সদগুরু: সম্প্রতি আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, "জীবন কি যন্ত্রণা না পরমানন্দ?” উত্তরে বলেছিলাম, “আপনাকে যদি বিকল্প দেওয়া হয়, তাহলে আপনি কোনটা চাইবেন?

প্রত্যেক মানুষই সবসময় মাধুর্যের সর্বোচ্চ রূপকেই চায়। তাসত্ত্বেও, আমরা নিজেদেরকে পরিণত করেছি দুর্দশা তৈরি করার নানা যন্ত্রে। এর কারণ হল, আমরা নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে সৃষ্টিকে বিভক্ত করে ফেলেছি। একবার যখন আপনি সৃষ্টিকে 'ভালো' এবং ‘মন্দ’ এই দুইয়ের মধ্যে বিভক্ত করে ফেলবেন, গ্রহণ এবং প্রত্যাখ্যানের মধ্যে বিভক্ত করে ফেলবেন, তখন আপনি পরমানন্দের সম্ভাবনাকে পরিত্যাগ করেছেন।

আর ঠিক এইখানেই শিব আমাদের সময়কালের এক শক্তিশালী রূপক। যোগী রূপে তিনি তিনটি মূল গুনের মূর্ত প্রকাশ: নিশ্চলতা, উচ্ছলতা এবং মত্ততা। এইগুলোই হল মূল তত্ত্ব যা সৃষ্টির সমস্ত কিছুর ভিত্তি। এগুলো ছাড়া জীবন একটা অন্তহীন সংগ্রাম।

আধুনিক বিজ্ঞান এবং যৌগিক প্রথা এই বিষয়ে একমত যে মহাবিশ্বের অন্তঃস্থল মূলত নিশ্চল। যদিও আমরা 'বিগ ব্যাং-'এর এবং ক্রমাগত বিস্ফোরণ হতে থাকা বিভিন্ন তারামণ্ডলের সম্বন্ধে জানি, তবুও মহাবিশ্বের বেশিরভাগটাই নিশ্চল। এটাই, যৌগিক পরিভাষায় ‘শি’-‘ব', অর্থাৎ, ‘সেটা যা কিনা নেই’। এটাই আদতে সৃষ্টির মূল, অণু এবং ব্রহ্মাণ্ডের মূল ভিত্তি। যদি শারীরিক এবং মানসিকের ঊর্ধ্বে গিয়ে জীবনকে অনুভব করতে হয়, তাহলে নিশ্চল হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়।

এই নিশ্চলতা থেকে এক গতিশীলতার উদ্ভব হয়, যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূর্ত প্রকাশ ঘটায়। সৃষ্টির সমৃদ্ধির এটাই কারণ। এই প্রাণোচ্ছলতার ফলে আমরা জীবনে অংশগ্রহণ করতে পারি, সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। এই মানব শরীর প্রত্যেক মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলছে আর মন, চরম বিভ্রান্তির দিকে। এই উচ্ছলতা ছাড়া মানব জীবন সত্যিই অসম্ভব।

আপাতদৃষ্টিতে সৃষ্টির এই অযৌক্তিক এবং বিপরীত প্রকৃতির সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন মসৃণকারী মত্ততা। এই মত্ততাই শিবকে একই সাথে তপস্বী আর নর্তক, সন্ন্যাসী এবং গৃহীর এক আকর্ষণীয় সমন্বয় করে তোলে। এই মত্ততাই তাকে একইসাথে আবেগপ্রবণ এবং নিরাবেগ, জীবনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত আবার একই সাথে নির্লিপ্ত করে তোলে।

যদি আমরা নিজেদের অন্তরের কোন উৎস থেকে মত্ততার যোগান নিতে পারি, তাহলে সেটা আমাদের যোগ্যতা বৃদ্ধি করবে।

কালের প্রত্যুষ হতে আমরা মত্ততা খুঁজে বেরিয়েছি বিভিন্ন উপায়ে। কেউ খোঁজে প্রেমের মধ্যে। কেউ সন্ধান নেন সুরা পানীয় এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের। মত্ততা প্রয়োজন মূলত ঘর্ষণ বা সংঘাত কমানোর জন্য। এটি জগতের সঙ্গে আমাদের সংযুক্তির পথ মসৃণ করার এক পদ্ধতি। সংঘাতের আশঙ্কায় জীবনের সঙ্গে আমাদের সংযুক্তি কম হতে থাকে। এই মত্ততা আমাদের মধ্যে নমনীয়তা এবং তারল্য নিয়ে আসে, সাবলীলভাবে জীবনের লীলায় মত্ত হওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে।

রসায়নগত মত্ততার একমাত্র সমস্যা হলো এই যে এটা আমাদের যোগ্যতা হরণ করে নেয়। কিন্তু, যদি আমরা নিজেদের অন্তরের কোন উৎস থেকে মত্ততার যোগান নিতে পারি, তাহলে সেটা আমাদের যোগ্যতা বৃদ্ধি করবে। সেটা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক জীবন সম্পূর্ণভাবে সাবলীল এবং অবিচ্ছিন্ন করবে, এমনকি আমাদের সম্পূর্ণরূপে পরমানন্দে নিমজ্জিত করবে। লোক কথায় প্রায়ই বলা হয় শিব অনন্তকাল ধরে এক মত্ত অবস্থায় রয়েছেন। শিব কিন্তু গাঁজা-ভাং সেবন করেন না। তিনিই স্বয়ং মত্ততা, উন্মাদনার উৎস।

কিভাবে আমরা আমাদের জীবনে সচেতনভাবে এই তিনটি গুণের বিকাশ ঘটাতে পারি? পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার জন্য মহাশিবরাত্রি এক দারুণ সময়। আপনি এই সামান্য অনুশীলন করে দেখতে পারেন। দিনের বেলায়, বিভিন্ন বিশিষ্ট ক্ষণে, আপ্রাণ চেষ্টা করুন নিশ্চলতা আর নিস্তব্ধতা আনতে যে কোন আসনে। সূর্যাস্তের পর নিজেকে উচ্ছল হয়ে উঠতে দিন এবং নৃত্য করুন। সমস্ত দিন ধরে নিশ্চল থাকার পরে আপনি যদি সারা রাত ধরে জেগে থাকেন, দেখবেন একরকম স্বতঃস্ফূর্ত মত্ততা আপনার অস্তিত্বের প্রতিটি অংশে প্রবাহিত হচ্ছে।

যার প্রতিটি কোষে শিব প্রবেশ করেছেন তার কোন কিছুই কাম্য নেই, কোন কিছুর জন্য আক্ষেপ নেই। তার আর কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না। যখন সব কিছুর গুরুত্ব চলে যায়, তখন সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পক্ষপাতী হয়ে জিনিশপত্রের গুরুত্ব নির্ণয় করলে, আপনি জরিয়ে পরবেন। কিন্তু যখন সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ, তখন আপনি মুক্ত! আপনি তখন উন্মুক্ত জীবনের তীব্র উন্মাদনায় সিক্ত। আপনি জীবনের সর্বোচ্চ শিখরকে স্পর্শ করেছেন। জীবনের সেই তীব্র, একাগ্র, চরম মাত্রাকে স্পর্শ করা মানে স্বয়ং শিবকে স্পর্শ করা।