এ যে আনন্দের একটি বহিঃপ্রকাশ –

সদগুরু: বহুদিন থেকেই মানুষ বলে আসছেন যে, হাসিই হল শ্রেষ্ঠ ওষুধ। কোথাও কেউ এটা বুঝেছিলেন যে, আনন্দে ভরপুর মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই নিজেদের নিরাময় করে তোলেন। আপনি সুস্থ না অসুস্থ, সে প্রশ্নটা নির্ভর করে, কতটা দক্ষতার সঙ্গে আপনার শরীর কাজ করে চলেছে, তার উপর। এটা যদি সুন্দর ভাবে কাজ করে চলে, তাকে আমরা বলি স্বাস্থ্য, তা যদি না হয়, তাকে আমরা বলি অসুস্থতা। আপনি যখন আনন্দে থাকেন, আপনার ভৌত দেহটি সবচেয়ে ভাল ভাবে কাজ করতে থাকে। তাই তখন এটার ভাল থাকা খুব স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এটা এমন নয় যে, হাসি আপনার রোগ নিরাময় করে; যেটা আপনাকে আরোগ্য করে, তা হল আনন্দ, কিন্তু হাসি গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে আনন্দের সঙ্গে। 

আনন্দের অর্থ হাসি নয়। সম্ভাব্য সব রকম ভাবেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে – কোনও একটি নির্দিষ্ট ভাবেই হতে হবে, সেটা জরুরী নয়।

হাসি আবার বন্ধনেও পরিণত হতে পারে। যদি আপনি এটা বিশ্বাস করেন যে,আনন্দের অর্থ হল,আপনাকে সব সময় “হাহাহা” হয়ে থাকতে হবে, তাহলে আপনি অত্যন্ত হাস্যকর হয়ে উঠবেন, কারণ কোনও একটি পরিস্থিতির গভীরতা ও মাত্রাকে না বুঝে, সব রকমের পরিস্থিতিতেই আপনি “হাহাহা” করবেন। আনন্দের অর্থ হাসি নয়। সম্ভাব্য সব রকম ভাবেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে – কোনও একটি নির্দিষ্ট ভাবেই হতে হবে, সেটা জরুরী নয়। একটি বহিঃপ্রকাশ হতে পারে হাসি, নীরবতা হতে পারে আর এক রকমের বহিঃপ্রকাশ। আনন্দ আপনার মধ্যে স্তব্ধতা নিয়ে আসতে পারে অথবা আপনাকে ক্রিয়াশীলও করে তুলতে পারে, বা আপনার চোখদুটিকে কান্নার অশ্রুতে ভরেও দিতে পারে।

যদিও, যিনি বুদ্ধ নামে পরিচিত, সেই গৌতম ছিলেন আনন্দের নিখাদ প্রতিমূর্তি, কেউই কিন্তু তাকে কোনও সময়ই হাসতে দেখেনি। না তো তিনি কখনও সশব্দে হেসেছেন, না কখনও স্পষ্ট করে স্মিত হাসি হেসেছেন; এমনকি তার স্মিত হাসিটাও খুব ছোট্ট ছিল। আনন্দের অর্থ মৃদু হাসি বা অট্টহাসি হতেই হবে, তা নয়। আনন্দের অর্থ হল আপনি জীবনের মর্মস্থলে রয়েছেন। যেই মুহূর্তে আপনি এটাকে একটি নির্দিষ্ট প্রকাশভঙ্গির দাস করে ফেলবেন, তখনই আপনি নিশ্চিত করে ফেললেন যে, আপনার আনন্দ সপ্তাহ ভর চব্বিশ ঘন্টা ব্যাপী স্থায়ী হতে পারবে না। 

 

 

হাসির অর্থ কি

আনন্দের মূলগত অর্থ হল, জীবনের গভীরে আপনি স্থিত হয়ে আছেন, উপরিভাগে নয়। একেবারে উৎসের সংস্পর্শে আছেন আপনি, তাই আপনি নিজেই আনন্দের প্রতীক। মানুষ সব সময়ই ভিন্ন পথে এর কাছাকাছি আসতে চায়। কেউ কেউ ভাবেন যে, মদ্যপানই হল আনন্দ, অন্য কেউ ভাবেন যে, হাসিটাই হল আনন্দ। হাস্যরত মানুষের একটি সমাজও রয়েছে। রাস্তার সর্বত্র তারা যেন “হাহাহা” করে হাসতেই থাকেন! শুরু-শুরুতে এটা মজাদার হতে পারে, কিন্তু যদি আপনাকে এরকম কারো সাথে থাকতে হয় যে সব সময় অট্টহাসি হেসে চলেছে, একদিন আপনি তাকে মেরে ফেলতে চাইবেন, শুধুমাত্র তার অট্টহাসিকে থামানোর জন্য। 

হাসি হল আনন্দেরই একটি পরিণাম

আজকাল এক তুচ্ছ ও দুঃখজনক ধরনের “যোগ” করা হচ্ছে, যাকে বলা হয় হাস্য যোগ । আমরা দুজনে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালাম এবং আপনি বললেন, “হেহেহে”, আমি বললাম, “হেহেহে”। এটা নিছক পাগলামি। সম্প্রতি আমি পড়ছিলাম, আমেরিকার কিছু নকলনবিশ শিক্ষক পরামর্শ দিচ্ছিলেন যে, দিনের মধ্যে দশ মিনিট আপনাকে হাসতেই হবে... এমন হলে খুব শীঘ্রই আপনি মানসিক চিকিৎসা বিভাগে থাকবেন!

দেখুন, আপনি যদি নিজের বাগানে ফুল চান, নিশ্চয়ই প্লাস্টিকের ফুল কিনে সেগুলোকে বাগানে লাগাবেন না। ফুলের মতো দেখতে নয় এমন কিছু আপনাকে করতে হবে – অর্থাৎ আপনাকে মাটি, সার, জল, সূর্যের আলো - এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। এগুলোর কোনওটাই দেখতে ফুলের মতো নয়, ফুলের অনুভূতি দেয় না, গন্ধটাও ফুলের মতো নয়, কিন্তু এগুলোকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে, ফুল এমনিই ফুটবে। সুতরাং, “প্রতিদিন আমাকে হাসতেই হবে” এভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেই যে হাসি আসবে, তা নয়। যদি আপনি নিজের ভিতরে এক ধরনের মনোরম অনুভূতির অবস্থায়ে থাকেন, তা হলে দেখবেন তার কারণ না জেনেও আপনার মুখে এক স্মিত হাসি ছড়িয়ে পড়বে। সামান্য পুলকিত হলেই আপনি হেসে পড়বেন। হাসি হল একটি পরিণাম। পরিণামকে সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেন না। যেটা আসল উৎস, সেই পদ্ধতির উপরে কাজ করুন।

যদি আপনি নিজের ভিতরে এক ধরনের মনোরম অনুভূতির অবস্থায়ে থাকেন, তা হলে দেখবেন তার কারণ না জেনেও আপনার মুখে এক স্মিত হাসি ছড়িয়ে পড়বে।

আনন্দ সেরকম কিছু নয় যে, আপনাকে হাতে কলমে সেটা করতে হবে। যদি আপনি নিজের ভিতরে জীবনের মৌলিক ধারাটিকে ব্যাহত না করেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই তার ফলশ্রুতি হবে আনন্দ। আনন্দ অর্জন করার মতো কিছু নয়, আনন্দ হল আপনার স্বাভাবিক অবস্থা। যোগ-এ আমরা ব্যক্তি মানুষকে পাঁচ রকমের শরীরের স্তর হিসেবে দেখি – অন্নময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ এবং আনন্দময় কোষ। এই “আনন্দ” শব্দটিকে যদি সাধারণ আনন্দের অর্থে ধরে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে আপনার গভীরতম উৎসটিই হল আনন্দ। শরীরের প্রথম তিনটি মাত্রা হল ভৌতিক শরীর, মানসিক শরীর এবং প্রাণশক্তিরুপী শরীর। এগুলোর পরস্পরের মধ্যে সঠিক সামঞ্জস্য থাকলে আপনার ভিতরের গভীরতম স্তর - সেই পরম আনন্দময়ভাবটি সহজেই প্রকাশিত হবে প্রাকৃতিক নিয়মেই।