পাঁচটি কারণ কেন প্রধান আহারের মধ্যবর্তী সময়ে অল্পস্বল্প টুকটাক কিছু খেতে থাকা উচিত নয়
আজকাল প্রধান আহারের মধ্যবর্তী সময়ে অল্পস্বল্প কিছু খাবার খাওয়ার প্রচলন বহু মানুষের মধ্যে ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কিন্তু সধগুরু ব্যাখ্যা করেছেন কেন সেই মুখরোচক টুকটাক খাবার খাওয়া ততো ভাল নাও হতে পারে।
#১ মন ও শরীর খালি পেটে সবচেয়ে ভাল কাজ করে
সদগুরু: আপনি ভাবতে পারেন যে সারাদিন ধরে কিছু খাওয়া আপনাকে আরো সক্রিয় হতে সাহায্য করবে। কিন্তু যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে পেটে খাবার থাকলে আপনার শরীর কেমন অনুভব করে এবং পেট খালি থাকলে কেমন অনুভব করে, তা হলে দেখবেন, আপনার পেট খালি থাকলে আপনার শরীর ও মস্তিষ্ক সবচেয়ে ভাল কাজ করছে। যদি খাদ্য ক্রমাগত আপনার পাচনতন্ত্রের মধ্যে পরিপাক হয়, তাহলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি স্বাভাবিকভাবেই তার জন্য বরাদ্দ থাকে, তাই আপনার মস্তিষ্ক এবং শরীর, উভয়ই তাদের শ্রেষ্ঠ কার্যক্ষমতা দেখাতে পারবে না ।যদি আপনি নিজের পূর্ণক্ষমতায় কাজ করতে চান, তবে সচেতন থাকুন এবং সেই ধরণের খাবার খান যাতে দেড় ঘন্টা থেকে আড়াই ঘন্টার মধ্যে আপনার পাকস্থলী খালি হয়ে যায়, এবং খাদ্যবস্তু অন্ত্রে চলে যায়। তা হলে তার পর থেকে শরীর আর অতো বেশি শক্তি ব্যয় করে না। এবং বারো থেকে আঠেরো ঘণ্টার মধ্যে খাদ্যের সম্পূর্ণভাবে আপনার দেহ থেকে বার হয়ে যাওয়াই উচিত । যোগ-এ সবসময় এটার ওপরই জোর দেওয়া হয় ।
পাকস্থলী খালি থাকা মানেই যে ক্ষুধার্ত বোধ করতে হবে, তা নয় । আপনার তখনই খিদে পায় যখন শরীরের শক্তি কমে যায়। নয়তো পাকস্থলী খালি থাকাই উচিত ।
আপনি যদি এই সরল সচেতনতা বজায় রাখেন, তবে আপনি আরও বেশি শক্তি, তৎপরতা এবং সতর্কতা উপভোগ করবেন। এগুলোই হলো সফল জীবন তৈরির উপাদান তা আপনি জীবনে যা-ই করার কথা ঠিক করে থাকুন না কেন।
#২ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শরীরতন্ত্রকে পরিচ্ছন্ন রাখা।
যখন পাকস্থলীর মধ্যে পাচন ক্রিয়া ঘটছে, অন্তঃকোষীয় স্তরে শরীরের পরিশোধন প্রায় বন্ধ থাকে। তাই যদি আপনি সারাদিন ধরে খাবার খান, কোষ দীর্ঘ সময় ধরে দূষিত পদার্থ ধরে রাখে, যা কিছুদিনের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। এমনকি অন্ত্র থেকে নির্গমন প্রক্রিয়াও কার্যকরীভাবে ঘটবে না কারণ বর্জ্য পদার্থ একবারের পরিবর্তে বিভিন্ন সময়ে মলাশয়ে আসতেই থাকবে।
মলাশয় পরিষ্কার না হলে, আপনি সমস্যাকে ডেকে আনছেন। যোগ-এ আমরা বলি অপরিষ্কার মলাশয় মানসিক অস্থিরতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। যদি আপনার মলাশয় পরিষ্কার না থাকে, আপনি আপনার মনকে স্থিতিশীল রাখতে পারবেন না।
যে কোন রোগই হোক না কেন, আয়ুর্বেদ ও সিদ্ধা-র মতো ভারতীয় পরম্পরাগত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলিতে তারা প্রথমেই আপনার পাচনতন্ত্র পরিস্কার করতে চায়, কারণ আপনার বেশিরভাগ সমস্যা একটি অপরিষ্কার মলাশয়ের কারণে হতে পারে।
আজকাল মানুষ যেভাবে খাচ্ছে, তাদের কাছে মলাশয় পরিষ্কার রাখাটা একটা খুব কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু ধরুন আপনি প্রতিদিন মাত্র দুটি বড় খাবার খান এবং এর মধ্যে কিছুই না খান, যেমন আমরা সাধারণতঃ আশ্রমে করি, অথবা আমরা যদি খুব সক্রিয় থাকি তবে আমরা একটি ফল খেতে পারি, তবে আপনার মলাশয় সবসময় পরিষ্কার থাকবে। যৌগিক রীতিতে, আমরা বলি যে দুটি আহারের মধ্যে অন্তত ছয় থেকে আট ঘণ্টার ব্যবধান থাকতে হবে। যদি এটি সম্ভব না হয়, অন্তত একটি পাঁচ ঘন্টার ব্যবধান থাকা আবশ্যক। এর চেয়ে কম মানে আপনি নিজেই নিজের সমস্যা তৈরি করছেন।
#৩ শরীরের মধ্যে খাদ্য পরিপাক
আপনি যেটাকে নিজের শরীর ও মন বলেন সেটা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্মৃতির সংগ্রহ। এটা এই স্মৃতির জন্যই - অথবা আপনি এটাকে তথ্য বলতে পারেন - যে এই শরীরটা এই আকৃতি নিয়েছে। আমরা যে খাদ্য খাই তা এই স্মৃতির উপর নির্ভর করে শরীরে রূপান্তরিত হয়। ধরা যাক, আমি একটি আম খেলাম। আম আমার মধ্যে প্রবেশ করলো এবং একটি পুরুষ মানুষ হয়ে গেল । যদি একজন মহিলা আম খান তবে একই আম তার মধ্যে যাবে এবং এক নারী হয়ে যাবে। যদি কোন গোরু আম খায় তবে এটি গোরুর ভিতরে যায় এবং গোরু হয়ে যায়। কেন এই আম আমার মধ্যে গিয়ে একটি পুরুষ মানুষ হয়, একটি নারী বা গরু হয় না? এটি মূলত স্মৃতির কারণে, এক নির্দিষ্ট ধরনের স্মৃতি যা আমার শরীর-তন্ত্রে রয়েছে।
আপনার যখন বয়স বাড়ে, খাবারকে শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত করার এই শারীরিক ক্ষমতা কমতে শুরু করে। এর কারণ হলো তখন আপনার জিনগত স্মৃতি এবং বিবর্তনমূলক স্মৃতির খাবারটিকে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা কমে যায় । এবং এটা কেন হয় যে যদি আমি একটা আম খাই এর একটি অংশ আমার ত্বকে পরিণত হয় এবং এটা ত্বকের রঙেই আসে? আপনি হঠাৎ করে হাতে কোন আমের রঙের দাগ খুঁজে পাবেন না, কারণ এই ধরণের শক্তিশালী স্মৃতি কাঠামো রয়েছে। আমি যা কিছুই গ্রহণ করি না কেন, স্মৃতি নিশ্চিত করবে যাতে সেটা এই ব্যক্তিতেই পরিণত হয়, অন্য কোনও ব্যক্তিতে নয়।
পাচন ঘটলেও কিন্তু একটি জীবনের মধ্যে আরেকটি জীবনের রূপান্তর সেভাবে ঘটবে না কারণ স্মৃতি দুর্বল হয়ে উঠছে।
আপনার বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি হলে, দিনে দুই বার খাবার অবশ্যই আপনার জন্য বেশি স্বাস্থ্যকর হবে। শরীর নিজেকে এই ধীর গতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে, কিন্তু আপনি কীভাবে খাবেন এবং কী খাবেন সে সম্পর্কে সচেতন হলে, আপনি এটিতে আরও বিচক্ষণ ভাবে সামঞ্জস্য আনতে পারেন। যদি আপনি শারীরিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় ব্যক্তি না হন বা আপনার কোনও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা না থাকে, যদি আপনার বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের বেশি হয়, তবে প্রতিদিন দুইবার খাবার আপনার জন্য বেশি স্বাস্থ্যকর হবে। যদি আপনি আরো খাবার খান, আপনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে শরীরে চাপ সৃষ্টি করছেন। আপনার এখন সেই পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন নেই কারণ আপনার লম্বায় বৃদ্ধি পাওয়া সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে। যদি আপনি ক্ষুধার্ত বা ক্লান্ত বোধ করেন, তবে মাঝে একটি ফল আপনার প্রয়োজন মেটাবে। আপনি যদি এটি বজায় রাখতে পারেন, আপনি খুব ভাল থাকবেন। এটা অর্থ সাশ্রয়কারী এবং পরিবেশ রক্ষার অনুকূল এবং আপনি স্বাস্থ্যবানও থাকবেন।
#৪ সম্পূর্ণতা বজায় রাখা
আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া বলতে যা বোঝায় তার একটা দিক হলো আপনি আপনার দেহ ও মনের মধ্যে একটা বিশেষ পূর্ণতা বা অখণ্ডতার বোধ নিয়ে আসেন। পূর্ণতা বা অখণ্ডতা বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, যখন আপনার শরীর-তন্ত্র একটি নির্দিষ্টভাবে সমন্বিত না থাকে, যদি এটা শিথিল থাকে, তা হলে এটা কোনও কিছু অনুভব করতে পারবে না। সর্বশ্রেষ্ঠ কিছু ঘটলেও, আপনি এটি অনুভব করতে ব্যর্থ হবেন। ‘ইনার ইঞ্জিনিয়ারিং’ প্রোগ্রামে সবকিছু এভাবে পরিকল্পিত যে আপনার মধ্যে এক নির্দিষ্ট স্তরের শারীরিক ও মানসিক সমন্বয় থাকে। এর ফলে আপনার অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
আপনার শরীরটাই একমাত্র যন্ত্র যার মাধ্যমে আপনি অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। আপনি মনের ব্যাপারে বলতে পারেন, কিন্তু সেটাও তো শরীর। বাইরের কিছুর জন্য শরীরকে খুলে দিলে দেহতত্ত্বের দৃঢ়তা বা অখণ্ডতা হ্রাস পায়। এই ব্যাপারটাই মানুষ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। আপনি দিনে কতবার বাইরে থেকে কিছু গ্রহণ করতে শরীরকে উন্মুক্ত করেন, তার ওপরই নির্ভর করবে আপনি কতদিন বাঁচবেন। আপনি যদি শুধু বারবার বাইরের জিনিসের কাছে শরীরতন্ত্রকে খুলে ধরেন, আপনি শরীরতন্ত্রকে শিথিল করে দেবেন। এমন একটা শরীর কোনও কিছুই করতে পারে না কারণ সেখানে কোনও অখণ্ডতা ও সমন্বয় নেই। যখন সেখানে কোনও অখণ্ডতা ও সমন্বয় নেই, সেখানে কোনও কিছুর সঙ্গে সংযোগও নেই। আপনি কোনও ভাবে শুধু বেঁচে থাকবেন। তার বাইরে আর কিছু ঘটবে না।
কেন যোগীরা বা যারা সাধনায় রয়েছেন তারা দিনে মাত্র একবার বা দু'বার খান তার মধ্যে আর কিছুই খান না কারণ তারা কোনও কিছুর জন্য শরীরকে খুলতে চান না। জল এবং বাতাস ছাড়া অন্য কোনও বাইরের পদার্থ শরীর তন্ত্রে বার-বার প্রবেশ করানো উচিত নয় কারণ এতে অনুভূতির দিক দিয়ে শরীর তন্ত্রের অখণ্ডতা বা সমন্বয় শিথিল হয়ে যাবে। আপনার অস্তিত্বের সবচেয়ে বাইরের স্তর হল অনুভূতি। আপনি যদি নিজেকে খুব সংবেদনশীল রাখতে চান, তা হলে আপনি যা কিছুরই বা যে সমস্তকিছুরই মুখোমুখি হন তার কাছে শরীরটিকে খুলে ধরবেন না, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি অবশ্যই ভালোভাবে খাবেন, বিষয়টা সেটা নয়, কিন্তু আপনার অনেকবার খাওয়া উচিত নয়।
#৫ বাধ্যবাধকতা থেকে সচেতনতায়
যখন আপনার খাওয়ার ইচ্ছা হয় তখন না খাওয়া - এটা সাধনার একটি অংশ যাতে এইভাবে আপনি খাবার ব্যাপারে বা একইভাবে অন্য কিছুর ব্যাপারে বাধ্যবাধকতার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেন। খাদ্য একটি খুব মৌলিক জিনিস। এই উপর ভিত্তি করে, জীবনের অন্যান্য অনেক দিক বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। আপনাদের মধ্যে অনেকেই যখন এই আশ্রমে এসেছেন এই নির্যাতন ভোগ করেছেন: এটা খাবারের সময়, আপনি সত্যিই ক্ষুধার্ত এবং আপনি ভোজনে স্থানে এলেন। আপনার সামনে খাবার রয়েছে, আপনি তা গোগ্রাসে খেতে চান। কিন্তু মানুষ তাদের চোখ বন্ধ করে আর হাত জোড় করে আছে প্রার্থনার জন্য। ধারণাটি এই যে আপনি খুব ক্ষুধার্ত কিন্তু আপনি আরও দুই মিনিট অপেক্ষা করছেন। আপনি এইভাবে চেষ্টা করুন সমস্ত ক্ষেত্রে যেখানে আপনি বাধ্যতামূলক ভাবে আচরণ করেন। আপনার কাছে বাধ্যতামূলক যাই হোক না কেন, শুধু দুই মিনিটের জন্য অপেক্ষা করুন। এটা আপনাকে মেরে ফেলবে না। এটা আপনাকে খুব শক্তিশালী করে দিয়ে যাবে।
শরীরের এই বাধ্যবাধকতাকে সরিয়ে দেওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার শরীর এবং মন একটি মিশ্রণ। অতীতের সব ধরণের ছাপ নিয়ে গঠিত হয়েছে প্রবণতা এবং সেই প্রবণতাগুলি বাধ্যতামূলক। আপনি যদি এটি মেনে নেন তবে এর মানে হলো আপনি বিকশিত বা বিবর্তিত না হতে ঠিক করে নিয়েছেন। আপনি ঠিক করে নিয়েছেন যে আপনি এই ছাঁচে ফেলা জীবন কাটাতে আপত্তি করবেন না। আপনি এই ছাঁচ ভাঙতে চাননা এবং নতুন সম্ভাবনাকে খুঁজে বার করতে চান না।
খাদ্য খুব মৌলিক এবং সহজ কিছু কিন্তু তবুও, আপনি এই দিকটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রিত করবেন - এই ব্যাপারটা অনেক পার্থক্য করে দেয়। আপনার মধ্যে আগে থেকে রয়ে যাওয়া যে সব তথ্য আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার থেকে ধীরে-ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আরও সচেতনভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠারই এটা একটি সফর। বন্ধন বিভিন্ন স্তরে রয়েছে,কিন্তু আপনার সমস্ত বন্ধনের ভিত্তি আপনার শরীর, সেজন্যই আপনি শরীরের সাথে কাজ করছেন।
গৌতম বুদ্ধ এতদুর পর্যন্ত বলেছিলেন যে, "যখন আপনি খুব ক্ষুধার্ত এবং আপনার খাদ্যের প্রচন্ড প্রয়োজন, তখন যদি আপনি অন্য কাউকে খাবার দান করেন তা হলে আপনি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবেন।" আমি এতো পর্যন্ত যাচ্ছি না। আমি বলছি "শুধুমাত্র দু মিনিট অপেক্ষা করুন" - এটি অবশ্যই আপনাকে শক্তিশালী করে তুলবে।
সম্পাদকের নোট: "ফুড বডি" ই-বইটিতে দেওয়া রয়েছে যে ধরনের খাবার শরীরের জন্য সবথেকে স্বস্তিদায়ক এবং সেকম খাবার খাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত উপায়গুলির অনুসন্ধানও করা হয়েছে। ৩৩-পৃষ্ঠার পুস্তিকাটি আপনার শরীরের সামঞ্জস্য রক্ষার এবং তার জন্য সবথেকে মানানসই কী তা খুঁজে বের করার প্রথম ধাপ ।