প্রশ্ন:নমস্কারম, সদগুরু। কৃষ্ণ তার আলোকপ্রাপ্তির আগে কি কোনও সাধনা করেছিলেন? তার জীবনে এমন অবস্থা কিভাবে এসেছিল?

সদগুরু: একজন মানুষের জন্য প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার মুহূর্ত থেকে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়া অবধি কেবল আনন্দ আর ভালবাসায় জীবন কাটানো, এটাই একটা দুর্দান্ত সাধনা। যখন কেউ আশেপাশে উপস্থিত থাকে তখন মানুষ হাসিমুখে থাকে, তবে যখন তারা একা থাকে এবং মনে করে কেউ দেখছে না, তখন যদি আপনি তাদের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন, তাদের হতাশ মুখগুলো তাদের সম্পর্কে সবকিছু বলে দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে শতকরা হিসাবের একটা বিরাট ভাগের কাছে তাদের নিজের সঙ্গই বেশ অপ্রীতিকর। আপনি যদি একা না থাকতে পারেন, তার মানে নিঃসন্দেহে এটাই বোঝায় যে আপনি কুসঙ্গে আছেন। আপনি যদি সৎসঙ্গ হতেন, নিঃসঙ্গ থাকাটা খুবই ভালো হত।

আপনার সামগ্রিক অস্তিত্বের মধুরতায় আপনার আবেগ, মন এবং শরীর স্বাভাবিক ভাবেই মধুর হয়ে ওঠে।

মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বেশিরভাগটাই একটি উৎসবের মতো, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব সর্বদাই একাকীত্বের। আপনি যদি নিজেকে একটা সুন্দর সত্তায় পরিণত করেন, তবে শুধু এখানে বসে থাকাটাই দুর্দান্ত হবে। আপনার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ভালবাসার জন্য - কেবল কোনও নির্দিষ্ট পরিস্থিতি, বা কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির দেখা পেলে নয় - আপনি যদি, নির্বিচারে, কেবলই প্রেমময় হতে পারেন, তবে আপনার বুদ্ধি সম্পূর্ণ অন্যভাবে বিকশিত হবে। নির্বাচন করতে গিয়ে, বুদ্ধিমত্তা পঙ্গু হয়ে পড়ে। প্রেমময় হওয়াটা অন্য কারোর জন্য উপহার নয়। এটা আপনার নিজের জন্যই একটা সুন্দর উপহার। আপনার সামগ্রিক অস্তিত্বের মধুরতায় আপনার আবেগ, মন এবং শরীর স্বাভাবিক ভাবেই মধুর হয়ে ওঠে। আর আজকের দিনে প্রচুর পরিমাণে বৈজ্ঞানিক নিদর্শন আছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে যখন আপনার শরীরতন্ত্র মধুর হয়, তখন আপনার বুদ্ধিমত্তা সব থেকে ভালো কাজ করে।

নিখুঁত সুরে

আপনি দেখবেন, যখন বিশ্রামের সময় আপনার হৃত্স্পন্দন প্রতি মিনিটে ৬০ বার হয়, তখন আপনি জগতের সুরের সঙ্গে সমন্বয়ে থাকেন। কর্মব্যস্ততার সময়ে এটা ওপর নিচ হতে পারে, কিন্তু বিশ্রামে থাকা কালীনও যদি আপনার হৃত্স্পন্দন ৬০-এর ওপরে হয়, তবে এটা একটু সমস্যা। বেশিরভাগ লোকেরই ৬৫ আর ৭৫-এর মধ্যে থাকে যখন তারা সুস্থ এবং স্বাচ্ছন্দে থাকেন। আপনি যদি কয়েকটি সাধারণ যৌগিক ক্রিয়া, যেমন সূর্য নমস্কার এবং শম্ভাবি মহামুদ্রা, ১৮ মাস ধরে অনুশীলন করেন, নিশ্চিত ভাবে এটি ৬০ হবে - আপনি জগতের সঙ্গে ছন্দে এসে যাবেন। আপনি যখন জগতের সঙ্গে এক সুরে বাঁধা, আপনি যখন প্রেমময় এবং আনন্দময়, তখন ফুলের মত বিকশিত হওয়াটা স্বাভাবিক, কারণ আমাদের এই অস্তিত্ব সেভাবেই তৈরী। এই অস্তিত্ব অবসাদগ্রস্ত এবং অসুস্থ হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। এটা তৈরি হয়েছে সুস্থ ও সবল থাকার জন্য।

শুধুমাত্র যখন আপনি কারোর সঙ্গে একই সুরে মিলে থাকা অনুভব করেন তখনই তাদের উপস্থিতিতে আপনি প্রীতিকর বোধ করবেন।

এই ছিল কৃষ্ণের সাধনা - তিনি তার চারপাশের জগতের সঙ্গে ছিলেন নিখুঁত সমন্বয়ে। তিনি শৈশবে যে ধরনের খেলাই খেলে থাকুন না কেন, তিনি সবকিছুর সঙ্গে পূর্ণ সমন্বয়ে থাকতেন। তিনি যে লোকেদের বাড়ি থেকে মাখন চুরি করতেন এবং তাদের সঙ্গে নানা ধরণের দুষ্টুমি-কৌতুক করতেন, কিন্তু তবুও তাকে সবাই ভালবাসতো, এর অর্থ এই যে তিনি তাদেরকে নিজের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। শুধুমাত্র যখন আপনি কারোর সঙ্গে একই সুরে মিলে থাকা অনুভব করেন তখনই তাদের উপস্থিতিতে আপনি প্রীতিকর বোধ করবেন। আপনি যদি সুরের অমিল অনুভব করেন, শুধুমাত্র তাদের দিকে দৃষ্টিপাতেই আপনি অপ্রীতিকর বোধ করবেন। প্রীতিকরতা এবং অপ্রীতিকরতা দুটিই ঘটতে পারে একই মানুষের সঙ্গে। আপনি যখন কোনও ব্যক্তির সঙ্গে এক সুরে বাঁধা থাকেন আর তার দিকে তাকান, তখন সেখানে থাকবে মধুরতা। কখনো কখনো, আপনি যখন এক সুরে বাঁধা থাকেন না, তখন অপ্রীতিকর অনুভূতি হয়। এটা ঘটবার জন্যে তাদের কোন ভুল করতে হয় না ।

তার জীবনের উদ্দেশ্যের অনুস্মারক

১৬ বছর বয়স অবধি কৃষ্ণের সাধনা ছিল তার চতুর্পাশের জীবনের সঙ্গে একই সুরে মিলে থাকা। তারপর তার গুরু সন্দীপন এলেন এবং তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে তার জীবনটা শুধু মাত্র খেলাধুলা নিয়ে থাকাই নয়, যে এর মধ্যে একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্য আছে। কৃষ্ণ এটা ঠেকিয়ে রাখবার একটু চেষ্টা করেন। তিনি যে গ্রামে থাকতেন সেই জায়গাটিকে ভালোবাসতেন, আর সেখানকার প্রত্যেকেই তাকে ভালবাসতেন। তিনি সম্পূর্ণভাবে নিবিষ্ট ছিলেন প্রত্যেকের প্রতি এবং তার চারপাশের সব কিছুর সঙ্গে - পুরুষ, নারী, পশু-প্রাণী এবং শিশু। তিনি বলেছিলেন "আমার কোন মহৎ উদ্দেশ্যের প্রয়োজন নেই। আমি শুধু এই গ্রামে থাকতে পছন্দ করি। আমি পছন্দ করি গাভীদের, গোপালকদের, গোপীদের। আমি ওদের সঙ্গে নাচতে চাই আর গাইতে চাই"। কিন্তু সন্দীপন বলেছিলেন "তোমাকে এর মুখোমুখি হতে হবে কারণ এই উদ্দেশ্যের জন্যই তোমার জন্ম। এটা ঘটা প্রয়োজন"।

লোকেরা তাকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন তারা জানত অসামান্যকিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু যেরকম অসামান্য ই হোক তারা জানত যে তারা হারাতে চলেছে তাকে।

কৃষ্ণ চলে গেলেন এবং গোবর্ধন পর্বত নামে পরিচিত একটা ছোট পাহাড়ের উপর উঠে দাঁড়ালেন। যখন তিনি নিচে নেমে এলেন, তিনি আর আগেকার সেই বালক রইলেন না। তিনি পাহাড়ের ওপর উঠেছিলেন এক আমুদে গ্রাম্য বালক হিসেবে এবং নেমে এলেন নিজের সম্বন্ধে অন্যরকম এক গুরুত্ব নিয়ে। লোকেরা তাকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন তারা জানত অসামান্যকিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু যেরকম অসামান্যই হোক তারা জানত যে তারা হারাতে চলেছে তাকে। যখন তারাই তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তখনও তিনি তাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে ছিলেন হাসতে হাসতে, কিন্তু তার চোখে প্রেম ছিল না - ছিল শুধু অন্তর্দৃষ্টি। তিনি এমন সব কিছু দেখতে লাগলেন যা তারা কল্পনাও করতে পারত না।

স্মরণিকার পরে, তার প্রথম সাহসিক কাজ ছিল তার মাতুল কংসকে বধ করা এবং যাদবদের উপর তার অত্যাচারের অবসান ঘটানো। তারপর তিনি নিজেকে আবদ্ধ করেন তার গুরু সন্দীপনের আশ্রমে, ভাই বলরাম এবং পিতৃ বা মাতৃ কূল সম্পর্কিত ভাই উদ্ধবের সাথে, এবং ব্রহ্মচারীর জীবন যাপন করেন পরের সাত বছর। ২২ বছর বয়স কাল অবধি তিনি গভীর আধ্যাত্মিক সাধনা করেন। তিনি অস্ত্র বিদ্যা শিক্ষা নেন এবং বিরাট মল্লযোদ্ধা হয়ে ওঠেন। তা সত্ত্বেও কিন্তু তিনি অর্জুন এবং ভীমের মত পেশীবহুল হননি।

একটি ভিন্ন প্রকৃতির সাধনা

কৃষ্ণ শান্ত স্বভাবের ও নরম প্রকৃতির রয়ে গেলেন কারণ তার সাধনা ছিল এক ভিন্ন মাত্রার এবং প্রকৃতির। সন্দীপন এটা এমনভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন যে এর বেশিরভাগটাই আভ্যন্তরীণ। যেহেতু কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের ছিলেন না তিনি এমন জীবন যাপন ও ক্রিয়া কর্ম করতেন যেন তিনি সত্য যুগের - তার জন্য সবকিছুই ঘটতো এক মানসিক স্তরে। সন্দীপনের মৌখিক কোন নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। সবকিছুই জ্ঞাপিত হত মানসিক ভাবে, সবই আয়ত্তে আনা হত মানসিকভাবে, সবই সাধিত হত মানসিকভাবে।

তিনি পেশীবহুল হননি কারণ তার সাধনা ছিল সম্পূর্ণরূপে মানসিক, আর তিনি তার জীবনে সেটা প্রদর্শিত করেছেন লক্ষ লক্ষ পৃথক রূপে।

যখন তারা তাদের সাধনা থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন একটা স্পষ্ট পার্থক্য ছিল কৃষ্ণ এবং তার ভাই এর মধ্যে। যেখানে বলরাম হয়েছিলেন বিশাল এবং পেশীবহুল, কৃষ্ণ শারীরিকভাবে যেরকম ছিলেন সেরকমই রয়ে গিয়েছিলেন। বলরাম তাকে বিদ্রুপ করতেন,"তুমি বোধহয় কিছুই করনি। আমি খুব পরিশ্রম করেছিলাম। আমি এক মহান যোদ্ধা হয়েছি। কেমন ভাবে এখনও তুমি একই রকম দেখতে আছো? "কিন্তু তবুও, কুস্তির আখড়ায় হোক অথবা তীরন্দাজী প্রতিযোগিতায়, কৃষ্ণের সঙ্গে কেউ পাল্লা দিতে পারত না। অসিযোদ্ধা হিসেবেও খুব নগণ্য সংখ্যক যোদ্ধাই তার কোনরকম ধারে কাছে আসতে পারতো। কিন্তু তিনি পেশীবহুল হননি কারণ তার সাধনা ছিল সম্পূর্ণরূপে মানসিক, আর তিনি তার জীবনে সেটা প্রদর্শিত করেছেন লক্ষ লক্ষ পৃথক রূপে।