আত্মরক্ষায় ব্যস্ত, তাঁরা তাঁদের পুরোনো অভ্যাসগুলোকে সহজে ছাড়তে পারেন না। যাঁরা উত্তেজনা, জীবন, রোমাঞ্চ সন্ধান করছেন – তাঁরা খুব সহজেই নিজের অভ্যাস ছাড়তে পারেন কারণ তাঁরা সর্বদাই নিজের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে নিজের জীবনকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করছেন।

সর্বোপরি, যদি কেউ আধ্যাত্মিক পথে চলেন, তাঁর সব অভ্যাস ছেড়ে যাবে কারণ ভালো বা খারাপ অভ্যাস বলে কিছু হয় না। সমস্ত অভ্যাসই খারাপ। জীবনের একটা পর্যায়ে হয়ত সেটা বেঁচে থাকার অস্ত্র বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু একবার বড় হয়ে গেলে আপনার কোনও অভ্যাস থাকা উচিত না, সেটা ভালো হোক বা খারাপ, কারণ অভ্যাস মানে হল আপনি অচেতনভাবে জীবনকে পরিচালনা করছেন। সেটা খুব নিরাপদ মনে হলেও সেটা কিন্তু অনেকভাবে আপনাকে জীবন থেকে বঞ্চিত করছে।

অভ্যাস এবং কর্ম

আমাদের ভিতরে যা যা অচেতন প্যাটার্ন আছে, সেগুলোকে ভাঙার মূল অস্ত্র হল আধ্যাত্মিকতা। যাকে আমরা কর্ম বলি সেটাও ঠিক তা-ই। কর্ম মানে, আপনি অচেতনভাবে নিজের জন্য কিছু প্যাটার্ন বানাচ্ছেন, এটা শুধু আপনার ব্যবহার বা আচরণেই তৈরি হয় না, আপনি জীবনকে কীভাবে অনুভব করেন সেটাও একটা ধাঁচে বেঁধে যায়। মানুষ যদি নিজের জীবনকে পরীক্ষা করে দেখেন, যেভাবে পরিস্থিতিগুলো ঘটছে, যেভাবে সুযোগগুলো আসছে, যেভাবে তাঁদের মানুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে, এর সবটাই কিছু নির্দিষ্ট ধাঁচে বাঁধা। এটি হয়েছে শুধুমাত্র আপনার তৈরি করা কর্মের প্যাটার্নের কারণে।

কর্মের প্যাটার্নের একটা ছোট অভিব্যক্তি হল অভ্যাস। আপনি নির্দিষ্ট কিছু ইনপুট গ্রহণ করলেন, আর সেটার একটা প্যাটার্ন তৈরি করলেন। এটাই আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়। আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার অর্থ হল, আপনি নিজের অন্তরে কিছু অচেতনভাবে ঘটতে দিতে চান না। নিজের জীবনকে অচেতনভাবে পরিচালনা করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়। অভ্যাসটা শিশুবস্থায় শুরু হয়েছিল, নাকি মায়ের গর্ভে, নাকি তারও আগে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি আপনি বিবর্তন চান, যদি আপনি মুক্তি চান, তাহলে সব প্যাটার্ন ভেঙে ফেলতে হবে – ভালো প্যাটার্ন বা খারাপ প্যাটার্ন নয়, সব প্যাটার্ন। মৃত্যু অবধি অপেক্ষা করতে হবে না। মৃত্যুতেও সব প্যাটার্ন ভাঙে না।

যদি মারাও যান, যদি আপনার শরীর পুড়িয়েও দেওয়া হয়, তবুও আপনার প্যাটার্নগুলো ভাঙবে না। কর্ম এমনই। শরীর হারালেও এই প্যাটার্নগুলো ভাঙা যায় না, কারণ এটা তারও উর্দ্ধে। তাই যখন আপনি জীবিত এবং সচেতন থাকেন, তখন এই প্যাটার্নগুলোকে অতিক্রম করার চেষ্টা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্যাটার্নগুলো ভেঙে ফেলুন আর নিজের জীবনকে সচেতনভাবে চালনা করুন। যেমন ধরুন, আমি এখন কথা বলছি – আমি অভ্যাসবশত বলতে পারি অথবা সচেতনভাবেও বলতে পারি। সেটাই হল বড় পার্থক্য। আমি যদি বসে শুধু গল্পও করি, তবুও দশ হাজার মানুষ সেটা শুনতে চাইবেন, কারণ প্রত্যেকটা শব্দ সচেতনভাবে বলা হচ্ছে, অভ্যাসবশত নয়। এর মধ্যে কিছুই অভ্যাসের বশে নেই। আমি যা বলছি, তার বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, মানুষ তাও শুনতে চাইবেন, কারণ প্রত্যেকটা শব্দ সচেতনভাবে বের হচ্ছে, এবং সেটা শক্তিশালী। যদি আপনি প্রত্যেকটা শ্বাস-প্রশ্বাস সচেতনভাবে নেন, হঠাৎই আপনার শ্বাস একদম অন্যধরনের শক্তি ধারণ করবে। জীবনের প্রত্যেকটা গতিবিধি যদি আপনি সচেতনভাবে করেন, তাহলে প্রত্যেকটা নড়াচড়াতেও প্রচন্ড শক্তি থাকবে। যদি জীবনের শক্তিকে জানতে চান, তাহলে আপনাকে এসম্পর্কে সচেতন হতে হবে, অন্যথায় জীবনীর শক্তি আপনার কাছে একেবারেই অস্তিত্বহীন

সম্পাদকীয় মন্তব্য: সদগুরুর আরও অন্তর্দৃষ্টি জানতে পাবেন “অফ মিস্টিকস অ্যান্ড মিস্টেকস”-বইতে। প্রিভিউ অধ্যায় ডাউনলোড করুন অথবা ই-বুকটি ইশা ডাউনলোডস থেকে কিনুন।