Mahabharat All Episodes

সদগুরু: যখন কর্ণ এসে তাঁর কলা-কৌশল প্রর্দশন করলেন, অর্জুন তৎক্ষণাৎ হস্তক্ষেপ করে বললেন, “এই ব্যক্তি কোন ক্ষত্রিয় নয়। কে তুমি? এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তোমার সাহস হয় কী করে?” ভীম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুমি কার পুত্র? এখনই বলো!” সহসা- কর্ণ, একজন আত্মবিশ্বাসী নবযুবক যিনি কিনা অর্জুনের চেয়েও সুদক্ষ, বিরাট বড় একজন তীরন্দাজ – সঙ্কুচিত হয়ে পড়লেন। তাঁরা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার পিতা কে?” তিনি বললেন, “আমার পিতা হলেন অধিরথ।” তখন তাঁরা বললেন, “ওহ্, তুমি একজন সারথীর পুত্র! আর তুমি কিনা এই ক্রীড়াঙ্গনে প্রবেশ করেছ। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও! এটা ক্ষত্রিয়দের জন্য।”

কর্ণের রাজ্যাভিষেক হল

দূর্যোধন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগটি একেবারে সামনে দেখতে পেলেন, এবং তিনি এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। তাঁর সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল যে তাঁর ভাইয়েদের মধ্যে কোন ধনুর্বিদ নেই। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে ভীমকে একদিন তিনি ঠিক পরাস্ত করবেন, তাঁর কয়েকজন ভাই মিলে নকুল আর সহদেবকেও মেরে ফেলতে পারবে, আর ধর্মের কোন একটা বিধান দিয়ে যুধিষ্ঠিরকেও একদিন তাঁরা পরাস্ত করতে পারবেন। কিন্তু অর্জুনকে নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন কারণ তাঁর সমকক্ষ কোনো ধনুর্বিদ তাঁদের ছিল না। কাজেই যখন তিনি কর্ণকে এবং তাঁর পারদর্শিতা দেখলেন- তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁকে কুক্ষিগত করলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে কর্ণের পক্ষ নিয়ে রাজার কাছে আবেদন করলেন। তিনি বললেন, “পিতা, এটা কেমন হয়? শাস্ত্রে বলা আছে একজন মানুষের রাজা হওয়ার তিনটে উপায় রয়েছে। কেউ রাজা হতে পারে – হয় রাজার সন্তান হয়ে জন্মেছে বলে, কিংবা সে তার নিজের দক্ষতা ও বীরত্ব দিয়ে কোনো রাজাকে পরাজিত করেছে বলে, কিংবা সে নিজেই একটা রাজ্য তৈরি করেছে বলে।

”কর্ণ এখন এখানে রয়েছে। কর্ণ রাজা নয় বলে অর্জুন যদি তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে না চায়, তাহলে আমি ওকে রাজা বানাব। আমাদের একটা ছোট রাজ্য আছে – অনেক দূরে, যাকে অঙ্গ বলে ডাকা হয়। অঙ্গরাজ্যে কোন রাজা নেই। অঙ্গরাজ হিসেবে আমি কর্ণের রাজ্যাভিষেক করব।” পুরোহিত আনিয়ে ওখানেই তিনি কর্ণের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করলেন। “ইনি এখন অঙ্গরাজ, অঙ্গ রাজ্যের রাজা। অর্জুন আর কারোর জন্মকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। তার পিতা কে, আমি তার পরোয়া করি না। আমি তাঁকে আমার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছি।” কর্ণকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, “তুমি আমার ভাই এবং তুমি একজন রাজা।”

এক কুটিল চক্রান্ত

কর্ণ অভিভূত হয়ে গেলেন, সারাটা জীবন ধরে তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন কারণ লোকে মনে করত তার জন্ম নীচ কূলে। আর এখানে, একজন রাজার ছেলে কিনা তাঁর পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাঁকে আলিঙ্গন করছেন এবং সাথেসাথে তাঁকে রাজাও বানিয়ে দিলেন। তাঁর আনুগত্য তাঁকে সারা জীবনের জন্য বেঁধে ফেলল। আপনি দেখবেন, এই অহেতুক আনুগত্য কিছুকাল পরে মাঝেমাঝেই সর্বনাশা মোড় নিয়েছে। এই প্রতিযোগিতার পর, একজন রাজা ও দূর্যোধনের সুহৃৎ হিসেবে কর্ণের প্রাসাদে যাতায়াত এবং শকুনির সাহচর্যে কৌরবরা আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। কর্ণের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার সাহায্যে তাঁরা আরও পারদর্শী ও একমুখী হয়ে উঠলেন। দূর্যোধন ভাবলেন পঞ্চপাণ্ডবকে শেষ করার সময় এবার এসেছে।

জনসাধারণ হয় পাণ্ডব নয় কৌরবদের পক্ষ নিতে লাগল। প্রাসাদের ভেতরে ও নগরে আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল। নগরটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল।

জনসাধারণ হয় পাণ্ডব নয় কৌরবদের পক্ষ নিতে লাগল। প্রাসাদের ভেতরে ও নগরে আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল। নগরটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ধৃতরাষ্ট্র ভাবলেন বিষয়টাকে বেশি দূর গড়াতে দিলে একটা গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে। কাউকে যেতেই হবে – স্বভাবতই তাঁর সন্তানরা নয়। তিনি ভাবলেন, পাণ্ডবদেরই যাওয়া উচিত কিন্তু এই কথাটা তিনি মুখ ফুটে বলতে চাননি। ভীষ্ম অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে গোটা পরিস্থিতি লক্ষ্য করলেন কারণ তাঁর আনুগত্য কেবল দেশের প্রতি, আর তিনি দেখলেন একটা গৃহযুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে – এখনও প্রকাশ্যে না এলেও সবার হৃদয়ে-মনে তো বটেই। ধৃতরাষ্ট্র সবচেয়ে কুটিল পরামর্শদাতাদের থেকে পরামর্শ নিলেন এবং তাঁরা সকলেই উপদেশ দিলেন যে পাণ্ডব নিধনের সময় এবার এসে গেছে।

শকুনি একটা মতলব আঁটলেন। তিনি বললেন, “ওদের কোনো তীর্থস্থানে পাঠানো হোক।” জানেন তো এদেশে বহু তীর্থস্থান রয়েছে তবে সবচেয়ে পবিত্র স্থান সবসময়েই এইটা। তিনি পরামর্শ দিলেন যে রাজা যেন তাদেরকে তীর্থ করতে কাশীতে পাঠান। যুধিষ্ঠিরকে ডেকে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “যেহেতু তোমাদের পিতৃবিয়োগ ঘটেছে আর অনেক ছোট বয়স থেকেই তোমরা নানা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ, আমার মনে হয় কোনো তীর্থস্থানে ঘুরে আসা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আমি চাই তোমরা কাশীতে গিয়ে সেখানে এক বছর শিবের পশুপতি রূপের উপাসনা করে কাটাও- তিনি হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ ও যোদ্ধা। এক বছর তাঁর উপাসনা করো এবং তারপর ফিরে এসো। ততদিনে তুমি রাজা হওয়ার উপযুক্ত হয়ে যাবে।” ইতিমধ্যেই যুধিষ্ঠির যুবরাজ পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন; যার অর্থ তিনি হলেন রাজা হওয়ার জন্য অপেক্ষারত রাজকুমার।

যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, "আমাদের পিতৃব্য চান যে আমরা যেন স্বয়ং পশুপতির কাছে গিয়ে তাঁর আশীর্বাদ লাভ করি। তিনি চান আমরা তীর্থ করতে কাশী যাই, আমাদের বয়সকালে আমরা সেটা করতামই। কিন্তু যেহেতু তিনি আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করেন তাই তিনি চান না যে এমন শুভ কাজ আমরা ভবিষ্যতের জন্য ফেলে রাখি। তিনি চান আমরা যেন এখনই তা সেরে ফেলি।" বিদ্রূপটা বুঝতে ভীষ্মের বাকি থাকল না কিন্তু দেশের প্রতি তাঁর আনুগত্যের কারণে বিষয়টা তিনি এড়িয়ে গেলেন। তিনি জানতেন যে একটা গৃহযুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে আর কৌরবদের শান্ত করা বা পাণ্ডবদের রক্ষা করার কোনো উপায়ই তাঁর কাছে নেই। কোথাও না কোথাও, তিনি মেনে নিয়েছিলেন যে অন্যত্র চলে যাওয়াই পাণ্ডবদের জন্য শ্রেয়।

জতুগৃহ

এর মধ্যে দূর্যোধন শকুনির সহায়তায় বিশদভাবে পরিকল্পনা করে নিয়েছিলেন। কাশীর কাছেই তাঁরা একটি প্রাসাদ তৈরি করলেন। বাইরেটা মাটির আস্তরণে ঢাকা এবং সুন্দরভাবে ছবি আঁকা, কিন্তু ভেতরটা ছিল সব দাহ্য পদার্থে ঠাসা, মূলত ছিল জতু, যা হল একপ্রকার রজন। পাঁচ ভাই এবার সাবধান হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা জানতেন যে তাঁদের জীবন সংশয়ের আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে কুন্তী, হিংস্র বাঘিনীর মতন তাঁর সন্তানদের সবসময় চোখে চোখে রাখছিলেন। বিদুর তাঁদের বিদায় জানাতে এলেন এবং কৌরবরাও এলেন কারণ তাঁরা প্রতিনিয়ত পাণ্ডবদের ওপর নজর রাখতে চাইছিলেন। কৌরবদের চোখে জল। এতদিনে তাঁরা শকুনির থেকে ছলচাতুরির কলা শিখে ফেলেছিলেন। বিন্দুমাত্র আবেগ ছাড়াই শকুনি যখন ইচ্ছা কাঁদতে পারতেন কারণ মানুষের কথা ও মুখের ভাবকে তিনি মানুষের মনে কী চলছে তা প্রকাশের উপায় নয় বরং তা গোপন করার উপায় হিসেবেই দেখতেন।

বিদুরের গুপ্তচরেরা পাণ্ডবদের জন্য পাতা ফাঁদের ব্যাপারে কিছু খুঁজে পেয়েছিল, কিন্তু পাণ্ডবদের সতর্কবার্তা পাঠানোর কোনো সুযোগই ছিল না কারণ কৌরবরা সবসময় তাঁদের ঘিরে রেখেছিল। কাজেই তিনি যুধিষ্ঠিরের সাথে উপজাতিদের ভাষায় কথা বললেন, যা শুধু তাঁরা দু’জনই জানতেন। “তোমাকে বুঝতে হবে যে তরবারির থেকেও আগুন আরও বেশি বিপজ্জনক অস্ত্র। একটা ইঁদুর যেমন গর্ত খুঁড়ে নিজেকে শীত থেকে রক্ষা করে, তোমাদেরও তাই করা উচিত। আমি কনাকন নামে এই ব্যক্তিকে তোমাদের সাথে পাঠালাম।” কনাকন ছিলেন একজন তামিল খনী শ্রমিক। কুয়ো খোঁড়ার ব্যাপারে ভারতবর্ষে তামিল মানুষেরা সবচেয়ে সেরার মধ্যে পড়ে, কারণ প্রথম যারা এই কাজ করেছিলেন, তারা তাদের মধ্যে অন্যতম । এমনকি আজকের দিনেও- যেখানে কোনো যন্ত্রপাতি নেই, আপনি দেখবেন তামিল লোকেরা কুয়ো খোঁড়ার কাজ করছেন।

সহদেব এক কোণায় বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তিনি পিঁপড়ের ওই যে অতটুকু খাবার-কণা খেয়েছিলেন, সেটা তাঁর দারুণ কাজে দেয়। একটা পিঁপড়ের মতো করেই তিনি সেই জায়গাটাকে দেখলেন।

পাণ্ডবরা যখন কাশীতে পৌঁছলেন, তাঁরা সেই প্রাসাদে থাকতে শুরু করলেন। দাহ্য পদার্থের গন্ধ চাপা দেওয়ার জন্য উগ্র সুগন্ধি প্রয়োগ করা হয়েছিল। যুধিষ্ঠির যখন প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন, তিনি লক্ষ্য করলেন যে প্রাসাদের চারপাশে একটা পরিখা খনন করা আছে। কিন্তু এর বাইরের দিকেই যে কেবল শলাকা গাঁথা তাই নয়, ভেতরের দিকেও শলাকা গাঁথা। তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন যে কেনই বা কেউ ভেতরের দিকে, প্রাসাদ-প্রাচীরের চারপাশে শলাকা গেঁথে রাখবে। দেখে মনে হচ্ছে, প্রাসাদের ভেতরে যারা থাকবে তারা এখান থেকে বেরোতে পারুক, এটা তারা চায় না! পাণ্ডবরা বুঝতে পারছিলেন যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে আর বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে দূর্যোধনের মতলবটা কী।

সহদেব এক কোণায় বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। তিনি পিঁপড়ের ওই যে অতটুকু খাবার-কণা খেয়েছিলেন, সেইটা তাঁর দারুণ কাজে দেয়। একটা পিঁপড়ের মতো করেই তিনি সেই জায়গাটাকে দেখলেন। একটা পিঁপড়ে বাড়ির এমন সব আনাচ-কানাচ চেনে যা বাড়ির কর্তাও চেনে না। একটা পিঁপড়ের মতই সহদেব দেওয়ালে আঁচড় কেটে অন্যদের বললেন, “এই প্রাসাদটা জতু দিয়ে তৈরি। এতে যদি আগুন লাগে, আমাদের সবার শেষ হয়ে যেতে মাত্র মিনিট খানেক বা মিনিট দুয়েকের প্রশ্ন।”

তাঁদের পালানো দরকার, কিন্তু তাঁরা সেখান থেকে চলে যেতে পারছিলেন না কারণ তাহলে তাঁদের প্রকাশ্যেই মেরে ফেলা হবে। কাজেই তাঁরা কনাকনকে একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গ খননের কাজে লাগিয়ে দিলেন। একমাস পর, নদীর তীর পর্যন্ত পুরো সুড়ঙ্গটা তিনি খুঁড়ে ফেলেছিলেন। এতদিনে দূর্যোধনের গুপ্তচর, যে কিনা প্রহরীর অভিনয় করছিল, একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে পড়েছিলেন কারণ এই মানুষগুলো ভালই খাওয়া-দাওয়া করছেন এবং তার সাথে হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজব করছেন। অভিনয় করতে তাঁরাও শিখে গিয়েছিলেন এবং সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যেতে লাগলেন, যেন প্রাসাদটা তাঁরা খুবই উপভোগ করছেন। তারপর, এক পূর্ণিমার রাতে তাঁরা এক ভোজসভার আয়োজন করলেন।

চলবে…

More Mahabharat Stories

Editor’s Note: A version of this article was originally published in Isha Forest Flower August 2016. Download as PDF on a “name your price, no minimum” basis or subscribe to the print version.