সদগুরু: শঙ্করন পিল্লাই একটি লোকাল বাসে চাপলেন। হঠাৎ, শাল দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে কুঁকড়ে বসলেন। অবাক এক সহযাত্রী তাঁকে জিগ্যেস করলেন, “মশাই, ঠিক আছেন তো?” শঙ্করন পিল্লাই তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে তিনি ঠিক আছেন, আর বললেন, “আমি যদি ওই বয়স্ক মহিলাকে দেখি, তবে ওনাকে সিটটা ছেড়ে দিতে হবে। তাই না দেখার ভান করে কুঁজো হয়ে বসে আছি, ব্যাস।”

শঙ্করন পিল্লাইয়ের কাছে বিকল্প ছিল হয় দাঁড়িয়ে নিজের সিট ছেড়ে দেওয়া, নাহয় বসে থাকা। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জড়ানোকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন, তাঁরা এটা বোঝেন না যে এড়িয়ে যাওয়াটাই একটা বড় কর্ম। যে মুহূর্তে আপনি জড়িত থাকাকে পরিহার করবেন, আপনার কর্ম কয়েকগুন বেড়ে যাবে। এবং এই হিসাব-নিকাশটা – “আমি নিজের সিটটা ছেড়ে দেব কি না” – এটা আরও বড় কর্ম।

 

তো কীভাবে এই জড়ানো-এড়ানোর ফাঁদ থেকে বেরোনো যায়? এই প্রশ্নটি বহুজনকে বিভ্রান্ত করেছে। বিভ্রান্তির অবস্থায়, আপনার চারপাশে সবকিছু আপনার সাথে সেঁটে যায়! যেন আপনার গায়ে খুব জোরালো আঠা লাগানো আছে, প্রতিটি ধূলোকনাও সেঁটে যাচ্ছে! কর্ম একত্রিত করার সাথে ভালো কাজ বা খারাপ কাজ করার কোনও সম্পর্ক নেই। বিভ্রান্ত ইচ্ছা আর সীমিত আকাঙ্খার কারণেই মানুষ নিজের ভিতরে কর্মের বোঝা বাড়িয়ে চলেছেন। কিছু সময় পর, আপনার চারপাশে এমন কর্মের পাহাড় জমে যায় যে শ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে যায়। 

মানুষের ইচ্ছা সীমিত হতে পারে আবার অসীমও হতে পারে। ইচ্ছাকে অসীম বানালে, সেখানেই কর্মের ইতি।

এই বিশাল কর্মের পাহাড়কে ভাঙার কি কোনও উপায় আছে? উত্তরটা সহজ: আপনি ভাঙার চেষ্টা করবেন না। শুধু আঠাটা ধুয়ে ফেলুন। এক মুহূর্তেই গোটা পাহাড় গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাবে। এই আঠাটা মোছা যায় কীভাবে? এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে নয়, বরং সচেতনভাবে জড়িত হয়ে। সচেতনভাবে  জড়ালে, আর কোথাও আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। 

মানুষের চাহিদা সীমিত হতে পারে আবার অসীমও হতে পারে। নিজের চাহিদাকে অসীম বানাতে পারলে, সেখানেই কর্মের ইতি। অন্যথায়, যদি নিজের পছন্দ-অপছন্দের, অর্থাৎ কোনটা “আমার” কোনটা “আমার নয়” এই সঙ্কীর্ণ ধারণার উর্দ্ধে উঠতে পারেন, সেখানেই কর্মের ইতি। নিজের ইচ্ছাকে সর্বব্যাপী করুন, সবকিছুকে আপনার করে নিন, পৃথিবীর জন্য জননী হয়ে উঠুন, তাহলেও আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা চিরতরে মিলিয়ে যাবে।

যোগের সমগ্র ব্যবস্থার অভিমুখ হল কোনও নির্দিষ্ট ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য ছাড়াই গভীরভাবে যুক্ত হওয়ার দিকে।

আধ্যাত্মিক পথের চরম লক্ষ্য হল, অনাসক্তভাবে জড়িত হওয়া এবং অবিচল মনোযোগ। কিসের সাথে সংযুক্ত হলেন বা কিসে মনোযোগ দিলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় – ভগবান, একটা পাথর, কোনও পুরুষ বা নারী। মনোযোগের বস্তুটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। যোগের পরম্পরায় আকাশী মুদ্রা অভ্যাসটি হল কোনো কিছুতেই মনোযোগ না দিয়ে; শূন্য স্থানে অবিচল মনোযোগ রাখা। এর মূল কথা হল যে, মনোযোগের বস্তুর উপর মুক্তি নির্ভর করে না, বরং শুধু মনোযোগটার উপরই নির্ভর করে।

যোগের সমগ্র ব্যবস্থার অভিমুখ হল কোনও নির্দিষ্ট ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য ছাড়াই গভীরভাবে যুক্ত হওয়ার দিকে। সময়ের সাথে সাথে, এটাকে উদাসীনতা হিসেবে ভুল বোঝা হয়েছে : মানুষ যুক্ত হওয়াকে জড়িয়ে পড়ার সাথে আর অনাসক্তিকে উদাসীনতার সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। যা তারা ভুলে গেছেন – আর যেটা শঙ্করন পিল্লাই সেই বাসে আবিষ্কার করলেন – তা হল কাউকে উপেক্ষা করতে গেলেও অনেক বেশি জড়িয়ে যেতে হয়!

অন্তর্ভুক্তির যাত্রাই আপনাকে মুক্তি দেয়, লক্ষ্যটি নয়।  বাদ দেওয়ার মাধ্যমে আপনি জালে আটকা পড়ে যান। অন্তর্ভুক্তিতে, আপনি হন মুক্ত।

যেহেতু জীবন নিজেই একটি উদ্দেশ্যহীন প্রক্রিয়া, তাই সেই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে চূড়ান্তভাবে যুক্ত হতে পারলে তবেই জীবনের রস উপভোগ করা যায়। প্রক্রিয়াটি নিজেই উদ্দেশ্য; লক্ষ্যটা হল শুধু একটি পরিণাম। এই জিনিসগুলোকে সহজ করার জন্য অনেক প্রাচীন পরম্পরায় “ভক্তি”র কথা বলা হয়েছে। 

ভক্তির মধ্যে কোনও আবেগপ্রবণতা নেই। আপনার মধ্যে প্রকৃত ভক্তির আগুন জ্বলে উঠলে, সেটা সবকিছু পুড়িয়ে দেবে। সেটা নিশ্চিত করবে যে আপনি লক্ষ্য কি সেটা নিয়ে না ভেবে প্রক্রিয়ার প্রতি সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত। অন্তর্ভুক্তির যাত্রাই আপনাকে মুক্তি দেয়, লক্ষ্যটি নয়। বাদ দেওয়ার মাধ্যমে, আপনি জালে আটক পড়ে যান। অন্তর্ভুক্তিতে, আপনি হন মুক্ত।

সম্পাদকের নোট: সদগুরু ব্যাখ্যা করছেন, কীভাবে কর্ম অনেকের জন্য মায়া, এবং কীভাবে ক্রিয়া এবং প্রাণায়ামের প্রক্রিয়াগুলি আমাদের বিজ্ঞানময় শরীরকে শক্তিশালী করে, আর কর্ম থেকে দূরে সরতে সাহায্য করে। গোটা আর্টিকেলটি পড়ুন।

This article first appeared on Speaking Tree.