সদগুরু: আপনার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে, আপনি যাই করুন বা না করুন, আপনার কর্ম ক্রমশ বিলীন হয়ে চলেছে। জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটাই মূলত কর্ম বিলীন করার প্রক্রিয়া। আপনার একটা নির্দিষ্ট পরিমান বরাদ্দ কর্ম আছে, যাকে আমরা প্রারব্ধ বলি। এই প্রারব্ধ কর্ম নিজের গতিতে ক্ষয় হয়ে চলেছে। কিন্তু সমস্যাটা হল, নতুন কর্ম তৈরির কারখানাটা জোরে চলছে — নতুন কর্ম এত দ্রুত জমা হচ্ছে যে বিলীনের গতি তার তুলনায় খুব ধীর। উদাহরণস্বরূপ, আপনার দৈনন্দিন জীবনে, আপনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে কাজগুলি করেন তার সঙ্গে তুলনা করে দেখলে, আপনি যতটা কাজ করেন, তার চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ গুণ বেশি চিন্তা করেন। আমি আসলে খুব সংযতভাবে "পঞ্চাশ" বলছি। আপনি যতটা কর্ম ক্ষয় করতে পারছেন, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি নতুন কর্ম তৈরি করে ফেলছেন। এটা একেবারে অতিরিক্ত ক্যালোরি খাওয়ার মতো — আপনি যদি ৬০০ ক্যালোরি খরচ করেন কিন্তু ৬০০০ ক্যালোরি খান, তাহলে সেটা তো শরীরে জমবেই।

নিজের কর্ম তৈরির ফ্যাক্টরি বন্ধ করুন

ধরুন আপনি কোনো কর্ম করলেন না – নিষ্কর্ম – আপনি শুধু চুপচাপ বসে রইলেন। এর মানে, পুরনো কর্ম যেমন ছিল তেমনভাবেই ক্ষয় হচ্ছে, কিন্তু আপনি নতুন কোনো কর্ম তৈরি করছেন না। এইকারনেই আধ্যাত্মিক পরিবেশ এমনভাবে তৈরী করা হয় যে আপনি কখন খাবেন সেটা নিজেকে ঠিক করতে হয় না। একটা ঘন্টা বাজে, আপনি শুধু যান আর খেয়ে নেন। কী খাবেন সেটাও নিজেকে ঠিক করতে হয় না। যা পরিবেশন করা হয়, আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেন। এখানে কোনও কিছু বেছে নেওয়া নেই। আমরা খাবারকে উপভোগ করার বিরুদ্ধে না, কিন্তু শুধু এই খাওয়ার কাজটার জন্যই মানুষ কত কিছু ভাবেন, কত ইচ্ছা করেন, চিন্তা করেন, তার ফলে কত কর্ম তৈরি হয়ে যায়! শেষ পর্যন্ত আপনি তো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণই খেতে পারেন। খাবারটা যদি ভালো হয় আর আপনার খুব পছন্দের হয়, তাহলে হয়ত ৫% বেশি খেলেন। ১০%এর বেশি গেলে, মুস্কিলে পড়বেন। খাবার খাওয়ার মতন সামান্য কাজের জন্য মানুষের মাথায় কতকিছু চলছে! আমি নিজেও খাবার খুব উপভোগ করি, কিন্তু খাবারকে উপভোগ করুন জিভে আর পেটে। বা যদি রাঁধতে ভালোবাসেন, তবে কড়াইতে উপভোগ করুন। আমি রান্না করতে ভালোবাসি তাই আমি কড়াইতে উপভোগ করি। যদি খাবারটা পছন্দ হয় তবে জিভে আর পেটে উপভোগ করি। কিন্তু আপনি সেটা করছেন মাথার ভেতরে – মাথা খাবার রাখার জায়গা নয়। মাথা আর খাবার একসঙ্গে চলে না – আপনি সেখানে কর্ম সৃষ্টি করছেন।

অনুগ্রহ করে জীবনের প্রতিটি দিককে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখুন। প্রতিদিন আপনি যতটা কর্ম ক্ষয় করছেন, তার পঞ্চাশ থেকে একশো গুণ বেশি কর্ম আপনি তৈরি করে ফেলছেন। যখন আপনি রান্না করেন, অথবা আনন্দের সঙ্গে খেয়ে তা হজম করে নিজের দেহের অংশ করে তোলেন — তখন আপনি কর্ম ক্ষয় করছেন। জীবনের এই সহজ স্বাভাবিক প্রবাহই আসলে কর্ম ক্ষয় করে।


 

আধ্যাত্মিক পথের অর্থ হল, আমরা আপনার কর্মের প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি। আমরা বরাদ্দ ভারের চাইতে আরও বড় কর্মের ভার বহন করতে চাইছি, কারন আমরা বারবার ফিরে এসে একই কাজ করতে চাই না। আমরা চাই এখনই সব শেষ হয়ে যাক। এই জিনিসটা সকলকে সচেতনভাবে ঠিক করতে হবে – আপনি কি এটা ধীরে ধীরে নিঃশেষ করতে চান নাকি এইসব ছাইপাঁশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে চান।

যদি আপনি একটি সক্রিয় আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেন, হঠাৎ করে আপনি দেখতে পাবেন সবকিছু এক বিস্ময়কর গতিতে এগোচ্ছে। দেখতে পাবেন, আগের চেয়ে অনেক বেশি সমস্যায় পড়ছেন। আগে, ছয়মাসে একবার আপনি ঝামেলায় পড়তেন। এখন, প্রত্যেক ছয়ঘন্টায় আপনি গভীর সঙ্কটে পড়ছেন, কারন আপনার কর্ম-প্রক্রিয়া খুব দ্রুত এগোচ্ছে। শুধু যাঁরা নিজেদের জীবনের বাস্তবতা থেকে পৃথক করে রেখেছেন সেই মূর্খরা মনে করেন আধ্যাত্মিকতা মানে শান্তিপূর্ণ হওয়া। না। আধ্যাত্মিক হওয়া মানে জ্বলন্ত হওয়া – ভিতরে, বাইরে, সর্বত্র। মারা যাওয়ার পর শান্তি আসবে। এখনই হল উচ্ছ্বাসে ভরা জীবনের সময়! আপনি যদি পরমানন্দে থাকতেন, বা খুব আনন্দপুর্ণ আর খুশি থাকতেন, তাহলে কি শান্তিপূর্ণ হওয়ার বিষয়ে ভাবতেন? এমন চিন্তা আপনার মনেও আসত না।

কর্মের স্প্রিং

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজকাল মানবজাতি জীবনকে কতটা গভীরভাবে অনুভব করা যায়, সেটার দিকে তাকাচ্ছে না—বরং শুধু জীবনকে কতটা দীর্ঘ করা যায়, সেটাই খুঁজছে। এইকারনে, অনেক মানুষ একটা সময়ের পর, তাঁদের স্মৃতি আর মানসিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন, এবং এইসব অসুস্থতার পিছনেও কর্মের প্রভাব খুবই স্পষ্ট।

আজ আমরা কর্মের সূক্ষ্ম স্তরটির যত্ন না নিয়ে শুধুমাত্র শারীরিক জীবনের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর চেষ্টা করছি, কারণ আমাদের এখন জৈব রসায়নের উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এসেছে।

কর্ম হল এক নির্দিষ্ট ধরনের সফ্টওয়্যার যেটা আপনি অচেতনভাবে সৃষ্টি করেছেন। আপনার জন্মের আগে, গর্ভধারণের ৪০ থেকে ৪৮ দিনের মধ্যে এই কর্মের তন্তু নিজেকে স্প্রিংয়ের মত পাকাচ্ছিল। পূর্বের যা তথ্য, আপনার দেহের ক্ষমতা, আপনার মা-বাবার প্রকৃতি, গর্ভধারণের প্রকার, এবং আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে এটা একটা নির্দিষ্ট পরিমান তথ্যকে স্প্রিংয়ের মত পাকিয়ে ফেলে। এটা একটা পাকানো স্প্রিংয়ের মতন। আপনি যদি শুধু বসে থাকেন, এটা ধীরে ধীরে নিজেকে উন্মুক্ত করে ফেলবে। যত স্থির হয়ে বসবেন, তত তাড়াতাড়ি এটা উন্মুক্ত হবে, কিন্তু আপনি কাজ নিয়ে আর নতুন নতুন কর্ম জোগাড় করতে ব্যস্ত, তাই এটা একটা নির্দিষ্ট গতিতে উন্মুক্ত হচ্ছে। কারুর জন্মের সময় তার কর্মের তন্তুর টান কতটা, সেটা দেখে আমি সহজেই বলে দিতে পারি সেই শিশুটি আনুমানিক কত বছর বাঁচবে – যদি কোনও মদ্যপ গাড়ি চালক তাকে চাপা না দেয়, বা সে কোনও আধ্যাত্মিক গুরুর সংস্পর্শে না আসে! যদি সে একটা সাধারণ জীবন-যাপন করে, তবে সে কত বছর বাঁচবে সেটা আমরা বলতে পারি। আমরা জানি কুণ্ডলীটি নিজেকে একটা নির্দিষ্ট গতিতে উন্মুক্ত করবে।

একটা সময়ে ভারতে কোনো শিশুর জন্ম হলে পরিবার যা সবার আগে করত, তা হলো — কোনো যোগী বা সাধুকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো, অথবা শিশুকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া, যাতে সেই জ্ঞানী ব্যক্তি শিশুটির জীবন সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন। আজও কিছু ক্ষেত্রে এই প্রথা আছে, তবে সাধারণত জন্মদিনের পার্টি এসবের জায়গা দখল করে নিয়েছে। নয়ত, এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আপনি আপনার সন্তানকে এমন একজন মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চাইতেন যিনি দেখতে পারেন — শিশুটির ভিতরে কর্মসূত্র অতিরিক্ত টানটানভাবে পেঁচিয়ে আছে কি না, এবং যিনি প্রয়োজনে সেটা শিথিল করে শিশুটির মঙ্গলের ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু তবুও, কোনও মাতাল গাড়িচালক তাকে চাপা দিয়ে দিতে পারে। অথবা, কোনো গুরু তার কর্মের ধাগা খুব দ্রুত খুলে দিতে পারেন, কিংবা বহু জন্মের কর্ম তার বর্তমান জীবনের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন। সাধারণভাবে কর্মসূত্র একটি নির্দিষ্ট গতিতে খুলতে থাকে, কিন্তু কখনো কখনো এমন কিছু ঘটে, যার ফলে সেটা আবার জট পাকিয়ে যায়, বা খুব দ্রুত খুলে যায়। নির্দিষ্ট কোনও কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটতে পারে।


 

আজকাল আমাদের জৈব রসায়নের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এসেছে তাই মানুষ শুধু শারীরিক আয়ু বাড়ানোর দিকেই নজর দিচ্ছে, কিন্তু অন্তর্নিহিত কর্ম তন্তু উন্নত করার কোনও চেষ্টা করছে না। ওষুধ, অস্ত্রোপচার এসব দিয়ে আমরা শরীরকে কৃত্রিমভাবে টিকিয়ে রাখছি। এই কারণেই বহু মানুষ বয়স বাড়লে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন, তাদের চিন্তা-শক্তি লোপ পেতে থাকে, তখন শরীরটা শুধু একটা “বোকা কম্পিউটার” হয়ে যায় – আপনি যা-ই বলুন, কোনও সাড়া দেবে না, সফটওয়্যার অর্থাৎ কর্মের বন্ধন শেষ কিন্তু হার্ডওয়্যারটা এখনও চালু রাখা হয়েছে—কখনও নতুন হার্ট লাগিয়ে, কখনও কিডনি বদলে।

যদি তারা জীবনের অন্য মাত্রাটাকেও সমৃদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করতেন, এবং শারীরিকতার বাইরে সামান্য কিছু আধ্যাত্মিক সাধনাও করতেন—তাহলে হাজার বছর বাঁচলেও প্রয়োজনীয় 'সফটওয়্যার' তৈরি করা যেত। কারণ আরেকটা বিশাল ভাণ্ডার আছে, যেটা এখনো খোলা হয়নি—এটাই হল সঞ্চিত কর্মের ভাণ্ডার।

অথবা আপনি নিজেকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করতে পারতেন, যাতে 'সফটওয়্যার' শেষ হয়ে গেলে আপনার কাছে নিজের 'হার্ডওয়্যার'—অর্থাৎ দেহটাকেও ত্যাগ করার স্বাধীনতা থাকে।

karma-book-blog-banner

Editor's Note: সদগুরুর অন্তর্দৃষ্টির সমৃদ্ধ ভাণ্ডার রয়েছে “অফ মিস্টিকস অ্যান্ড মিস্টেইকস” বইটিতে।

এই বইয়ের এক ঝলক দেখতে বা ই-বুক সংস্করণটি সংগ্রহ করতে ভিজিট করুন ঈশা ডাউনলোডস|