আপনার ভূত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ আপনার ওপরই লেখা আছে

সদগুরু: কর্মকে এইভাবে দেখা যেতে পারে যে এটি আপনার শরীর, মন, আবেগ এবং অন্তরীন শক্তির মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতির অবশিষ্টাংশ। যতরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এটি সেই সবকিছুর স্মৃতির অবশেষ। আপনার একটা বিরাট অংশ আছে, যার অস্তিত্ব ব্যক্তি হিসেবে আপনার অস্তিত্ত্বের থেকেও অনেক অনেক বেশি সময় ধরে আছে। এটা বোঝবার জন্য আপনাকে পুনর্জন্মের আশ্রয় নিতে হবে না। আপনি যদি আধুনিক পরিভাষাও ধরে চলেন, তাহলেও এটা সত্য যে জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যা বললে এটাই বোঝায় যে আপনার মাতাপিতা আপনার মধ্যে দিয়ে এখনো বেঁচে আছেন। আপনিই শুধু বিশ্বাস করেন যে আপনি অন্যরকম। অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই এরকম হয়, তারা ৪০ - ৪৫ বছর বয়স হতে না হতেই খুব বেশি রকম ভাবে তাদের বাবা-মার মত আচরণ করতে শুরু করেন, যদি না তারা নিজেদের জন্য সচেতনভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন পথ নির্ধারণ করে থাকেন। আপনার বাবা-মা কোন এক নির্দিষ্ট ভাবে তাঁদের নিজেদের জীবন যাপন করেছেন, কিন্তু আপনাকেও কেন সেই একই ভাবে চলতে হবে?

<কর্ম মানে আপনি কি করলেন, বা না করলেন শুধুই সেটা নয়, এটা হল স্মৃতির অবশিষ্টাংশ। কর্মের শুরু একেবারে সেই সৃষ্টির আরম্ভ থেকেই । আপনি যদি চেতনা দিয়ে আপনার শরীরকে বিভক্ত করেন, আপনি যদি যথেষ্ট সচেতন হন, তাহলে আপনি এমনকি সৃষ্টির প্রারম্ভও পরিষ্কার দেখতে পাবেন। প্রত্যেকটি জিনিস যা কখনো না কখনো ঘটেছে, আক্ষরিক অর্থে সে সবই আছে প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই, বিশেষ করে মানব-তন্ত্রের মধ্যে। আমরা এটা অনুভূতি দিয়ে জানতে পারি । 

আজকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে একটা ‘সিকোয়া’ গাছ কেটে দেখলে বিজ্ঞানীরা বিগত 3000 বছরে যা কিছু ঘটেছে সবই প্রায় পড়ে ফেলতে পারেন - কতটা পরিমাণ বৃষ্টি-তুষারপাত, কত তাপমাত্রা, কত অগ্নিকাণ্ড, কত বিপর্যয়, সমস্তকিছু । এটা এমন যেন কেউ আপনার হাত দেখছে আর আপনার ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিচ্ছে। এটি বহুরকম ভাবের ইঙ্গিত বহন করে। 

আমি আপনার হাত দেখেই আপনার জীবনে কি ঘটেছে আর কি ঘটতে পারে তা বলে দিতে পারি। এটা আপনার হাতে ফুটে উঠল কি করে? আসলে, এ আপনার সর্বাঙ্গে প্রকাশিত হয়। আমি আপনার শরীরের যে কোন অংশই যদি দেখি, বিশেষত সেই অংশগুলো যেগুলো অন্যান্য অংশের থেকে বেশি ইঙ্গিতবাহী, আমি আপনার ভূত ভবিষ্যৎ বলে দেবো। আমি যদি আপনার কানের পেছনটা এক ঝলক দেখি আমি আপনাকে প্রায় সমস্ত কিছু বলে দেব - না আমি ঠাট্টা করছি না। আমি যদি কোনও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাই তাহলে আমি কোন স্থানীয় ভ্রমণ গাইড বা অন্য কাউকে এটা জিজ্ঞাসা করি না যে এই জায়গাতে কি ঘটেছিল। আমি যেটা করি সেটা হল একটা এমন পাথর খুঁজি যা বহুকাল একই জায়গায় স্থির ভাবে পড়ে আছে। আমি শুধু সেই পাথরের সঙ্গে বসি, আর সমস্ত জায়গাটাকে জেনে যাই, কারণ এমনকি পাথরেও তার চারপাশে যা ঘটেছে সে সবেরই স্মৃতি রয়েছে । 

এই গ্রহে বিভিন্ন রকমের বস্তু বিভিন্ন রকমের স্পন্দন ছাড়িয়ে দিচ্ছে, আর এই স্পন্দন গুলো এই গ্রহের অবস্থান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। এই সব কিছুরই পরিমাপ করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো সত্যিই কি অর্থ বহন করছে তা এখনও পরিষ্কারভাবে উদ্ধার করা যায়নি । প্রতিটি পাথর, প্রতিটি নুড়ি কিছু বলছে -এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানও এটুকু সম্পর্কে পরিস্কার। আপনার বুঝতে পারার জন্য কি সেটা যথেষ্ট স্পষ্ট, কিংবা তারা কি বলছে জানবার জন্য আপনি কি যথেষ্ট সংবেদনশীল? প্রশ্ন সেটাই। কারণ আপনি যদি জানতে চান কেউ কি বলছে, আপনাকে তাদের ভাষা জানতে হবে, সেই ভাষা সম্পর্কে আপনাকে যথেষ্ট সংবেদনশীল হতে হবে, নাহলে আপনি জানতে পারবেন না। ওরা সবাই কত কিছু বলে চলেছে - কে রয়েছে শোনবার জন্য?

 

আপনার শরীর একটি ক্ষুদ্রাকৃতি ব্রহ্মান্ড

আপনি যদি আপনার চারপাশের জীবনের প্রতি সংবেদনশীল হন, আপনি অনুভব করতে পারবেন তারা কি বলছে। সর্বোপরি, আপনি যাকে "আমি" বলছেন, সেই জীবনটার প্রতি যদি সংবেদনশীল হন, সৃষ্টির আদি থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছুই রয়েছে, ঠিক এই ভৌত শরীরটাতেই – কারণ এ নিজেই একটা ছোট্ট ব্রহ্মাণ্ড – সেজন্য একে বলা হয় "অণুবিশ্ব"। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঠিক এরই বিস্ফারিত সংস্করণ-এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু ঘটেছে, সে সবই এখানে ঘটেছে, খুব সূক্ষ্মমাত্রায়, এবং এখনও ঘটে চলেছে।

আমি কেন বলছি "এটা ঘটে চলেছে" তার কারন এটা খুব শিশুসুলভ ধারণা যে সৃষ্টি ঘটেছিল, আর এই সৃষ্টির প্রক্রিয়া ঘটেছিল ছয় বা সাত দিনে, কারণ সৃষ্টি এমন একটা জিনিস নয় যেটা ঘটেছিল; এটা ঘটে চলেছে। সময়ের ধারণাটা নিজেই একটা শিশুসুলভ ধারণা; "দশ লক্ষ বছর আগে" বলে কিছুই হয় না। যিনি এই সৃষ্টিকে যথেষ্ট খুঁটিয়ে দেখেন, তাঁর কাছে সবকিছু আছে এখনই, সবকিছুই এইখানে। তাহলে কোথায় সেই "এইখানে?" সেটা কি আপনি ঠিক এখন যেখানে বসে আছেন সেখানে? না। এটা এখানে আপনার অন্তঃস্থলে, কারণ এটাই একমাত্র জায়গা যেটা আপনি উপলব্ধি করতে পারেন। আমি চাই আপনি জানুন, এই অস্তিত্বে এটাই একমাত্র জায়গা যা আপনার কাছে উদঘাটিত। আর কিছু, আপনার কাছে কখনো উদ্ঘাটন করা হয়নি; অনেক প্রচেষ্টার প্রয়োজন, যেটা যেরকম তাকে ঠিক সেভাবেই দেখতে পেতে হলে , সেই ভাবে দেখা নয় যেভাবে আপনার চোখের দৃষ্টির মাধ্যমে সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

কাজেই কর্ম একটা সাধারন শব্দ নয়। আমরা যখন বলি, "এটা আপনার কর্ম,"এর মানে হল বিগব্যাং বা মহা বিস্ফোরণও আপনার কর্ম, সেটাও আপনার কার্যকলাপ। সৃষ্টির আদি সূচনাও আপনার কার্যকলাপ কারণ সেটাও আপনার ভেতরেই আছে। সমস্ত কিছুই ঘটেছে তারই মধ্যে যাকে আমরা উল্লেখ করি চেতনা বলে। আর সেটা আপনার থেকে আলাদা নয়, সেটা আপনার অজানা কিছু নয়-এটা আপনার অস্তিত্বের ভিত্তি। তাই সৃষ্টির প্রারম্ভও আপনি।