কর্ম কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?
কর্মের অর্থ কী, তার ব্যাখ্যায় সদগুরু বলছেন, এটা একটা নির্দিষ্ট পরিমান তথ্য, এবং কর্ম কত ধরনের ও আমাদের জীবনে কর্মের ভূমিকা কী, তা নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করছেন।

কর্ম কী?
সদগুরু: আপনি যাকে “নিজের জীবন” বলছেন, সেটা একটা নির্দিষ্ট পরিমান শক্তি যেটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে একটা নির্দিষ্ট পরিমান তথ্য। আজকের ভাষায় এই তথ্যকে সফটওয়্যার বলা যেতে পারে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রাণশক্তিকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ তথ্য দিয়ে চালিত করা হচ্ছে। একত্রে, এই তথ্যপ্রযুক্তিটি হলেন আপনি। আপনার মধ্যে যে ধরনের তথ্য প্রবেশ করেছে তা নির্ধারণ করে আপনি কী ধরনের চরিত্র হয়ে উঠবেন।জন্মের মুহূর্ত থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত, আপনি যে ধরনের পরিবার, বাড়ি, বন্ধু পেয়েছেন, যা কিছু আপনি করেছেন বা করেননি – এই সমস্ত জিনিস আপনাকে প্রভাবিত করছে। প্রত্যেকটা চিন্তা, ভাবনা আর কাজ - আপনার ভিতর জমা অতীতের ছাপ থেকেই আসছে। তারাই ঠিক করছে এই মুহূর্তে আপনি কে। আপনার ভিতরে আসা তথ্যগুলিকে যেভাবে আপনি একত্রিত করেছেন, ঠিক সেইভাবেই আপনি জীবনের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, জীবনকে বোঝেন।
অতীতের ছাপ বা প্রভাবগুলোর সঞ্চয় জীবনে জন্মের মুহূর্ত থেকে শুরু হয় না, এই সঞ্চয়ের শুরু জন্মের মুহূর্তেরও পূর্বকাল থেকে, কিন্তু অন্ততঃ জন্মের মুহূর্ত থেকে এখনও পর্যন্ত কী ধরনের মা-বাবা, পরিবার, শিক্ষা আপনি পেয়েছেন, কী ধরনের ধার্মিক আর সামাজিক পটভূমি পেয়েছেন, কী ধরনের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল পেয়েছেন এবং তা আপনার ভিতরে কেমন প্রভাব বা ছাপ ফেলেছে তা এই মুহূর্তে আপনার ধারণা-বোধে রয়েছে। অন্য কেউ একটি আলাদা চরিত্র হয়েছেন কারন শুধুমাত্র তাঁর ভিতর যা তথ্য গেছে সেটা আলাদা বলেই। এটাকেই কর্ম বলে। পরাম্পরাগতভাবে এই তথ্যকেই কর্ম বা কার্মিক শরীর বা কারণ শরীর বলা হয় – যা জীবনের কারন।
কর্মের ধরন
এই তথ্য অনেক স্তরে সঞ্চিত হয়। কর্মের চারটি মাত্রা আছে, যার মধ্যে দুটি এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক নয়। বোঝার জন্য, আমরা অন্য দুটির মাত্রার কথা বলতে পারি।
সঞ্চিত কর্ম
একটি হল সঞ্চিত কর্ম। এই সঞ্চিত কর্ম হল কর্মের গুদামঘর বা ভান্ডার এবং এর শুরু সেই জড় পদার্থ, এককোষী প্রাণী, প্রথম প্রাণের সূচনার সময় থেকে। সমস্ত তথ্য এখানে উপস্থিত। যদি নিজের চোখ বন্ধ করেন, যথেষ্ট সচেতন হয়ে নিজের ভিতরে দেখেন, আপনি ব্রহ্মান্ডের প্রকৃতি জানতে পারবেন – আর সেটার কারন মস্তিস্ক দিয়ে বিচার করছেন বলে নয়, বরং এই তথ্যগুলি আপনার দেহের গঠনেই উপস্থিত আছে বলে। এই তথ্যভান্ডারে সৃষ্টির সূচনালগ্নের সময়ের তথ্যও রয়েছে। সেটাই আপনার সঞ্চিত কর্ম। কিন্তু এই গুদামঘর নিয়ে আপনি খুচরো ব্যবসা করতে পারবেন না। খুচরো ব্যবসার জন্য একটা দোকান দরকার। সেই খুচরো ব্যবসার দোকান হলো যেটা শুধু এই জন্মের জন্য বরাদ্দ, আর তাকে বলা হয় প্রারব্ধ।
প্রারব্ধ কর্ম
প্রারব্ধ কর্ম হল একটা নির্দিষ্ট পরিমান তথ্য যেটা এই জীবনের জন্য বরাদ্দ। আপনার জীবন কতটা প্রাণবন্ত, তার উপর নির্ভর করে, জীবন যতটা তথ্য নিতে পারবে ততটাই নিজের জন্য বরাদ্দ করে। এই সৃষ্টি অত্যন্ত করুণাময়। আপনার যত কর্ম আছে তার পুরোটাই যদি সৃষ্টি আপনাকে দিয়ে দেয়, আপনি মারা পড়বেন। এখন, বহু মানুষ এই জন্মেরই গত ৩০-৪০ বছরের স্মৃতির দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছেন। তাঁদের যদি সেই স্মৃতির একশগুন দিয়ে দেওয়া হয়, তাঁরা আর টিকতে পারবেন না। তাই প্রকৃতি প্রারব্ধ বরাদ্দ করে, এমনভাবে যাতে আপনি সামলাতে পারেন।
কর্মের বন্ধন ছেড়ে বেরিয়ে আসুন!
আপনার যে ধরনের কর্মই থাকুক না কেন, সেটা একটা সীমিত সম্ভাবনা এবং সেটাই আপনাকে মানুষ হিসেবে সীমিত করে তুলছে। কী ধরনের প্রভাব আপনার উপর পড়েছে, সেটা হতে পারে ঘৃণা আর রাগ, কিংবা প্রেম আর খুশি, তার উপর নির্ভর করে, সেই অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট ভাবে তৈরী হয় আপনার ব্যক্তিত্ব বা পার্সোনালিটি – সাধারণত প্রতিটা মানুষই এইসব জিনিসের এক একটি জটিল মিশ্রণ। এই কার্মিক গঠনটিকে একটা পর্যায়ের বেশি বাড়তে দিলে, স্বাধীনতা বলে আর কিছু থাকে না। আপনি যা কিছু করেন, সবই অতীতের প্রভাবে নির্ধারিত হবে। যদি মুক্তির দিকে এগোতে চান, তাহলে প্রথমে যেটা আপনাকে করতে হবে সেটা হল, কর্মের বন্ধনটাকে ঢিলা করা। নয়ত, কোনও রকম গতিবিধি সম্ভব না।
সেটা করবেন কীভাবে? একটা সহজ পদ্ধতি হল শারীরিকভাবে কর্মকে ভাঙা। আপনার কর্ম যদি হয় সকাল ৮টায় ঘুম থেকে ওঠা, তাহলে নিজের এলার্মকে ভোর ৫টায় সেট করুন। আপনার শরীরের কর্ম হল, সে উঠতে চাইবে না। কিন্তু আপনি বলবেন, “না, আমি উঠবোই।” বিছানা ছেড়ে উঠলেও, আপনার শরীর চাইবে গরম কফি। কিন্তু আপনি তাকে দিলেন ঠান্ডা জলের স্নান। এইভাবে আপনি পুরোনো কার্মিক প্রক্রিয়াটিকে ভাঙছেন সচেতনভাবে অন্য কিছু করার মাধ্যমে। যেটা আপনার পছন্দ, সেটা তো অসচেতনভাবেও করতে পারেন, তাই না? যেটা পছন্দ নয়, সেটা করতে গেলে সচেতন হতেই হবে। এটাই একমাত্র উপায় নয়, অন্য আরও সূক্ষ, আরও কার্যকরী উপায় আছে। আমি শুধু আপনাদের সবচেয়ে সথূল উপায়টি বলছি।
আধ্যাত্মিকতা এবং কর্ম
একবার আপনি আধ্যাত্মিক পথে এলে, আপনি আসলে বলছেন, “আমি আমার পরম লক্ষ্যে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চাই।” আপনি আরও একশবার জন্ম নিতে চান না। আর এই একশ জন্মের প্রক্রিয়ায় হয়ত আপনি এত কর্ম জোগাড় করে ফেললেন, যা কিনা আরও হাজারটা জীবনকালের জন্য যথেষ্ট। আপনি একটু তাড়ায় আছেন। একবার কোনও আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে, যদি দীক্ষার প্রক্রিয়াটা নির্দিষ্টভাবে করা হয়ে থাকে, তাহলে এমন মাত্রা খুলে যায় যেগুলো অন্যকোনওভাবে খোলা সম্ভব ছিল না। আধ্যাত্মিক না হলে হয়ত আরও শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু সে জীবন হতো আরও প্রাণহীন জীবন, সে জীবন এমন হতো যে যেন জীবনটা জীবনের চেয়ে মৃত্যুরই বেশি কাছাকাছি। আপনার মধ্যেকার গভীরের কোনও মৌলিক কিছুকে না ছুঁয়েই হয়ত আপনি আরামে পেরিয়ে গেলেন।
তার মানে কি এই যে, একবার আধ্যাত্মিক পথে এলে শুধু খারাপ জিনিসই ঘটতে থাকবে? ব্যাপারটা সেরকম নয়। শুধু এই যে, জীবন যখন দুর্দান্ত গতিতে এগোতে থাকে, আপনার চারপাশের মানুষদের চেয়েও অনেক দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে, তখন আপনার মনে হতে পারে আপনার সঙ্গে কোনও ট্রাজেডি ঘটছে। আসলে আপনার সঙ্গে কোনও ট্র্যাজেডিই ঘটছে না। যেটা ঘটছে সেটা হল, অন্যদের জীবন সাধারণ গতিতে যাচ্ছে, কিন্তু আপনার জীবন অনেক দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
অনেক লোকের এই ভুল ধারণা আছে যে, একবার আধ্যাত্মিক পথে এলে, জীবন শান্তিপূর্ণ হয়ে যায় আর সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। আপনি যদি একটা সুবিধাজনক বিশ্বাস-ব্যবস্থাকে আঁকড়ে থাকেন আর মনটাকে এমন করে তোলেন যে সে কেবল একটা দিকেই তাকায়, একটা দিক ছাড়া অন্য কোনও দিকে তাকায় না, তখন সবকিছু পরিষ্কার বলে মনে হয়। কিন্তু যদি আপনি সত্যিই আধ্যাত্মিক পথে থাকেন, তবে কিছুই আর স্পষ্ট থাকবে না। সবকিছু ধোঁয়াশা হয়ে যাবে। যত দ্রুতগতিতে যাবেন তত বেশি ধোঁয়াশা হয়ে ওঠে।
কয়েক বছর আগে, আমি জার্মানিতে ছিলাম, আর প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর আমাকে ড্রাইভ করে ফ্রান্সে যেতে হত, গন্তব্যটা সেখান থেকে 440 কিলোমিটার দূরে ছিল। সাধারণত এই যাত্রাটা 5 ঘন্টার। আমার 5 ঘন্টা রাস্তায় কাটানোর কোনও ইচ্ছে ছিল না, তাই আমি খুব জোরে চালালাম। আমরা প্রায় 200 কিমি প্রতি ঘন্টা গতিতে যাচ্ছিলাম। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর, আমি ভেবেছিলাম সেটা দেখবো। আমি চোখ ঘোরানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু বাইরে সব ধোঁয়াশা লাগছিলো আর আমি রাস্তা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারিনি। বরফ পড়ছিল, আর আমরা পাগলের মতো গতিতে যাচ্ছিলাম।
যত দ্রুত গতিতে যাবেন, সবকিছু ধোঁয়াশা হয়ে যাবে, আর আপনি যা করছেন সেখান থেকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারবেন না। প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে চাইলে, ধীরে ধীরে যেতে হবে। গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া থাকলে, উড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিছুই দেখতে পাবেন না। শুধুই সমানে এগিয়ে চলা। আধ্যাত্মিক পথ এরকমই। যদি আপনি সত্যি সত্যিই আধ্যাত্মিক পথে থাকেন, দেখবেন আপনার চারপাশে সবকিছু টালমাটাল। কিন্তু আপনি তাও এগিয়ে চলেছেন, এর মানে সব ঠিক আছে। রাজি তো? রাজি না হলে, বিবর্তনের গতিতেও যেতে পারেন। হয়ত কয়েক লক্ষ বছর পর সেখানে পৌঁছবেন।
যাঁরা তাড়ায় আছেন, তাঁদের জন্য একধরনের পথ। যাঁদের তাড়া নেই, তাঁদের জন্য অন্যধরনের পথ। আপনি কি চান সে বিষয়ে স্পষ্ট হতে হবে। দ্রুতগতির রাস্তায় নেমে ধীরে যেতে গেলে, গাড়ি চাপা পড়বেন। ধীরগতির রাস্তায় দ্রুত যেতে গেলে, জরিমানা দিতে হবে। প্রত্যেক সন্ধানীকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে – তিনি কি রাস্তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, নাকি গন্তব্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চান?
সম্পাদকের বার্তা: এই ভিডিওটিতে, সদগুরু বলছেন স্মৃতির প্রকৃতি কী, এবং কীভাবে এটি আমাদের মন আর আবেগকে, এমনকি শরীরকেও প্রভাবিত করে।
সদগুরুর কর্ম বিষয়ক আরও উদ্ধৃতিগুলি এখানে দেখুন এবং শেয়ার করুন।