ভারতের অবিশ্বাস্য বয়নশিল্পের পুনরুদ্ধার
ভারতে বোনা বস্ত্রই একদিন গোটা বিশ্বকে পোশাক জুগিয়েছিল। যদিও সেই অপূর্ব শিল্পকৌশলের অনেকটাই হারিয়ে গেছে গত আড়াইশো বছরে, তবু সদগুরু এখানে চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিলেন, ভারতীয় বয়নশিল্পে আজও কত অবিশ্বাস্য বৈচিত্র রয়েছে এবং এখনও তা গোটা বিশ্বকেই পোশাক সরবরাহ করতে পারে।

কিন্তু স্বাধীনতার আগের দুটি শতকে ব্রিটিশ সরকার রীতিমতো ছক কষেই ভারতের বস্ত্রশিল্পকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, শুধুমাত্র ম্যাঞ্চেস্টারে তাদের কাপড়ের কলগুলোকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই। আঠেরোশো থেকে আঠেরোশো ষাট—মাত্র এই ষাট বছরেই ভারতের বস্ত্র রফতানি চুরানব্বই শতাংশ পড়ে যায়। আঠেরোশো তিরিশে ভারতের এক বড়লাট বলেছিলেন, “তাঁতিদের হাড়গোড়ই ভারতের সমতল ভূমিকে শোধন করে দিয়েছে”, কারণ লক্ষ লক্ষ তাঁতির মৃত্যু হয়েছিল ওই পর্বে।
হস্তচালিত বয়নশিল্পের শৈলী
এত কিছুর পরেও বলতে হয় যে, এখনও সেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা আমাদের রয়েছে। ভারতে এখনও একশো কুড়িটিরও বেশি তাঁতের স্বতন্ত্র শিল্পধারা রয়েছে। প্রতিটি জেলা, প্রত্যেক সম্প্রদায়, এমনকী নির্দিষ্ট কিছু পরিবারের কাছেও আছে কাপড় বোনার ও তাকে রং করার নিজস্ব পদ্ধতি।
আমার যখন সতেরো বছর বয়স, কিছু কাল আমি আমার কাকার বাড়িতে কাটাই, যেখানে হাজার হাজার সিল্কের শাড়ি বোনা হত। কী জটিল উপায়েই যে হাজার হাজার সুতোকে নানা জ্যামিতিক নকশায় ফেলে বোনা হত। তাঁরা যখন বুনতেন, বুনতে বুনতেই হাজারো হিসেব কষতেন মনে মনে আর আমি দেখতাম, যেন ম্যাজিকের মতোই কত ফুল ফুটে উঠছে কাপড়ের উপর। যে পরিমাণ অঙ্কের হিসেব, হাতের দক্ষতা আর একটা সজাগ মন লাগে কাপড় বুনতে ও তাতে নকশা ফোটাতে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। যেন সত্যিই কোনও ম্যাজিক।
মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর হাতের দক্ষতা যখন একসাথে মেশে, তখন রান্না করাই হোক বা তাঁত বোনা, তাতে এক আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। সেটা ঠিক আপনাদের ওই আবেগের ব্যাপার নয়। ওটা হল বিশেষ এক ধরনের মনোযোগ, একাত্মতা বোধ অথবা একাগ্রতা।
আরাম, না চটুল সাজের জন্য পোশাক ?
কিন্তু আজকাল যা হয়েছে, আমাকে একজন বলছিলেন যে, আজ যদি আপনি ভারতের যে কোনও বড় শহরেরই হাঁটুর বয়সি নাগরিকদের ফটো তুলতে যান, তা হলে দেখবেন তাদের ষাট ভাগেরও বেশি ছেলেমেয়ে পরে আছে আমেরিকার শ্রমিকদের পোশাক : একরঙা নীল ডেনিম। আর ব্যবসায়ী লোকেদের পরনে স্যুট আর টাই, এমনকি চল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রাতেও। আমাদের দেশের গরমে টাই হল প্রায় গলায় বাঁধা ফাঁসির দড়ির মতোই একটা বাজে ব্যাপার। আমাদের পোশাক, আমরা যে আবহাওয়ায় বাস করি, তার সঙ্গে আরও বেশি মানানসই, আরও অনেক স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়া উচিত।
আর সে দিক থেকে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল, যে বস্ত্রটি আপনি পরছেন তা জৈব হওয়া চাই। নিজেদের পোশাকের বদলে যদি মাত্র তিন দিনের জন্যও আপনি লিনেন, পাট, সুতি, তুলো কিংবা শণের পোশাক গায়ে চাপান, সেই অনুভূতিটুকু কেমন, তা বুঝতে পারবেন। আপনার শরীর প্রাকৃতিক নিয়মেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।
কিন্তু আজ সারা বিশ্বে যত বস্ত্র ব্যবহার হয়, তার ষাট ভাগই পলিথিনের তন্তু দিয়ে তৈরি। ধারণা করা হচ্ছে যে, মোটামুটি আর এক দশকের মধ্যেই বিশ্বের সমস্ত তন্তুর প্রায় আটানব্বই শতাংশই কৃত্রিম হয়ে যাবে। বাহারি সাজগোজই আজ এই গ্রহের দ্বিতীয় বৃহত্তম দূষণকারীর ভূমিকায়। অতি সূক্ষ্ম পলিথিন-তন্তু ঢুকে পড়ছে আমাদের শরীরে, বিষিয়ে দিচ্ছে আমাদের মাটি ও জল, এমনকি মিশে যাচ্ছে আমাদের খাদ্যচক্রেও। আমরা ওগুলোই খাচ্ছি, শ্বাস নিচ্ছি, কত রকম উপায়েই যে ব্যবহার করে চলেছি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্যানসার সহ, বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য-সমস্যারই যোগ রয়েছে পলিথিন তন্তু এবং কৃত্রিম পোশাকের সঙ্গে, নিঃসন্দেহে যা প্রভাব ফেলছে আমাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যের উপরে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু গবেষণায় ধরা পড়েছে, তাদের নব্বই শতাংশ মানুষের রক্তেই কমবেশি মাত্রায় প্লাস্টিক রয়েছে।
প্লাস্টিক ছেড়ে জৈবের দিকে
আজ সময় এসেছে প্রাকৃতিক তন্তু এবং বয়ন শিল্পকে আবারও ফিরিয়ে আনার। হাজার হাজার বছর ধরে এদেশের অসংখ্য পরিবার এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছে তাদের অনুপম বয়নের কৌশল। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ যেভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে কোনও সন্তান যদি তার বাবা-মা’র থেকে বয়নধারা শিখতে তাঁতে গিয়ে বসে, তখনই আধুনিক চিন্তায় তাকে শিশুশ্রমিক বলে বসা হবে। অথচ একজন কুশলী তাঁতি হয়ে ওঠার জন্য দরকার দীর্ঘ দিনের একাগ্র সাধনা। সেক্ষেত্রে শৈশব থেকেই মনোনিবেশের প্রয়োজন। কিন্তু আপনি যদি সন্তানকে একটানা সতেরো বছর স্কুলে পাঠানোর পর আশা করেন, সেই ছেলেটি বা মেয়েটি তারপর বয়নশিল্পে যোগ দেবে, তাতে কোনও কাজ হবে না।
এই সেকেলে স্কুলশিক্ষা পদ্ধতি পাল্টানোর জন্য বর্তমানে আমরা একটি খসড়া নীতির প্রস্তাব রাখছি। সৌভাগ্যবশত গত ২০১৮-র আগস্ট মাসে সরকার একটি ঘোষণায় জানিয়েছে যে, ভবিষ্যতে স্কুলে প্রতিদিনের অর্ধেক সময়ই শুধু পড়াশোনার জন্য নির্দিষ্ট করা হবে। আর বাকি সময়টা নজর দেওয়া হবে খেলাধুলো, শিল্প, সঙ্গীত, হাতের কাজ এবং অন্যান্য নানা বিষয়ের উপর। একবার এর সুফল ফলতে শুরু করলেই ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই হাতে বোনা তাঁতশিল্পে মন দিতে পারবে।
আমরা এও দেখছি, প্রাকৃতিক তন্তু থেকে বোনা স্বাস্থ্যসম্মত কাপড়ে কীভাবে পড়ুয়াদের স্কুলপোশাকের ব্যবস্থা চালু করা যায়। কেরালা রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলো ইতিমধ্যেই এই ব্যবস্থা চালু করে ফেলেছে। একইভাবে বেসরকারি স্কুলগুলোও একদিন উৎসাহিত হবে, আর এই বার্তা গোটা বিশ্ব জুড়েই পৌঁছে দেওয়া যাবে যে, ছেলেমেয়েদের পোশাক যেন অন্তত তাদের পক্ষে স্বাস্থ্যকর জৈব তন্তু দিয়েই বানানো হয়। এমনকী স্কুলের গণ্ডির বাইরেও জৈব তন্তুতে বানানো বিশেষ নকশা-বসানো পোশাক পৌঁছানো যাবে নির্দিষ্ট সরকারি কর্মচারী, ভ্রমণ-পরিচালক এবং ট্যাক্সিচালকদের কাছে।
ভারতের এবং বিদেশেরও বিখ্যাত ফ্যাশান ডিজাইনারদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা যায়, যাতে তাঁরা প্রাকৃতিক তন্তু থেকে তৈরি করা পোশাকেই আদর্শ মানের নকশা ফুটিয়ে তোলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও সেরকম পোশাকই পরি, যার মাধ্যমে এই দেশের বয়নশিল্পীদের অবিশ্বাস্য কৃতিত্বকে তুলে ধরা যায়। আমি তাই সবার কাছেই, বিশেষত ভারতের সমৃদ্ধ নাগরিকদের কাছে আবেদন রাখছি, আপনাদের আলমারিতে কুড়ি শতাংশ অন্তত হাতে-বোনা কাপড়ের পোশাক রাখুন, যা কোনও যন্ত্রে তৈরি নয়, বরং মানুষের তৈরি। দয়া করে সপ্তাহে একটি দিন অন্তত কোনও ভারতীয় পোশাক পরুন। এটা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য, আপনার কল্যাণ এবং বাস্তুতন্ত্রের মঙ্গলের জন্যই। তাছাড়া, একই সঙ্গে এর মাধ্যমে বয়নশিল্পের কলাকুশলীদের আগামী প্রজন্মকেও আপনি সহায়তা করতে পারবেন।
শান্তির জন্য সাজগোজ
এ বছর মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমরা কয়েকজন বিশিষ্ট আমেরিকান ডিজাইনারকে নিয়ে এসেছি “শান্তির জন্যই সাজগোজ” নামে একটি উদ্যোগে। না, সেজেগুজে র্যাম্পে হেঁটে বেড়ানোর মতো কোনও ফ্যাশন শো ছিল না এটা। বরং এমন একটা অনুষ্ঠান ছিল, যেখানে আমরা পনেরো থেকে কুড়িজন সেরা ডিজাইনারকে ভারতের বয়ন-কুশলতা দেখাই। আমরা মোট একশো দশ রকম বুনন-বৈচিত্রকে তুলে ধরেছিলাম, যাতে ওগুলো দেখে তাঁরা বুঝে নিতে পারেন, কীভাবে তাতে কোন ধরনের নকশা করা যায়।
বয়নশিল্পীদেরও আমরা বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চাই। এই উদ্যোগকে সম্পূর্ণ করতে একটা মঞ্চ দরকার—সেই সঙ্গেই একটা অনলাইন পোর্টাল-ও করব আমরা, যেখান থেকে ইচ্ছুক ক্রেতারা সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য বস্ত্র কিংবা পোশাক তাঁতিদের থেকে সরাসরি কিনতে পারেন।
এমনকী আমরা এও দেখছি, চাষিরাও কীভাবে এই উদ্যোগ থেকে লাভবান হতে পারেন। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে মুশকিল এই যে, তা পচনশীল বলেই চাষিদের তা অবিলম্বে বিক্রি করে ফেলতে হয়। কিন্তু তাঁদের চাষজমির তিরিশ শতাংশও যদি প্রাকৃতিক তন্তু উৎপাদনের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা যায়, তবেই তা তাঁদের জন্য একটা বিরাট আর্থিক সুরাহা হতে পারে।
বিশ্বকে পোশাক জোগানো
যদিও ভারত একদিন বয়নশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল, কিন্তু গত শতাব্দী বা কাছাকাছি কোনও সময় থেকেই বিশ্ব আর সেভাবে ভারতীয় বস্ত্রকে চেনে না। দেশে যেমন, তেমনই সারা বিশ্ব জুড়েও আমরা নানা উদ্যোগ নিয়ে চলেছি মানুষকে এ বিষয়ে নতুন করে সচেতন করতে। ভারতে কর্মহীনতা নিয়ে বহু আলোচনা হয়। কিন্তু আমরা যদি হস্তচালিত তাঁতকে ফিরিয়ে আনতে পারি, তবে এর এত বিপুল চাহিদা হবে যে, তা তৈরির জন্য তখন যথেষ্ট লোক পাওয়া যাবে না। আমরা যদি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি, তবে ভারত অবশ্যই বিশ্বকে আবারও বস্ত্রের সম্ভারে ঢেকে ফেলতে পারবে, এবং তা এক বিচক্ষণ ও প্রাকৃতিক পথেই।
সম্পাদকের মন্তব্য: এদেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখেই সদগুরুর তীক্ষ্ণ সমীক্ষায় ধরা পড়ে, কেন এই সংস্কৃতি আজও পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই জানার বিষয়। এখানে রয়েছে আলোকচিত্র, গ্রাফিকস এবং সদগুরুর প্রেরণাদায়ী বক্তব্যে সমৃদ্ধ সেই ভারতের কথা, যাকে আপনারা এভাবে জানেননি কখনও। ডাউনলোড করুন!Download Bha-ra-ta.