সদগুরু কর্মযোগ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব, আধ্যাত্বিক পথে এর ভূমিকা এবং কীভাবে একজন সাধক কর্মকে আধ্যাত্মিক বিকাশের উপায় হিসাবে ব্যবহার করে চলতে পারেন সে ব্যাপারে আলোচনা করছেন।

প্রশ্ন: সাধনায় কর্মযোগের ভূমিকা কী?

সদগুরু: আসলে এর কোন প্রয়োজন নেই। যোগে কর্মের প্রয়োজন নেই। কর্মের সীমা অতিক্রম করার জন্যই যোগ। মানুষের মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্য কর্মের উপস্থাপনা করা হয়েছে। আমাদের সচেতনতা, ভালোবাসা, আমাদের অনুভূতি বা বাস্তব জগতের ঝলকগুলো যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে নিষ্ক্রিয়কর্মের পথ খুবই চমৎকার একটা পথ, কিন্তু এটা অত্যন্ত পিচ্ছিল। ভীষণ রকমের পিচ্ছিল। এটা সবচেয়ে সহজ আবার সবথেকে বেশি শক্ত। এটা দুঃসাধ্য না হলেও সহজ মোটেই নয়; কারণ এটা সরল - এখনই, এখানে এবং এখন। কিন্তু ওই 'এখানে' এবং 'এখন' - কী করে পাওয়া যায়? আপনি যাই করুন না কেন এটা আপনার হাতে নেই। এটা কখনোই আপনার হাতে আসবে না। কিন্তু এক্ষুনি আপনার হাতে কিছু একটা চাই, আপনার কিছু একটা ধরবার প্রয়োজন। আর সেই জন্যই কর্মযোগের এই 'সহায়ক লাঠি' বা 'ক্রাচ'।

এই লাঠি বা 'ক্রাচের' অবলম্বন ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই হাঁটতে পারবেন না। অল্প কয়েকজন মানুষ আছেন যাঁরা প্রথম মুহূর্ত থেকেই এই অবলম্বন ছাড়া হাঁটতে সক্ষম। তাঁরা খুবই দুর্লভ মানুষ। অন্য সকলেরই তাদের সচেতনতা সামলানোর জন্য এই লাঠির প্রয়োজন। বেশিরভাগ মানুষই এটা ছাড়া সচেতন থাকতে অক্ষম। তাই সঠিক প্রকারের কর্মের মাধ্যমে আপনার সাধনাকে উপযুক্ত সুরে বাধতেই আপনার জীবনে কর্মযোগকে নিয়ে আসা।

কাজকর্ম - মুক্ত করে নাকি বেধে দেয়

দুর্ভাগ্যবশত কর্মযোগকে পরিষেবা হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে, কিন্তু এটা তা নয়।

দুর্ভাগ্যবশত কর্মযোগকে পরিষেবা হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে, কিন্তু এটা তা নয়। আপনি যে সমস্ত সংস্কার সঞ্চিত করেছেন সেগুলো মুছে ফেলবার এটা হল একটা উপায়। আপনি যদি আনন্দময় হয়ে যেকোনো কাজকর্মে লিপ্ত হতে পারেন তাহলে সেটা হলো কর্মযোগ। আর আপনি যদি প্রচন্ড বলপ্রয়োগের সঙ্গে এটা করেন তাহলে সেটা শুধুই কর্ম হবে, কোন যোগ হবে না!

সাধারনত আপনি যেসব নানান কাজকর্ম করেন সেগুলোর মাধ্যমে আপনি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং তার জালে আটকা পড়েন। কিন্তু আপনার কাজকর্ম যদি বন্ধন সৃষ্টিকারী না হয়ে একটি মুক্তিদায়ী প্রক্রিয়া হয়, তাহলে সেটা কর্মযোগ। সেটা কোন কাজ হোক বা রাস্তায় হাঁটা হোক বা কারও সঙ্গে বার্তালাপ হোক - কর্মের রকমটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি যখন কোনকিছু করেন শুধুমাত্র সেটা হওয়ার দরকার আছে বলে, যেখানে আপনার কাছে তার কোনো মূল্যই নেই অথচ আপনি এমনভাবে এতে লিপ্ত হতে পারেন যেন এটাই আপনার জীবন - তখন এটা আপনার রূপান্তর ঘটায় এবং কর্ম হয় মুক্তিদায়ী।

যখন আমরা ধ্যানলিঙ্গ নির্মাণ করছিলাম, লোকজন ভেবেছিলেন, "এটাই সেই কাজ! তিনি চান এটি সুসম্পন্ন হোক। চলো সবাই মিলে এটা করি! একবার এই কাজ শেষ হয়ে গেলে আমরা আরাম করতে পারব।" তারা এমনভাবে কাজ করেছিলেন যেন এর ওপরেই তাদের জীবন নির্ভর করে। তারা দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছিলেন, অর্থ সংগ্রহ করে ও প্রয়োজনীয় সাহায্য নিয়ে এটা গড়ে তুলতে। যখন এটা হয়ে গেল, তারা "উফ্…." বলবার আগেই আমি দশটা ভিন্ন প্রকল্প ঘোষণা করলাম। আমি সবসময়ই এটা চালু রাখব কেননা মানুষের এইরকম কর্মের প্রয়োজন। নিজেদের পরিতোষ বা পছন্দ-অপছন্দের কথা চিন্তা না করে, যেটা করার প্রয়োজন আছে তাদের সেটাই করা দরকার। এমনিতেও আমরা যখন নিজেদের বিকাশের জন্য কিছু না কিছু করছি, তাহলে আমরা এমন কিছু করি - যা সকলের কাজে লাগে। আসুন বুদ্ধি- সঙ্গত কর্ম করা যাক।

পুরোপুরি লিপ্ত থাকা

এমন কিছু করা যা আপনার কাছে কোন গুরুত্ব রাখে না অথচ সম্পূর্ণরূপে লিপ্ত হয়ে সেরকম কোন কাজ করাই ভেঙে দেয় কার্মিক কাঠামোকে

অনেক গুরু ছিলেন যারা এইরকম কর্মের সৃষ্টি করেছিলেন। যখন গুরজিফ ইউরোপে তাঁর কেন্দ্রগুলো শুরু করেছিলেন তখন ইউরোপীয় অভিজাত সম্প্রদায় তার কাছে যেত। সকাল সকাল তিনি তাদের একটা বেলচা আর কোদাল দিয়ে বলতেন, "পরিখা খোঁড়।" চড়া রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে তারা খুঁড়তেই থাকতো। এরা সেই ধরনের মানুষ ছিলেন না যারা কোনও রকমের পরিশ্রমে অভ্যস্ত। কয়েক ঘন্টা কাজ করতে না করতেই, তাদের সর্বত্র ফোস্কা পড়ে যেত। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের চালনা করতেন। সন্ধ্যা নেমে এলে তারা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ত, কিন্তু তারা কাজ করেই চলত - পরিখা খোঁড়ার কাজ। তখন তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলতেন, "বেশ, এখন সাতটা বাজে। মনে হচ্ছে নৈশভোজের সময়। আপনারা সকলে নৈশভোজে যাওয়ার আগে পরিখাগুলো আবার বন্ধ করে ফেলুন।" পুরো একটা দিনের কাজ!

এমন কিছু করা যা আপনার কাছে কোন গুরুত্ব রাখে না অথচ সম্পূর্ণরূপে লিপ্ত হয়ে সেরকম কোন কাজ করাই ভেঙে দেয় কার্মিক কাঠামোকে। কর্ম মানে কাজ। কাজকে যদি যোগে পরিণত করতে হয়, তাহলে কাজকে মুক্তিদায়ী হতে হবে। যদি আপনার কার্যকলাপ আপনার বন্ধনের একটা প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা কর্ম। কাজেই প্রশ্ন এটা নয় যে আপনি কতটা কাজ করছেন। আপনি কীভাবে আপনার কাজ সম্পাদন করছেন, তফাৎটা হলো সেইখানেই। যদি আপনি নিজের কাজকে যুঝতে থাকেন, তাহলে সেটা কর্ম। আর যদি আপনি কাজের মধ্যে দিয়ে সানন্দে নৃত্যের মতো করে যান, তাহলে সেটা কর্মযোগ।

Editor’s Note: Get the latest updates from the Isha Blog. Twitter, facebook, rss or browser extensions, take your pick.