সদগুরু ব্যাখ্যা করছেন, জীবন যখন এটা-ওটা, ভালো এবং মন্দের মধ্যে বিভাজিত হতে থাকে, তখন কেউ মৌনতা অনুভব করতে পারে না। এই দ্বৈতবোধ ঘুচানোই হল যোগের উদ্দেশ্য এবং এই কারণে আদিযোগী শিব এর অপর নাম সংহারক।

সদগুরু: এমন অনেক শিক্ষক আছেন যারা মানুষকে সদগুন শিক্ষা দেন। আবার অন্যান্য লোকও আছেন যারা মানুষকে অসৎ শিক্ষা দেন। কিন্তু আবার এমন শিক্ষকও আছেন যারা সমস্ত নীতিশিক্ষা, অহং-এর চিন্তা এবং আবেগের উর্ধে উঠে, জীবনকে তার নিজস্ব লয়ে চালিত করার জন্য ভালো এবং মন্দ দুটিকেই শেষ করার যথা সম্ভব চেষ্টা করেছেন । একমাত্র তবেই কেউ নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ মৌনতা অনুভব করতে পারবেন। ভালো মানুষেরা মৌন হতে পারেন না। দুষ্ট লোকেরাও মৌন হতে জানেন না। একমাত্র যারা ভালো এবং মন্দ কোনটারই তোয়াক্কা করেন না, শুধু জীবনের নিজস্ব প্রক্রিয়াটির দিকে সদা মনোযোগী, তারাই সত্যিকারের নীরব হতে পারেন।

এটা এবং শুধু এটাই

মৌনতা মানে আপনার নিজস্ব নানারকম জিনিসের ক্রমাগত চলতে থাকা নেই । মৌনতা মানে এই নয় যে আমি পাখির কলকাকলি বা সূর্যোদয়ের বজ্রনির্ঘোষ শুনতে পাবো না । মৌনতা মানে এটাই যে আমি কোলাহলটা সৃষ্টি করা থামিয়ে দিয়েছি । আপনার নিজেরই তৈরী এটা এবং ওটার বিভেদই হল সব কোলাহলের ভিত্তি। যখন এটা এবং ওটা আছে, তখন মৌনতা থাকতে পারে না। একমাত্র যেখানে এটা এবং শুধু এটাই আছে, সেখানেই মৌনতা থাকতে পারে। .

মৌনতা মানে এটাই যে আমি কোলাহলটা সৃষ্টি করা থামিয়ে দিয়েছি

সর্বত্র একটাই প্রশ্ন আসতে থাকে, " আমাকে কতটা আধ্যাত্মিকতা করতে হবে ?" আপনি যত বেশিই করুন না কেন, আপনাকে সমস্যায় পড়তেই হবে। আপনাকে শুধুমাত্র এটা এবং এটাই করতে হবে। অন্য সবকিছু এর সাথে মানিয়ে গেলে ঠিক আছে। যদি আপনি এটা এবং ওটা করেন আপনি টালমাটাল হয়ে পড়বেন- এভাবে হয় না। যাঁরা মানুষকে সদগুন শিক্ষা দেবার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরা তা করেন কারণ সেই সময়কার পথভ্রষ্ট সমাজে সামান্য শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে আর মানুষকে ফাঁদমুক্ত করতে গিয়ে, তারা ঠিক বিপরীতটাই শিখিয়েছিলেন।

একসময় কিছু মানুষকে শেখানো হল, "প্রতিশোধের বদলে প্রতিশোধ", তারপর আর একজন মানুষ এসে বললেন, " যদি কেউ তোমাকে এক গালে চড় মারে, তাহলে তাকে অন্য গাল বাড়িয়ে দাও। এটা ছিল শুধুমাত্র মানুষের তাৎক্ষণিক জটিলতার জাল কাটানোর জন্য। যদি মানুষ তাঁকে আর কিছুদিন বেশি জীবিত থাকতে দিত, তাহলে তিনি নিজেই হয়তো বলে যেতেন কিভাবে প্রয়োজনে কাউকে থাপ্পড় মারা উচিত। অথবা তিনি সেটাই শিখিয়েছিলেন যেটা সত্যিই প্রয়োজনীয় ছিল। অন্যান্য ব্যাপারগুলো মানুষ এমনিতেও শিখে যেত।

ভালো এবং মন্দের ধারণা

প্রত্যেকটি সদগুনের ধারণা কোনও না কোনও অন্ধবিশ্বাসের জন্ম দেয় । যখনই আপনি কোন জিনিসকে ভালো আর কোনও জিনিসকে মন্দ বলে চিহ্নিত করেন, তখনই আপনার বোধ বিকৃত হয়ে যায়। তা থেকে আপনার নিজেকে মুক্ত করার কোনও সুযোগ থাকে না। যত আন্তরিকভাবেই আপনি বোঝার চেষ্টা করুন না কেন, ওটা আপনার তখন সেটা উল্টোটাই মনে হবে। এই ধারণা ধ্বংস করতেই আমরা যোগের সৃষ্টি করেছি। এই কারণেই শিব, যিনি প্রথম যোগগুরু, সংহারক হিসেবে পরিচিত। যোগের পুরো ধারণাটাই হল এই সব জিনিসগুলো ধ্বংস করা, যেগুলো শুরুতে চমৎকার মনে হলেও, ধীরে ধীরে আপনার বন্ধনের ভিত্তি হয়ে ওঠে।

যখন শিব যোগ তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেন, তিনি এটি বিভিন্ন উপায়ে করেছিলেন। তিনি বলেন, একটা স্তরে এটা খুবই নিকটবর্তী। তিনি পার্বতীকে বলেছিলেন, "তুমি শুধু আমার কোলে এসে বস, এটুকুই, এটাই যোগ। " প্রাথমিকভাবে মনে হয় এটা কোন লোকের তার স্ত্রীকে কাছে টানার কৌশল। কিন্তু না, তিনি শুধু পার্বতীকে তার কোলে বসাননি। তিনি নিজের সত্তার একটা অংশ ত্যাগ করেছিলেন এবং পার্বতীকে নিজের অংশ করেছিলেন। যখন পার্বতী তাকে সব রকমের প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, "তুমি উদ্বিগ্ন হয়ো না, শুধু এখানে বসো , তাই যথেষ্ট। শুধু আমার কোলে উপবেশন করো, বাকী সব ঠিক হয়ে যাবে।" কিন্তু অন্যদের তিনি বিশদভাবে নানা প্রণালী শিখিয়েছিলেন। এমনভাবে বলেছিলেন যেন সত্য কোন দূর গ্রহের জিনিস, কিভাবে লক্ষ লক্ষ জটিল পদক্ষেপ নিতে হয়। সেই এক মানুষই দুরকম -ভাবে কথা বলেছিলেন।

সত্যের কোনও সুরাহার প্রয়োজন নেই

এই অংশটি সবচেয়ে সুন্দর- তিনি সত্যের সুরাহা করছেন না, যারা তাঁর সামনে বসে আছেন, তাদের সুরাহা করছেন কারণ সত্যের সুরাহা করা যায় না বা তার প্রয়োজনও নেই । মানুষ এই একটি ভুলই করেছে। তারা ক্রমাগতভাবে সেই পরম সত্বা-কে নিয়ে কিছু করতে চেয়েছে। তারা কখনও মানুষের সম্বোধন করেনি। তারা সব সময় সেই ভগবানকেই সম্বোধন করার চেষ্টা করেছে, যিনি তাদের ধারণায় পরম সত্বা। যে মূহুর্তে আপনি সেই পরম সত্বা-কে নিয়ে কিছু করতে যাবেন, আপনি বিভিন্ন রকম কাল্পনিক বিকৃতির বশবর্তী হবেন।

আপনি যখন কোন ডাক্তারের কাছে যান, তখন ডাক্তারের আপনাকে দেখার কথা। তিনি চোখ বন্ধ করে আপনার জন্য প্রার্থনা করবেন, এটা আপনি আশা করেন না।

যোগশাস্ত্র কখনও সেই পরম সত্বা-কে নিয়ে কিছু বলেনা। এটা শুধুমাত্র মানুষকে নিয়ে। পরম সত্বার ব্যাপারে কিছু করার নেই - কারণ তা পরম । তাকেই দেখতে হবে যে এই মুহূর্তে কিছু সীমাবদ্ধতার অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আপনি যখন কোন ডাক্তারের কাছে যান, তখন ডাক্তারের আপনাকে দেখার কথা। তিনি চোখ বন্ধ করে আপনার জন্য প্রার্থনা করবেন, এটা আপনি আশা করেন না। এজন্য আপনি তার কাছে যাননি। আপনি চান তিনি আপনাকে দেখুন এবং আপনার সমস্যাটা খুঁজে বের করুন।

একইভাবে মানুষ বিভিন্ন রকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেই পরম সত্বা-র জন্য কোনও সংগ্রাম নেই। মানুষকেই সংগ্রাম করতে হচ্ছে। মানুষ প্রতিটি ছোটখাট ব্যাপারে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষেরই সহায়তার প্রয়োজন আছে। যোগশাস্ত্রের সারমর্ম এটাই যে, সেই পরম সত্বা নয়, প্রত্যেক মানুষ এই মুহূর্তে যে যেমন অবস্থায় আছে তার সুরাহা করা।.