প্রশ্নকর্তা:  সদগুরু, আমি দুশ্চিন্তায় ভুগি। কেন এটা হয়, আর কিভাবেই বা আমি একে নিয়ন্ত্রণ করব?

সদগুরু: মানসিক স্বাস্থ্য একটি সংবেদনশীল বিষয় ... তবে শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, যদি না বাইরে থেকে আসা কোনও ধরণের সংক্রমণ হয়ে থাকে তবে বাকি সমস্ত রোগই আসে আমাদের ভেতর থেকে। যেটা আপনারই ভেতর থেকে আসছে, সেটা আপনার দায়িত্ব কি না? যদি আপনার শরীর ভেতর থেকে কোনও অসুস্থতা তৈরি করে, তবে সেটা ঠিক করার দায়িত্বও আপনার কি না?

এ কথা কি সত্য নয় যে অজস্র লোক যারা দুপুর অবধি নির্জীবের মতো বিছানায় পড়ে থাকেন তাদের বেশিরভাগই নানারকম রোগে ভুগছেন? এরা ভাবেন যে অন্যরা যারা ভোর পাঁচটায় উঠে দৌড়ায়, সাঁতার কাটে, খেলাধুলা বা অন্য কিছু করে, তারা বোকা। এরা ভাবেন যে কেবল খেয়ে আর ঘুমিয়ে শুধু এরাই জীবনকে সত্যিকারের উপভোগ করছেন। কিন্তু কিছু সময়ের পরই, এটি শরীর-মনের ক্ষতি করতে থাকে। এরপর তারা ভাবেন যে কারোর ভালো স্বাস্থ্য হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, আর নিজেদের খারাপ স্বাস্থ্য একটা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। না! স্বাস্থ্য তৈরি হয় ভেতর থেকেই। যদি সংক্রমণের আকারে বাইরে থেকে কোনও আক্রমণ আসে, তবে সে আলাদা ব্যাপার। 

মনে করুন,আপনার (শরীরের) রসায়নটির নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে আছে, আপনি কি উদ্বেগ সৃষ্টি করবেন নাকি পরমানন্দ?

যখন মানসিক স্বাস্থ্যের কথা আসে, বলতেই হয় যে এটি অনেক বেশি সংবেদনশীল, কিন্তু তবুও - আপনার শরীরে যা ঘটছে তা যদি আপনার দায়িত্ব হয় তবে আপনার মনে যা ঘটছে সেটা কি আপনার দায়িত্ব নয়? এর অনেক কারণ থাকতে পারে। এমনকি শারীরিক অসুস্থতাও অনেক রকম কারণে হতে পারে।মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে। তবে আমাদের মানসিক অসুস্থতা থেকে দুঃখকে আলাদা রাখতে হবে। আপনি আপনার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আপনার দুঃখ ভাল করাতে পারবেন না; সে নিজেও দুঃখী হতে পারে।

আপনি যদি ডাক্তারি মতে অসুস্থ হন তবে তারা আপনাকে ওষুধ দিয়ে কিছুটা ঠিক করতে পারে, যা কিনা ক্রমাগত রাসায়নিক প্রয়োগের কারসাজি। তবে সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত রাসায়নিক কারখানাটি রয়েছে এখানেই । মনে করুন,আপনার (শরীরের) রসায়নটির নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে আছে, আপনি কি উদ্বেগ সৃষ্টি করবেন নাকি পরমানন্দ? অবশ্যই, আপনি বেছে নেবেন পরমানন্দ, সুখের সর্বোচ্চ স্তর।

সমস্যাটা এটুকুই - যে কোনো কারণেই হোক, আপনার রসায়ন নিয়ন্ত্রণের বাইরে হয়ে গেছে। জিনের গঠনের জন্য হতে পারে, রোগ সংক্রমণ জনিত কারণ থাকতে পারে, বাইরের কোন উদ্দীপনা থাকতে পারে, অনেক কিছু থাকতে পারে। কিন্তু তবুও, নিজের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ভার নেওয়া কি আপনার মৌলিক দায়িত্ব নয়? যে মুহূর্তে ভাববেন দায়িত্বটা আপনার নয়, সঙ্গে সঙ্গেই আপনি এক অচলাবস্থায় চলে যাবেন, এবং এটা সম্পূর্ণ আপনার হাতের বাইরে চলে যাবে। যদি আপনি দেখেন যে এটা আপনার দায়িত্ব, তবে আগামীকাল সকালেই হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে না, কিন্তু আপনি সুস্থতার দিকে চলা শুরু করতে পারেন। 

আপনি কে, আপনি কী, আপনি কী নন, এই সবকিছুর দায়িত্ব অবশ্যই আপনার নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্য এটাই: ধর্ম থেকে দায়িত্বে নিয়ে যাওয়া। ধর্ম মানে আপনার জীবনে যা কিছু ভুলচুক ঘটছে তার দায়বদ্ধতা রয়েছে ওই ওপরে, স্বর্গে। কিন্তু সমস্যা হ'ল আপনি রয়েছেন একটা গোলাকার গ্রহের ওপর, এবং শুধু তাই নয়, এই জিনিসটা অনবরত ঘুরপাক খেয়েই চলেছে। মহাবিশ্বের কোথাও নিশ্চিত ভাবে চিহ্ন দিয়ে বলা নেই যে এই দিকটাই ‘ওপর’। তো, কোনটা ওপরের দিক সেটাই যদি আপনি না জানেন, তাহলে অবধারিতভাবেই আপনি ভুল দিকে তাকাচ্ছেন।

 

এটা কি করে হয় যে আপনি যা তার জন্য দায়ী “ওই ওপরের” কোন কেউ? সময় এসেছে এই দায়িত্বটা আমাদের নিজের কাঁধে নেওয়ার। তবেই আমরা আমাদের সেরাটা করতে পারব। এই গ্রহের প্রত্যেকেই কি একই স্তরের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন? না, তা কখনই হবে না। কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি তো? সেটাই সবচেয়ে জরুরি। আমাদের যা করার ক্ষমতা আছে, তা অবশ্যই হওয়া উচিত। আমাদের যা করার ক্ষমতা নেই তা যদি না করি, তবে সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা যা করতে পারি সেটাও যদি না করি, তবে আমরা একটা বিপর্যয়।

দেহতন্ত্রে ভারসাম্য আনার নানা সহজ উপায় রয়েছে। এখানে রসায়নের ব্যাপার আছে; দেহে বিভিন্ন গ্রন্থিসংক্রান্ত ক্রিয়াকলাপ আছে। সবচেয়ে সহজ উপায় হল আপনি শুধু সঠিকভাবে বসতে শিখুন। এমনভাবে বসুন যাতে শরীরকে আপনার পেশিশক্তির সাহায্য নিতে না হয়, অর্থাৎ এটা এমনই সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় থাকবে যে এটা বসলে সোজা বসেই থাকবে। প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা কেবল এটা করলেই আপনি দেখবেন - আপনি অনেক ভালো বোধ করছেন। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আরও কিছু জটিল প্রক্রিয়া রয়েছে যা আপনি করতে পারেন। তবে কমপক্ষে এটুকু চেষ্টা করুন - জ্যামিতিকভাবে, নিজেকে এমনভাবে রাখুন যাতে দেহতন্ত্রে কোনও চাপ না থাকে।

প্রথমদিকে, মনে হবে যেন একটা চেষ্টা করতে হচ্ছে, তবে একবার এইভাবে বসলে আপনি দেখতে পাবেন যে কোনও প্রচেষ্টা ছাড়াই, শরীরের কোন অংশে কোনও জোর না দিয়েও শরীর ঠিক সেভাবেই থেকে যাচ্ছে। জ্যামিতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মহাবিশ্বের যে কোনও ভৌত বস্তুর ক্ষেত্রেই এটা সত্য - কোন কিছু কতটা কার্যকরীতার সাথে কাজ করে তা নির্ভর করে সেটা জ্যামিতিকভাবে কতটা সুগঠিত তার ওপর। যেমন, একটা ইঞ্জিন। আপনি যখন বলেন এটা সত্যিই ভালো ইঞ্জিন, তার মানে সেটা জ্যামিতিকভাবে সুবিন্যস্ত, সেখানে কোন ঘর্ষণ নেই। আপনি যদি কোনও ইমারতের নকশাটি ভালো বলেন তার মানে সেটা জ্যামিতিকভাবে সুগঠিত।

যেমন এই শরীরের সাথে তেমনি এই পুরো বিশ্বজগতের সাথেও এটা একই রকম। এই মুহূর্তে, গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। সেগুলো কি ইস্পাতের দড়ি বা অন্য কিছু দিয়ে চালানো হচ্ছে? এটা শুধুই জ্যামিতির ব্যাপার। যদি সৌরজগৎ তার জ্যামিতিক সুবিন্যাস থেকে সরে যায়, তবে সব শেষ। শুধুমাত্র জ্যামিতিকভাবে নিখুঁত বলেই, এটা চলছে। আপনার শরীরের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। একটা স্তরে, যোগের উদ্দেশ্যই হল আপনার শারীরিক জ্যামিতিটাকে মহাজাগতিক জ্যামিতির সাথে মেলানোর, যাতে আপনার বাঁচার প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ সহজসাধ্য হয়ে যায়। 

 

আপনি একে চাপ, উদ্বেগ বা অন্য যা কিছু নামই দেন না কেন - আসলে, দেহতন্ত্রে ঘর্ষণ রয়েছে। কাজেই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রথমে দৈহিক গঠনতন্ত্রকে জ্যামিতিকভাবে সুবিন্যস্ত করতে হবে, এবং তারপর, অবশ্যই এটাকে সঠিকভাবে মসৃণ করতে হবে। এটা করার উপায় আছে। যেখানে জ্যামিতিক পরিপূর্ণতা রয়েছে, সেখানে খাটুনি নেই; কোন ঘর্ষণও নেই। এই ব্যাপারটাই আপনার দেহতন্ত্রে আনতে হবে। এই ছোট ছোট জিনিসগুলোকে আপনার জীবনের ওপর দখল করে নিতে দেবেন না। একটা ছোট্ট উদ্বেগ যা আপনাকে সর্বক্ষণ জ্বালাতে থাকে, তা আপনার জীবন প্রক্রিয়াকে সীমিত এবং ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই এগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঠিক করে ফেলতে হবে।