রামকৃষ্ণ পরমহংসের আত্মজ্ঞান প্রাপ্তি
16 আগস্ট রামকৃষ্ণ পরমহংসের মহাসমাধি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই আলোচনায় সদগুরু আমাদের রামকৃষ্ণ পরমহংসের আত্মজ্ঞান প্রাপ্তি এবং একজন মহান যোগী তোতাপুরীর সাথে তাঁর সাক্ষাতের কথা বলছেন।
16 আগস্ট রামকৃষ্ণ পরমহংসের মহাসমাধি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই আলোচনায় সদগুরু আমাদের রামকৃষ্ণ পরমহংসের আত্মজ্ঞান প্রাপ্তি এবং একজন মহান যোগী তোতাপুরীর সাথে তাঁর সাক্ষাতের কথা বলছেন।
সদগুরু: রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই বেঁচে ছিলেন একজন পরম ভক্তের রূপে। তিনি ছিলেন একজন কালী ভক্ত। তাঁর কাছে কালী শুধু একজন দেবী ছিলেন না, ছিলেন একটা জীবন্ত বাস্তব। কালী রামকৃষ্ণের সামনেই নৃত্য করতেন, তিনি রামকৃষ্ণের হাত থেকেই খাবার খেতেন, যখনই রামকৃষ্ণ তাঁকে ডাকতেন তখনই তিনি দর্শন দিতেন আর তাঁকে পরমানন্দে ভরিয়ে তুলতেন। এটা একেবারেই বাস্তব ছিল, সত্যি সত্যিই এটা ঘটছিল। এটা কোনও অলীক কল্পনা ছিল না, তিনি বাস্তবেই দেবীকে খাওয়াতেন। রামকৃষ্ণের চেতনা এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে তিনি যে রূপের কথাই ভাবতেন সেটাই তাঁর জন্য বাস্তবে পরিণত হত। যে কোনও ব্যক্তির জন্যই এই অবস্থায় থাকাটা অত্যন্ত সুন্দর একটি বিষয়। যদিও রামকৃষ্ণের শরীর, মন এবং আবেগ পরমানন্দে ভোরে উঠত, কিন্তু তাঁর সত্তা এই পরমানন্দকেও অতিক্রম করে যেতে ব্যাকুল হয়ে থাকত। তাঁর মধ্যে কোথাও একটা এই চেতনা ছিল যে পরমানন্দ নিজেই একটা বন্ধন।
রামকৃষ্ণ কালীর ভক্ত ছিলেন এবং কালী ছিল তাঁর একমাত্র আগ্রহ। যখন তিনি কালীর ভক্তিতে মত্ত থাকতেন, তখন তিনি পরমানন্দে ফেটে পড়তেন, নাচতেই থাকতেন, গাইতেন থাকতেন।
একদিন, রামকৃষ্ণ হুগলি নদীর তীরে বসেছিলেন যখন তোতাপুরী – খুবই মহান এবং বিরল একজন যোগী, এমন সত্তার আবির্ভাব খুব কমই ঘটেছে – ওই পথেই এলেন। তোতাপুরী দেখলেন, রামকৃষ্ণ এমন এক তীব্রতার মানুষ যিনি সম্পূর্ণ পথটা অতিক্রম করতে পারেন এবং আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হতে পারেন। কিন্তু সমস্যাটা ছিল, তিনি কেবল তাঁর ভক্তিতেই আটকে পড়েছিলেন।
তোতাপুরী রামকৃষ্ণের কাছে এসে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “তুই এখনও তোর ভক্তির প্রতি এত আসক্ত কেন? চূড়ান্ত পদক্ষেপটা নেওয়ার সম্ভাবনা তোর মধ্যে রয়েছে।" কিন্তু রামকৃষ্ণ বললেন, "আমি শুধু কালীকেই চাই, ব্যাস।" তিনি ছিলেন একজন শিশুর মতো যে কেবল তার মা-কে চাইতো। এর কাছে যুক্তি দেখানো সম্ভব নয়। এটি একেবারে ভিন্ন অবস্থা। রামকৃষ্ণ কালীর ভক্ত ছিলেন এবং কালী ছিল তাঁর একমাত্র আগ্রহ। যখন তিনি কালীর ভক্তিতে মত্ত থাকতেন, তখন তিনি পরমানন্দে ফেটে পড়তেন, নাচতেই থাকতেন, গাইতেন থাকতেন। তাঁর এই অবস্থা একটু স্তিমিত হলেই, সংযোগ হারিয়ে ফেললেই, তিনি বাচ্ছার মতো কাঁদতেন। তিনি এমনই ছিলেন। তাই তোতাপুরী যতই আত্মজ্ঞানের কথা বলুন না কেন, তাঁর এ সবের প্রতি কোনও আগ্রহই ছিল না। নানাভাবে তোতাপুরী তাঁকে নির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রামকৃষ্ণের কোনও ইচ্ছাই ছিল না। আবার, তোতাপুরীর উপস্থিতি এমন ছিল যে রামকৃষ্ণ তোতাপুরীর সামনেই বসে থাকতে চাইতেন।
তোতাপুরী দেখলেন, রামকৃষ্ণ ঠিক সেই একই অবস্থায় আটকে রয়েছেন। তাই তিনি বললেন, “এটা খুবই সহজ। এই মুহুর্তে তুই তোর আবেগকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিস, অর্থাৎ তুই তোর শরীরকেও গুরুত্ব দিচ্ছিস যার মানে তুই তোর অন্তরের রসায়নকেও গুরুত্ব দিচ্ছিস। তুই তোর চেতনাকে গুরুত্ব দিচ্ছিস না। তোর কাছে প্রয়োজনীয় শক্তি রয়েছে, শুধু তোকে তোর চেতনতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।”
রামকৃষ্ণ রাজি হয়ে বললেন, "ঠিক আছে, এবার আমি বসবো আর আমি আমার চেতনতাকেই গুরুত্ব দেব।"
কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি কালীর দর্শন পান, তিনি আবার সেই প্রেম ও পরমানন্দে ডুবে যান যাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যতবারই বসুন না কেন, যে মুহূর্তে তিনি কালীকে দেখবেন, তিনি আবার উন্মত্ত হয়ে যাবেন।
তাই তোতাপুরী বললেন, "পরের বার যখন কালী আবির্ভূত হবেন একটা তলোয়ার দিয়ে তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেল।" রামকৃষ্ণ জিজ্ঞেস করলেন," আমি তলোয়ারটা কোথা থেকে পাবো? "
তোতাপুরী বললেন, “ঠিক যে জায়গা থেকে তুই কালীকে পেয়েছিস। তুই যদি একটা সম্পূর্ণ কালী সৃষ্টি করতে পারিস তবে তুই একটা তলোয়ার সৃষ্টি করতে পারবি না? তুই পারবি। তুই যদি একটা দেবী সৃষ্টি করতে পারিস তবে তাকে কাটার জন্য তুই একটা তলোয়ার সৃষ্টি করতে পারবি না? প্রস্তুত হ।"
রামকৃষ্ণ বসলেন। কিন্তু যেই মুহূর্তে কালীর আগমন হল, তিনি পরমানন্দে ফেটে পড়লেন এবং তলোয়ার-চেতনা সবকিছু ভুলে গেলেন।
তখন তোতাপুরী তাঁকে বললেন, “তুই এবার বস। যে মুহুর্তে কালী আসবে..." এবং তিনি একটি কাঁচের টুকরো তুলে বললেন, "এই কাঁচের টুকরো দিয়ে, আমি তোকে কাটবো, যেখানে তুই আটকে আছিস। আমি যখন সেই স্থানটা কাটবো, তুই তখন তলোয়ার সৃষ্টি করে কালীকে কেটে ফেলবি।"
আবার রামকৃষ্ণ বসলেন এবং ঠিক যখন রামকৃষ্ণ পরমানন্দে মত্ত হতে যাবেন, যখন কালী তাঁর দৃষ্টিতে আবির্ভূত হলেন, তখন তোতাপুরী কাঁচের টুকরোটি নিয়ে রামকৃষ্ণের কপালটা গভীরভাবে কেটে দিলেন।
সেই মুহুর্তেই, রামকৃষ্ণ তলোয়ার সৃষ্টি করলেন এবং কালীকে কেটে ফেললেন, মা এবং সেই মাকে খাওয়ানোর পরমানন্দ থেকে তিনি মুক্ত হয়ে গেলেন। আর ঠিক তখনই তিনি সত্যিকারের পরমহংসে পরিণত হলেন, তিনি সম্পূর্ণরূপে আত্মজ্ঞানী হয়ে উঠলেন। তার আগে পর্যন্ত তিনি একজন প্রেমিক ছিলেন, একজন ভক্ত ছিলেন, একজন সন্তান ছিলেন সেই মাতৃদেবীর যাকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন।