সদগুরু: আপনি যদি কোয়েম্বাটোর থেকে দিল্লি উড়ানে যান, পথে প্রত্যেক পাঁচ মিনিট অন্তর নিচে তাকালে দেখবেন, একমাত্র পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ছাড়া, বাকি সবটাই বাদামী রঙের মরুভূমি। এর একমাত্র কারণ বিবেচনাহীন চাষবাস। বর্তমানে ভারতের ৮৪ শতাংশ জমি চাষের আওতায় পড়ে। স্বাধীনতার সময় ৯৩ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করতেন। তার অর্থ এই নয় যে তারা পুরুষানুক্রমে কৃষিজীবী বা চাষী ছিলেন। দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন আড়াইশো বছর আগে আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম বস্ত্র রপ্তানিকারক ছিলাম। পৃথিবীর ৩৩ শতাংশ বস্ত্র ভারত থেকে রপ্তানি হতো। দেশের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মানুষ বস্ত্র উৎপাদনের কাজে যুক্ত ছিলেন। তুলোর মান খুব উন্নত না হওয়ায় আমরা কাঁচামাল হিসেবে কখনোই তুলো রপ্তানী করতাম না। কিন্তু সেই সাধারণ ছোট আকারের তুলো দিয়ে এবং রেশম, শন, পাট এবং যেকোনো ধরনের সূতো থেকে আমরা বস্ত্রশিল্পে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিলাম। আমরা ১৪০ রকমেরও বেশি বুনন পদ্ধতি সৃষ্টি করেছিলাম আর এতো অপূর্ব জিনিস তৈরি হতো এসব দিয়ে, যে সমস্ত পৃথিবী তা দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত।

কিন্তু ১৮০০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে আমাদের বস্ত্র রপ্তানি ৯৪ শতাংশ কমে গেল। এটা কোন দুর্ঘটনা নয়, বরং সুপরিকল্পিত ভাবে করা। ব্রিটিশরা তাঁতকল ভেঙে ফেলল, বস্ত্র বাজার ধ্বংস করল, সবকিছুর উপর তিনগুণ বেশি কর বসানো হল এবং তারা আমদানি করা বস্ত্র নিয়ে এলো। ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বলেছিলেন, "তাঁতিদের হাড়ে ভারতের সমভূমি সাদা হয়ে গিয়েছে"। জীবিকা উপার্জনের পথ ধ্বংস হওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষ খিদেতে মারা গিয়েছিল। যারা বেঁচে ছিল তারা জমি চাষ করে কোনক্রমে জীবিকা নির্বাহ করত। নিজের টিকে থাকার জন্য চাষ করা তখন থেকেই শুরু হল।

আমি চেষ্টা করছি এমন কিছু আইন আসুক, যেখানে আপনার ১ হেকটেয়ার জমি থাকলে বাধ্যতামূলকভাবে সেই জমিতে অন্তত ৫টি গবাদি পশু থাকতে হবে। না হলে, তার জমি বাজেয়াপ্ত করা হবে।

এরা বংশানুক্রমিকভাবে চাষী ছিলেন না। যে সব মানুষেরা বয়ন শিল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলেন তারা মরিয়া হয়ে চাষের কাজ করছিলেন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় ভারতীয় জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি লোক কৃষক ছিলেন। আজ তা কমে ৭০ শতাংশ হয়েছে। এর অর্থ হল ৭ জন লোক ১০ জন লোকের জন্য রান্না করছেন। খুব বেশি কর্মদক্ষ নয়, তাই না? কারণ আমরা অনেক জমি চাষ করে খুব অল্প উৎপাদন করছি। যদি আমরা কোন ভাবে কৃষির আমূল পরিবর্তন না করি তাহলে এর থেকে বেরোবার আর কোন পথ থাকবে না।

ভারতের মানুষ একই জমি হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে চাষ করছে। শেষে মাটির প্রকৃতি এত নিম্নমানের হল যে তা প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। এর কারণ সমস্ত গাছ কেটে ফেলা হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ পশু এই দেশ থেকে বাইরে রপ্তানি করা হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে এগুলো কেবলমাত্র পশু নয় – এগুলো আদতে আমাদের ভূমির উপরিভাগ যা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এরকম হলে কিভাবে আপনি মাটিকে পুনরুজ্জীবিত করবেন? যদি আপনি মাটির সংরক্ষণ চান, তাহলে অবশ্যই জৈবিক পদার্থ মাটিতে ফেলতে হবে। যদি কোন পাতা, পশুর বর্জ্য সেখানে না থাকে তাহলে আপনি কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। এই সাধারণ জ্ঞানটা প্রত্যেক কৃষক পরিবার জানতো – কতগুলো পশু এবং কি পরিমাণ গাছ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে অবশ্যই থাকা উচিত।

এই জমির শুধু একটু সামান্য সাহায্য প্রয়োজন। যদি আপনি অতি সামান্য সহায়তা করেন এটা খুব তাড়াতাড়ি উর্বর হয়ে উঠবে।

পূর্ববর্তী পরিকল্পনা কমিশন ইতিমধ্যেই একটা জাতীয় লক্ষ্য স্থির করেছিল যে ভারতের ৩৩ শতাংশ ভূমি গাছের ছায়ায় থাকবে, কারণ আপনি যদি ভূমি সংরক্ষণ চান তাহলে এটাই একমাত্র পথ। আর আমি চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছি এমন একটি আইন করার জন্য যাতে আপনার যদি এক হেক্টর জমি থাকে বাধ্যতামূলকভাবে আপনার কমপক্ষে পাঁচটি গবাদিপশু সেই জমিতে রাখতেই হবে। না হলে জমির ক্ষতি করার জন্য আপনাকে অধিকারচ্যুত করা হবে।

এই জমিতে একটি আশ্চর্য ব্যাপার আছে, যার বৈজ্ঞানিক তথ্য আমাদের জানা কিন্তু কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো নেই। যদি আপনি এদেশের এমন একটি জায়গায় যান যেখানে মাটির মান উন্নত এবং এক ঘন মিটার (cubic meter) মাটি পরীক্ষা করেন তাহলে দেখবেন যে এই মাটিতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির বেশি প্রাণী আছে। এটা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় পাওয়া প্রানের সর্বাধিক সমাবেশ। এর কারণ আমাদের অজানা। সুতরাং এই জমির শুধু একটু সামান্য সাহায্য প্রয়োজন। যদি আপনি অতি সামান্য সহায়তা করেন এটা খুব তাড়াতাড়ি উর্বর হয়ে উঠবে। কিন্তু এক প্রজন্ম হিসেবে আমাদের কি সেই সামান্য সাহায্য করার প্রয়োজনীয় বুদ্ধি আছে, না আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব আর একে শেষ হতে দেখবো?

উদাহরণ হিসেবে, কাবেরী অববাহিকা ৮৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার নিয়ে গঠিত। গত ৫০ বছরে ৮৫ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদন নষ্ট করা হয়েছে। সুতরাং আমি নদীটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে 'কাবেরী কলিং' এর উদ্যোগ নিয়েছি। কাবেরী অববাহিকার এক-তৃতীয়াংশ আচ্ছাদন করতে আমাদের ২৪২ কোটি বৃক্ষরোপণ করতে হবে। এর অর্থ ২.৪২ বিলিয়ন গাছ। এরকম নয় যে ঈশা ফাউন্ডেশন এই পরিমাণ বৃক্ষরোপণ করবে। আমরা কৃষি বনায়নের আন্দোলন করে কৃষকদের দেখাতে চাই যে এটাই তাদের জন্য সবথেকে ভাল অর্থনৈতিক উপায়।

কর্নাটকে একজন সাধারন কৃষক হেক্টরপ্রতি ৪২ হাজার টাকার কাছাকাছি উপার্জন করছেন, তামিলনাড়ুতে ৪৬ হাজার টাকা প্রতি হেক্টর। প্রথম পাঁচ বছরে আমরা পাঁচ বছরের গড় আয়কে ৩ থেকে ৮ গুণ বৃদ্ধি করতে পারি। একবার যদি মানুষ এই আর্থিক লাভ দেখতে পান, তারপর আর তাদের বোঝাতে হবে না। তারা যে কোনো ভাবে এটা করবেন। যদি সবাই তাদের এক-তৃতীয়াংশ জমিকে কৃষি বনায়নের রূপ দেন তাদের আয় অনেক বেশি বেড়ে যাবে আর মাটিও উর্বর হবে।