শিব কে? ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের সবচেয়ে বিশিষ্ট এই চরিত্রটিকে ঘিরে অনেক কাহিনী এবং কিংবদন্তী রয়েছে । তিনি কি একজন দেবতা? নাকি হিন্দু সংস্কৃতির সমবেত কল্পনা থেকে তৈরি এক পৌরাণিক কাহিনী? নাকি শিবের কোনো গভীর অর্থ আছে, যা প্রকাশ পায় কেবল তাদের কাছে যারা সন্ধান করে?

সদগুরু: যখন আমরা "শিব" বলি, আমরা দুটি মৌলিক দিককে উল্লেখ করছি। "শিব" শব্দটির মানে আক্ষরিক অর্থে হলো "যা নয় সেটা।" আজ, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের কাছে প্রমাণ করছে যে সবকিছু  শূন্য থেকে আসে এবং শূন্যে  ফিরে যায়। অস্তিত্বের ভিত্তি  এবং মহাজগতের  মৌলিক গুণ হলো বিশাল শূন্যতা। ছায়াপথগুলো হলো একটা ছোট ঘটনা - ছিটেমাত্র । বাকি সমস্তটাই বিশাল শূন্যস্থান, যা শিব বলে উল্লেখ করা হয় | এই সেই গর্ভ যার থেকে সবকিছুর  জন্ম হয়, এবং এই সেই বিস্মৃতি যার মধ্যে সবকিছু ফিরে  যায়। সবকিছু শিব থেকে আসে এবং শিব-এ ফিরে যায়।

এই সেই গর্ভ যার থেকে সবকিছুর  জন্ম হয়, এবং এই সেই বিস্মৃতি যার মধ্যে সবকিছু ফিরে যায়। সবকিছু শিব থেকে আসে এবং শিব-এ ফিরে যায়।

তাই শিবকে সত্তাহীন বলে বর্ণনা করা হয়, সত্তা বলে নয়। শিবকে আলো বলে নয়, অন্ধকার বলে বর্ণনা করা হয় । মানবতা কেবলমাত্র চাক্ষুষ যন্ত্রের বৈশিষ্টের কারণে আলোর স্তুতি  করে চলেছে। অন্যথায়, সবসময় বিদ্যমান একমাত্র যা, তা হলো অন্ধকার । আলোর একটা সীমাবদ্ধতা আছে, এই কারণে যে, আলোর যে কোনো উৎস, তা একটি আলোর বাল্ব হোক বা সূর্য - শেষমেষ জ্যোতি প্রকাশ করার ক্ষমতা হারাবে।। আলোক অনন্ত হয় না। এটা সর্বদা একটা সীমিত সম্ভাবনা কারণ এটা ঘটে এবং এটা শেষ হয়। অন্ধকার আলোর চেয়ে অনেক বড় সম্ভাবনা। কিছুই জ্বালানোর প্রয়োজন নেই, এটা রয়েছে সবসময় - এটা অনন্ত । অন্ধকার রয়েছে সর্বত্র। এটাই একমাত্র জিনিস যা সর্বব্যাপী।

কিন্তু যদি আমি বলি "ঐশ্বরিক অন্ধকার," মানুষ মনে করবে আমি শয়তানের উপাসক বা সেরকম কিছু। আসলে, পশ্চিমের কিছু জায়গায় প্রচারিত হচ্ছে যে শিব একজন অপদেবতা! কিন্তু যদি আপনি এটাকে একটা ধারণা হিসাবে দেখেন, তবে দেখবেন সৃষ্টির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে এবং এটা কীভাবে ঘটেছে তার সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তার আর কোনও ধারণা নেই। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের কাছে "শিব" শব্দটা ব্যবহার না করেই আমি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এই বিষয়ে কথা বলেছি, এবং তারা অবাক হয়ে বলেছেন, "তাই নাকি? এটা জানা  ছিল? কবে ?" আমরা হাজার হাজার বছর ধরে এটা জানি। ভারতের প্রায় প্রত্যেক কৃষকও অবচেতন ভাবে এটা জানে। সে এই বিষয়ে আলোচনা করে, এর আড়ালের বিজ্ঞান না জেনেই।


 

প্রথম যোগী

অন্য এক স্তরে, যখন আমরা "শিব" বলি, আমরা নির্দিষ্ট এক যোগী, আদিযোগী  বা প্রথম যোগী, এবং, আদী গুরু, অর্থাৎ প্রথম গুরুর উল্লেখ করছি, যিনি আজ যোগ বিজ্ঞান হিসাবে আমরা যা জানি, তার উৎস। যোগ হলো আপনার মাথার উপর দাঁড়ানো বা আপনার শ্বাস ধরে রাখা নয়। যোগ হলো কীভাবে এই জীবনটা তৈরি হয় এবং কীভাবে এইটাকে তার চূড়ান্ত সম্ভাবনায় নিয়ে যাওয়া যায়, তার প্রকৃতি জানার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।

সদগুরু কান্তি সরোবর এর তীরে

যোগ বিজ্ঞানের প্রথম প্রসারণ হয়েছিল কান্তি সরোবরের তীরে, হিমালয় অঞ্চলের কেদারনাথের কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত এক হিমবাহ হ্রদ, যেখানে আদিযোগী তার প্রথম সাতজন শিষ্যদের জন্য এই অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তির একটি নিয়মিত শিক্ষাদান শুরু করেছিলেন, যাঁরা আজ সপ্ত  ঋষি বলে সুপ্রসিদ্ধ | এসব ঘটেছিলো কোনো ধর্মের জন্মের আগে । মানুষ মানবতা শেষ করে ফেলার বিভক্তিকর উপায় তৈরি করার আগেই,যা ঠিক করা অসম্ভব মনে হয়,মানব বোধশক্তি বাড়াতে প্রয়োজনীয় এই শক্তিশালী পদ্ধতিগুলোর উপলব্ধি ও প্রচার করা হয়।

এক এবং একইরকম

সুতরাং "শিব" "যা নয় সেটা" এবং আদিযোগী উভয়কেই বোঝায়, কারণ অনেক ভাবেই তারা সমার্থক। এই  সত্তা, যে একজন যোগী  এবং সেই সত্তাহীনতা, যা অস্তিত্বের ভিত্তি, উভয়ই এক, কারণ কাউকে যোগী বলা মানে তিনি নিজের মধ্যে অস্তিত্বকে অনুভব করেছেন। একটা মুহুর্তের জন্যেও যদি আপনাকে নিজের মধ্যে শূন্যতা ধরে রাখা অনুভব করতে  হয়,তবে আপনাকে  সত্তাহীন হতে হবে। শুধুমাত্র শূন্যতা সবকিছু ধরে রাখতে পারে। অল্পকিছু সবকিছুকে ধরে রাখতে পারে না। একটা পাত্র সমুদ্র ধরে রাখতে পারে না। এই গ্রহ একটা মহাসাগরকে ধরে রাখতে পারে, তবে এটা সৌরজগতকে ধরে রাখতে পারে না। সৌর জগৎ এই কয়েকটা গ্রহ এবং সূর্যকে  ধরে রাখতে পারে, তবে এটা বাকি  ছায়াপথকে  ধরে রাখতে পারে না। আপনি যদি এরকম ক্রমশ যান, তবে অবশেষে আপনি দেখবেন কেবলমাত্র  শূন্যই সমস্তকিছু ধরে রাখতে পারে। "যোগ" শব্দটার অর্থ "মিলন "। তিনিই যোগী যিনি এই মিলনের অনুভব অর্জন করেছেন। তার মানে, অন্তত এক মুহুর্তের জন্যে হলেও, তিনি সম্পূর্ণ শূন্যতা অনুভব করেছেন।

যখন আমরা শিব কে "যা নয় সেটা" বা যোগী বলে উল্লেখ করি, এক অর্থে তাঁরা সমার্থক, কিন্তু তবুও তাঁরা দুই ভিন্ন বৈশিষ্ট। কারণ ভারত একটি তর্কমূলক সংস্কৃতি, আমরা এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় অনায়াসে যাতায়াত করি । এক মুহুর্তে আমরা শিবকে  সর্বোত্তম বলি, পরের মুহূর্তে আমরা শিবকে এমন এক মানুষ হিসেবে জানি যিনি আমাদের যোগের এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি দিয়েছেন।

শিব যা নন !

দুর্ভাগ্যবশত, আজকের দিনে বেশির ভাগ লোকই কেবল ভারতীয় ক্যালেন্ডার শিল্পের মাধ্যমে শিবকে  জেনেছেন । ক্যালেন্ডারের শিল্পীর কাছে একটাই  মুখ রয়েছে তাই সে তাঁকে নিটোল, নীল রঙের মানুষ বানিয়েছে। যদি আপনি কৃষ্ণ, চান, সে তাঁর হাতে একটি বাঁশি রেখে দেবে| যদি আপনি বলেন রাম, সে তাঁর হাতে একটি ধনুক রেখে দেবে| যদি আপনি শিব  চান, সে তাঁর মাথায় চাঁদ রেখে দেবে, ব্যস!

শিব, আদিযোগী আলায়াম এর প্রবেশ পথে রাখা স্থাপত্য

প্রতিবার আমি যখন এই ক্যালেন্ডারগুলো দেখি, আমি সবসময় সিদ্ধান্ত নিই আর কখনো চিত্রশিল্পীর সামনে  না বসার । ফটোগ্রাফ ঠিক আছে - তাতে আপনি যেমন আপনাকে ঠিক তেমন দেখায়। যদি আপনি শয়তানের মত দেখতে হন, তাহলে আপনাকে শয়তানের মত দেখতে লাগবে| শিবের মত এক যোগীকে কেন গোলগাল  লাগবে? যদি আপনি তাঁকে রোগা হিসেবে দেখান তাও ঠিক আছে, কিন্তু একটি গোল গাল শিব - কেমন করে ?

যোগিক সংস্কৃতিতে, শিবকে ঈশ্বর হিসেবে দেখা হয় না। তিনি এক সত্তা যিনি এই ভূমিতে পদার্পন  করেন এবং হিমালয় অঞ্চলে বসবাস করেন। যৌগিক ঐতিহ্যের উৎস হিসেবে, মানুষের চেতনা তৈরির ক্ষেত্রে তার অবদান এত বিষ্ময়কর যে তা অস্বীকার করা অসম্ভব। মানবজীবনকে তার সর্বোচ্চ সম্ভাবনাতে  রূপান্তরিত করার সম্ভাব্য সকল পদ্ধতি হাজার হাজার বছর আগে চর্চা করা হয়েছিল। এর সুচারুতা অবিশ্বাস্য। সেই সময়ে মানুষ এত পরিশীলিত ছিল কিনা সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক কারণ এটা একটা নির্দিষ্ট সভ্যতা বা চিন্তার প্রক্রিয়া থেকে আসেনি। এটা একটা অভ্যন্তরীণ উপলব্ধি থেকে এসেছিল। চারপাশে কি ঘটছে তার সাথে এর কোনো সম্পর্ক  ছিল না। এইটা ছিল শুধু নিজেকে ঢেলে দেওয়া। তিনি বিস্তারিতভাবে মানবতন্ত্রের প্রতিটা বিন্দু দিয়ে কী কী করতে পারা যায়, তার  অর্থ ও সম্ভাবনা বর্ণনা করেছেন । আজও আপনি এর একটা জিনিসও পরিবর্তন করতে পারবেন না কারণ তিনি এমন সুন্দর এবং বুদ্ধিমত্তা উপায়ে তা বলেছেন। আপনি শুধুমাত্র আপনার জীবনকালব্যাপী এটার রহস্যোদ্ধার করার চেষ্টা করতে পারেন।

৮ - ১২ খ্রিস্টাব্দের শিব ও শক্তি মন্দিরগুলি

এই দেশে, প্রাচীনকালে, বেশিরভাগ মন্দিরই শিবের জন্য নির্মিত হয়, অন্য কারো জন্যে নয়। শুধুমাত্র বিগত ১০০০ বছরে  অন্যান্য মন্দির তৈরি হয়েছে। শিব শব্দটির আক্ষরিক অর্থ "যা নয় সেটা"। তাই মন্দির "যা নয় সেটার”  জন্য নির্মিত হয়েছিল। "যা আছে" তার ভৌতিক প্রকাশ হয়; কিন্তু "যা নয়” তা হলো ভৌতিক প্রকাশের ঊর্ধে। মন্দির হলো একটি প্রবেশপথ যার মাধ্যমে আপনি এমন এক ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন যা নেই। দেশে হাজার হাজার শিব মন্দির রয়েছে, এবং এদের মধ্যে বেশিরভাগেরই কোন রূপ নেই। তাদের শুধু একটি প্রতিনিধি রূপ আছে এবং সাধারণত সেটা একটা লিঙ্গ ।

ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুনavailable here.
shivashakti-lores


Editor's Note: Download Sadhguru's ebook, Shiva - Ultimate Outlaw. The ebook is filled with rich graphics and pearls of wisdom from Sadhguru that reveal many virtually unknown aspects about the being we call Shiva. Encounter Shiva like never before!