প্রশ্নকর্তা: সদগুরু, আপনি যখন যেখানেই যান, সর্বদাই একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতেই বসেন! বাম পায়ের জুতো খুলে, বাম পা উপরে উঠিয়ে, ডান পা নীচে ভূমি স্পর্শ করে বসেন। এটা কি আপনার নিজস্ব ধরন ? না কি সব মানুষের এভাবেই বসা উচিত ?

সদগুরু: তুমি কি এখনও ভারতীয় পদ্ধতির শৌচালয় ব্যবহার করো ?

প্রশ্নকর্তা: হ্যাঁ! 

সদগুরু: তুমি কি সেখানে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতেই বসো ? কেন ? কারণ, আমাদের শরীরটা ঠিক সেভাবেই তৈরি। বিদেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর জানিয়েছিল যে, ““এটাই মলত্যাগের উৎকৃষ্ট উপায়”, কারণ, তোমার উরুদুটি উদরের উপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং যা কিছু বাইরে বেরিয়ে আসা দরকার, সহজেই সেটা বেরিয়ে আসবে। যদি সেটা ঠিকমতো বেরিয়ে আসতে না পারে, তবে সেটা ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখী চাপ তৈরি করবে। 

বিন্যাসের সাযুজ্য

যোগবিজ্ঞানে আমরা দেখতে পাই যে, নির্দিষ্ট কিছু দেহ ভঙ্গিমা কয়েকটি বিশেষ ধরনের কর্মকুশলতার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, যাকে আমরা হঠযোগ, বলি, তা আসলে নির্দিষ্ট কিছু ভঙ্গিমার মাধ্যমে শরীরকে তার জ্যামিতিক পরিপূর্ণতায় উন্নীত করার প্রক্রিয়া। যাতে তোমার শরীরের জ্যামিতি, সর্বদাই সৃষ্টির বৃহৎ জ্যামিতিক বিন্যাসের সাযুজ্যে থাকে – যাতে তুমি কোনও ভাবেই বিচ্ছিন্ন না হয়ে যাও! 

 

তোমার ভিতরের ভারসাম্য, তোমার স্বচ্ছ দৃষ্টি, এবং কর্ম সম্পাদনে তোমার নৈপুণ্য - সবকিছু নির্ভর করে তুমি কতটা সৃষ্টির সামঞ্জস্যে আছো, তার উপর। চারপাশের মানুষজন, গাছপালা, সমগ্র জীবন অথবা তোমার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে কতটা সামঞ্জস্যে আছো তুমি, সেটিই স্থির করে দেবে তোমার পার্থিব জীবন কতটা মসৃণ ও বিঘ্নহীন হবে। 

আমি সব সময় এইভাবে বসি না- শুধুমাত্র কথা বলার সময় বসি। এই ভঙ্গিটির নাম সিদ্ধাসন। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এই ভঙ্গিটিকে দেখা যায়। একটা দিক হল, বাম পায়ের গোড়ালিতে একটা নির্দিষ্ট বিন্দুস্থান আছে, আধুনিক আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা সেটিকে “অ্যাকিলিস” বলে অভিহিত করেছে। অ্যাকিলিসের নাম কি তোমরা শুনেছো ? 

যদি তোমার অ্যাকিলিসকে মূলাধারে, অথবা তোমার শরীরের পেরিনিয়াম অংশে ঠেকিয়ে রাখো, সেক্ষেত্রে তোমার অনেক কিছু পরিস্কার হয়ে যাবে। তোমার ভাবনাচিন্তা পরিস্কার হবে, তোমার আবেগে ভারসাম্য আসবে এবং তোমার চারপাশের ঘটনা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। 

যখনই তুমি গোড়ালিকে মূলাধারের সংলগ্ন করে বসবে তখন এতটাই নিঁখুত ভারসাম্য তৈরি হবে যে, পক্ষপাতহীন হয়ে জীবনকে তার সঠিকতায় অনুভব করতে পারবে

তুমি শুনেছো, অ্যাকিলিসের মৃত্যুর কারণ, তার গোড়ালিতে তীরবিদ্ধ হয়েছিল। তুমি কি বিশ্বাস করো, কোনও মানুষকে গোড়ালিতে আঘাতের দ্বারা হত্যা করা যায়? অ্যাকিলিসকে কিন্তু ওভাবেই মারা হয়েছিল। এই ঘটনার বহু পূর্বে এই ভারতবর্ষেই একজন মানুষ ঠিক ওভাবেই মারা যান, তার নাম - কৃষ্ণ। তোমাদের এটাই বোঝাতে চাইছি যে, তীব্র বিচক্ষণতার সাথে ওদের হত্যা করা হয়েছিল, সাধারণভাবে গলা কেটে বা মাথা ভেঙ্গে নয়। শুধুমাত্র পায়ের গোড়ালির একটি নির্দিষ্ট স্থানকে বিদ্ধ করে তাদের মারা হয়েছিল। শরীরের মধ্যে শক্তি প্রবাহের কৌশল এমনই যে, যখনই তুমি গোড়ালিকে মূলাধারের সংলগ্ন করে বসবে তখন এতটাই নিঁখুত ভারসাম্য তৈরি হবে যে, পক্ষপাতহীন হয়ে জীবনকে তার সঠিকতায় অনুভব করতে পারবে।  

পক্ষপাতহীন হয়ে থাকা

আমাদের সকলের নিজস্ব মতামত, ধ্যান-ধারণা, আদর্শবাদ আছে। জীবনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা প্রসূত যে ছাপ তোমার গভীরে তৈরি হয়েছে, সেগুলিই তোমার বোধকে প্রভাবিত করছে প্রতি মুহূর্তে। তুমি এটা পচ্ছন্দ করো, ওটা পচ্ছন্দ করো না, তুমি একে ভালোবাসো, ওকে ঘৃণা করো – এসবের কারণ হল প্রতি মুহূর্তে নিজের ভিতরে পক্ষপাতিত্বের শিকার হয়ে যাচ্ছো তুমি। যদি তুমি সত্যিই জীবনকে জানতে চাও, তাহলে পক্ষপাতহীন হয়ে প্রতিটি মুহূর্তকে তার নিজস্বতায় দেখতে শেখাই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

এরকম বহু মানুষ তুমি পাবে যারা বিগত তিরিশ বছর ধরে আমার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন, তবুও তাদের একজনের সম্পর্কেও আমি বিন্দুমাত্র কোনও মতামত পোষণ করি না

কথাগুলো সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এরকম বহু মানুষ তুমি পাবে যারা বিগত তিরিশ বছর ধরে আমার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন, তবুও তাদের একজনের সম্পর্কেও আমি বিন্দুমাত্র কোনও মতামত পোষণ করি না। শুধুমাত্র কোনও নির্দিষ্ট কাজের প্রয়োজন হলেই আমি তাদের দক্ষতা অনুযায়ী নিয়োগ করি, কিন্তু তার পরেও তাদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অভিমত নেই আমার। এটিই আধ্যাত্মিক পথের সৌরভ যে, আমরা লাগাতার প্রতিটি জীবনকেই একটা সম্ভাবনার আধার হিসেবে দেখি। 

সম্ভাবনা এবং বাস্তবতার মধ্যে নিশ্চয়ই একটা দূরত্ব রয়েছে। কিছু মানুষের এই দূরত্ব অতিক্রম করার সাহস এবং অঙ্গীকার দুটোই থাকে, কিছু মানুষের তা থাকে না। তবুও প্রতিটি জীবন সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। যদি তুমি সেই সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাও, সেক্ষেত্রে কোনও মানুষের সম্পর্কে কোনও অভিমত তৈরি করো না। 

ভাল, মন্দ, কুৎসিত – এভাবে মতামত তৈরি করো না, তুমি প্রতি মুহূর্তে তাদের দেখতে থাকো, তারা এই নির্দিষ্ট মুহূর্তে কীভাবে আছে সেটিই আমার কাছে বিচার্য। গতকাল তুমি কেমন ছিলে সেটা দেখা আমার কাজ নয়, আগামীকাল তুমি কেমন হবে, সেটা তখন দেখা যাবে। আগামীকে তার মতো করে তৈরি করতে হবে, এখন থেকেই স্থির করে ফেলার কোনও প্রয়োজন নেই।

সঠিক জ্যামিতির সন্ধানে

এটা শরীরের নির্দিষ্ট জ্যামিতিক প্রকরণ। এখন পশ্চিমী সভ্যতা প্রচার করছে যে, “যোগ আসলে স্ট্রেচিং ব্যায়াম, এর পরিবর্তে তোমরা বক্সিং, টেনিস এসব নিয়ে থাকতে পারো”। যদি তুমি নিজেকে ফিট রাখতে চাও তবে কোথাও গিয়ে দৌড়াও, পাহাড়ে চড়ো, টেনিস খেলো বা অন্য কিছু করো। যোগ ফিটনেসের জন্য নয়। ফিটনেস হল যোগ অনুশীলনের একটি ফলাফল। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল, জীবনের জ্যামিতিকে সঠিক ভাবে নিরূপণ করা, কারণ, সমগ্র মহাজাগতিক বিশ্বের ভৌত রূপটি নিঁখুত জ্যামিতিক প্রকরণ।

কোনও বাড়ির কথা যদি ধরো, বাড়িটি মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়বে না দীর্ঘদিন একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নির্ভর করে বাড়িটির কাঠামোটি জ্যামিতিক ভাবে কতটা নিঁখুত তার ওপর। মানুষের শরীর থেকে শুরু করে সৌরজগত মায় সমগ্র মহাবিশ্ব – সব ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। 

পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে তার কারণ এই নয় যে, কোনও ধাতব তার দিয়ে সেটি আটকানো আছে, এই নিয়মানুগ ঘূর্ণনের কারণ জ্যামিতিক প্রকরণের সঠিকতা। ন্যূনতম ভ্রান্তিও যদি ঘটে, এটি মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তোমার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটবে। এই মহাবিশ্বের মৌলিক জ্যামিতির সঙ্গে সাযুজ্যহীন হয়ে গেলে তুমিও মুহূর্তে বিলীন হয়ে যাবে। 

যদি তুমি নিজেকে ফিট রাখতে চাও তবে কোথাও গিয়ে দৌড়াও, পাহাড়ে চড়ো, টেনিস খেলো বা অন্য কিছু করো। যোগ ফিটনেসের জন্য নয়। ফিটনেস হল যোগ অনুশীলনের একটি ফলাফল। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল, জীবনের জ্যামিতিকে সঠিক ভাবে নিরূপণ করা, কারণ, সমগ্র মহাজাগতিক বিশ্বের ভৌত রূপটি নিঁখুত জ্যামিতিক প্রকরণ

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল, শৈশব থেকেই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে জীবনের জ্যামিতিক বোধকে বিকশিত করা। তাহলে তুমি সহজেই মসৃণ জীবন নির্বাহ করার কাজে পারদর্শী হয়ে উঠবে। আমার জীবনে সর্বদাই সুন্দর কিছু ঘটবে, এমন ভাবনা দ্বারা চালিত মানুষরা জীবনের ময়দানে অনুপযুক্ত, যদি তুমি আনন্দকে সঙ্গী করে দুঃসময় পেরিয়ে আসার কৌশল না জানো, তাহলে জীবনের সব সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে তোমার জন্য। সামান্য বিপর্যয়কে যদি সামলাতে না পারো, জীবনের বৃহত্তর সম্ভাবনার ক্ষেত্রটি তোমার অজানাই থেকে যাবে। মহাজাগতিক জ্যামিতিক প্রকরণের সঙ্গে যদি নিজেকে সঙ্গতিপূর্ণ করে তুলতে পারো, একমাত্র তখনই জীবনের যে কোনও পরিস্থিতিকেই সানন্দে অতিক্রম করার সদিচ্ছা তৈরি হবে তোমার।

সম্পাদকের কথা: যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.

Youth and Truth Banner Image