সদগুরু: ভারতে প্রায় ১৬ কোটি হেক্টর আবাদী জমি রয়েছে কিন্তু এই জমির প্রায় ষাট শতাংশ অনুর্বর হিসাবে চিহ্নিত। এর মানে হল আগামী পঁচিশ থেকে তিরিশ বছরের মধ্যে, এদেশে যে পরিমাণ খাদ্য দরকার তা আমরা উৎপাদন করতে সক্ষম নাও হতে পারি।ভারত অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছে : আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মঙ্গল ও চাঁদে রকেট পাঠাচ্ছেন; বিশাল ব্যবসায়িক উন্নয়ন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কীর্তি ঘটেছে। এ সবকিছুর মধ্যে, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার হল, কোনও প্রযুক্তি ছাড়াই, শুধু চিরাচরিত জ্ঞান প্রয়োগ করে, আমাদের কৃষকরা একশ কোটিরও বেশি মানুষকে খাওয়াচ্ছেন। এটাই এদেশে শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

দুর্ভাগ্যবশত, আজকে চাষিদের দেওয়ালে পীঠ ঠেকে গেছে। সেই কারণে তারা আর চাইছেন না যে তাদের সন্তানেরা আর কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হোক। একদিকে আমরা জমির গুণমান হারিয়ে ফেলছি, অন্যদিকে চাষিরা তাদের সন্তানদের কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হতে দিতে চাইছেন না। এর অর্থ হলো আগামী ২৫ বছরে আমরা এক প্রবল খাদ্য-সঙ্কটের সম্মুখীন হতে চলেছি।

যখন জল এবং খাদ্য থাকবে না, তখন যে স্তরের সামাজিক সংকট দেখা দেবে তা দেশকে বিভিন্নভাবে ধ্বংস করবে। যেসব গ্রামাঞ্চলে জল পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে সেখান থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষজন শহরাঞ্চলে স্থানান্তরিত হবে। এটা খুব বেশি দূরে নয়। কোনও রকম পরিকাঠামো না থাকলে তারা রাস্তাঘাটে বসে পড়বেন। কিন্তু তা কতদিনের জন্য? যখন খাদ্য এবং জল থাকবে না, তারা অন্যের বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়বেন। আমি বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করি না, কিন্তু এখন আমরা যদি জোরালো কিছু না করি তাহলে আগামী আট থেকে দশ বছরের মধ্যে আপনি এই পরিস্থিতিগুলো দেখতে পাবেন। 

উর্বর মাটি – সবচেয়ে মূল্যবান উপহার

গ্রীষ্মপ্রধান দেশে জলের একমাত্র উৎস বলতে আমাদের আছে বর্ষাকালের বৃষ্টি। পঁয়তাল্লিশ থেকে ষাট দিন ধরে আমাদের এখানে বৃষ্টি হয়। এই ষাট দিনের বৃষ্টিতে যে জল নেমে আসে, তা মাটিতে ৩৬৫ দিনের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে, নদী, হ্রদ এবং ভূগর্ভে সরবরাহের জন্য। প্রচুর পরিমান গাছপালা লাগানো ছাড়া আর কোনও উপায় আমাদের কাছে নেই।  

শুধুমাত্র মাটিতে বিপুল মাত্রায় জৈব উপাদান থাকার কারনেই মাটি জল ধরে রাখাতে পারে। গাছের পাতা এবং পশুর বর্জ্য এই জৈব উপাদানের উৎস। যেখানে গাছ এবং পশুর বর্জ্য নেই সেখানে মাটি জল ধরে রাখতে পারবে না – তা বয়ে চলে যাবে। 

 

আপনাদের অবশ্যই এটা বোঝা দরকার যে একটি দেশের সম্পদ বলতে কী বোঝায়। এটা সেই পাতা এবং বিষ্ঠা! ব্যবসা, টাকা-পয়সা বা সোনা নয় – আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিসটি দিতে পারি তা হল উর্বর মাটি। উর্বর মাটি ছাড়া জলের কোনও প্রশ্নই আসে না।

ভারতে, আপনি যদি এক ঘন মিটার মাটি নিয়ে পরীক্ষা করেন, তাহলে তাতে যত সংখ্যক বিভিন্ন প্রজাতির সূক্ষ্ম জীবানু পাওয়া যায় তা পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি । তাই মাটি ক্ষয়িষ্ণু হলেও, আপনি একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে, উর্বরতা ফিরে পাওয়ার দুরূহ ক্ষমতা এর আছে। আবহমান কাল ধরে গাছপালায় সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে আমাদের মাটির মধ্যে এত প্রাণের সমাবেশ ঘটেছে । এত উর্বর বলে আমরা ১২,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জমিতে চাষ করেছি। কিন্তু গত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর সময়ের মধ্যে সমস্ত গাছপালা সরিয়ে ফেলার কারণে আমরা একে মরুভূমিতে পরিণত করছি।

মাটি কিভাবে স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে

ভারতের মাটির অবস্থা এতটাই খারাপ যে তার পুষ্টির মাত্রা কমে যাচ্ছে মারাত্মকভাবে। বিশেষত ভারতীয় শাকসবজির ক্ষেত্রে, গত পঁচিশ বছরে এটি ত্রিশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য সব জায়গায়, ডাক্তাররা মানুষকে আমিষ থেকে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তিত হতে বলছেন। কিন্তু ভারতে চিকিৎসকরা আপনাদের আমিষাশী হতে পরামর্শ দিচ্ছেন। সারা পৃথিবী যখন চেষ্টা করছে মাংসাশী থেকে পরিবর্তিত হয়ে নিরামিষাশী হিসাবে জীবন যাপনের জন্য, আমরা যারা প্রধানত নিরামিষভোজী হিসাবে জীবনযাপন করতাম, তারা মাংসভোজীতে পরিবর্তিত হওয়ার চেষ্টা করছি, কারণ আমরা যে খাবার খাচ্ছি তাতে পর্যাপ্ত পুষ্টি নেই। 

এর সহজ কারণ হল আমরা মাটির যত্ন নিইনি । মাটিতে মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টের পরিমাণ এত সাংঘাতিকভাবে কমে গেছে যে, আমাদের তিন বছরেরও কম বয়সী সত্তর শতাংশের বেশি শিশু আজ রক্তাল্পতায় ভুগছে। 

আপনি যদি কোনও জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে মাটি তুলে নেন, দেখবেন তা প্রাণে পূর্ণ। মাটি এরকমই হওয়ার কথা। যদি মাটির শক্তি দুর্বল হয়, তবে আমাদের শরীরও দুর্বল হয়ে যাবে – কেবলমাত্র পুষ্টির ক্ষেত্রে নয়, কিন্তু একেবারে ভিত্তিগত ভাবে। এর অর্থ হল,আমরা যে পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করব তা আমাদের থেকে নিম্নমানের হবে। এটি মানবতার প্রতি অপরাধ। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের চেয়ে উন্নত হওয়া উচিত। তারা যদি আমাদের থেকে অনুন্নত হয় তবে অনুন্নত একেবারে প্রাথমিক স্তরে কিছু ভুল করেছি। ভারতে সেটাই ঘটছে বিপুলভাবে, কারণ মাটি তার শক্তি হারাচ্ছে।

কাজে নেমে পড়তে হবে এখনই

1960 এর আগে, ভারতে বহু দুর্ভিক্ষ হয়েছে। তার মধ্যে কোন কোনটায়, গ্রীষ্মের সময় মাত্র দু’ তিন মাসেই তিরিশ লাখ লোকের জীবন নিয়েছিল । যদি নদীগুলি শুকিয়ে যায় এবং ভূমিক্ষয় হয় তবে আমরা আবার সেই একই ধরনের পরিস্থিতিতে ফিরে যাব। যদি আমরা এখনই সঠিক কাজ না করি তবে এই ভূমি ভবিষ্যতে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। 

সদগুরু কাবেরী কলিং আন্দোলনের সূচনা করলেন আদিযোগীতে, ৩১ শে জুলাই,২০১৯

 

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি কাবেরী কলিং শুরু করেছি। আমরা কাবেরী অববাহিকায় ২৪২ কোটি গাছ লাগাতে কৃষকদের সহায়তা করার লক্ষ্য রেখেছি, যা প্রায় ৮৩,০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল। এটি এই অববাহিকার এক তৃতীয়াংশকে ছায়ায় ঢেকে দেবে। এতে কাবেরী অববাহিকায় প্রায় ৯ ট্রিলিয়ন লিটার অতিরিক্ত জল ধরে রাখা যাবে। এটি প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তে নদীতে প্রবাহিত জলের ‌৪০% এরও বেশি। 

এটি করার একমাত্র উপায় হ'ল কৃষকদের কৃষি-বনায়ন ও বৃক্ষভিত্তিক কৃষিতে নিয়ে আসা। আমরা ছোট আকারের কিছু নমুনা প্রদর্শন করেছি যেখানে আমরা ৬৯,৭৬০ কৃষককে কৃষি বনায়নে নিয়ে এসেছি এবং পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে তাদের সম্পত্তি তিনশো থেকে আটশো শতাংশ বেড়েছে। একবার যদি একে আমরা কাবেরী অববাহিকায় বড় মাত্রায় প্রয়োগ করার জন্য উদাহরন হিসাবে দেখাতে পারি তবে অন্যান্য নদীর ক্ষেত্রেও একে হুবহু অনুকরণ করা যেতে পারে। 

এখনই সময় সত্যিকারের পদক্ষেপ নেওয়ার। যদি আরও দশ থেকে পঁচিশ বছর ধরে এই প্রচেষ্টা একটানা চলতে থাকে তবে আমরা খুব সহজেই পুরো পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারব। 

ACTION NOW - Cauvery Calling - Plant Trees