সদগুরু: অনেক বছর আগে, আমি যখন প্রথম বার আমেরিকায় গিয়েছিলাম, ওরা আমাকে টি জি আই এফ (TGIF) নামের একটি রেস্তরায় নিয়ে গিয়েছিল। আমি এর পুরো নামটা কি জিজ্ঞেস করতে, ওরা বলল, “ থ্যাঙ্ক গড, ইটস ফ্রাইডে।”( অর্থাৎ “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আজ শুক্রবার।”) ওরা যেন সপ্তাহান্তের এই ছুটির জন্যই বেঁচে আছে। যদি আপনি সারা সপ্তাহ কষ্ট ভোগ করেন আর শুধু হপ্তাশেষের ছুটিটুকু নিয়ে বাঁচেন, তাহলে সে জীবন বড়ই দুর্দশাগ্রস্ত । কেন গোটা সপ্তাহটা উপভোগ করেন না - কেন শুধুই হপ্তাশেষটুকু উপভোগ করেন? তার কারন, একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ এমন কাজে বা পেশায় আছেন, যে কাজের কোনও মাহাত্মই নেই তাদের কাছে। যেটা তারা শুধু মাত্র জীবিকা নির্বাহ করার জন্য করছেন। 

সদগুরুর বাবা: নিষ্ঠার প্রতিমূর্তি 

আমার বাবা তাঁর সারা জীবন একজন অত্যন্ত একনিষ্ঠ চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ডাক্তার হয়েছিলেন কারন, মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন যক্ষা রোগের কারনে। তিনি কিভাবে তাঁর অসুস্থ মাকে দেখতে যেতেন, সে কাহিনী খুব মর্মস্পর্শী। রোগ সক্রমনের ভয়ে তাঁর মা তোয়ালেতে মুখ ঢেকে তাঁকে চুম্বন করতেন। সেই সময়ে চিকিৎসা বলতে বিশেষ কিছুই ছিল না। সুতরাং তাঁরা উচু টিলার উপর তাঁর জন্য একটা ছোট্ট ঘর বানিয়ে দিয়েছিল, তাঁরা ভেবেছিলেন হয়তো খোলা হাওয়া তাঁর যক্ষা সারিয়ে দেবে। কিন্তু তিনি মারা যান - মাত্র একুশ-বাইশ বছর বয়সে - এক সদ্যযুবতী। এঁরা ছিল একটি অত্যন্ত ধনী বনিক পরিবার, যেখানে স্বভাবতই বারো তেরো বছর বয়স হতে না হতেই ছেলেরা ব্যাবসায় ঢুকে পড়তো । কিন্তু তাঁর মা মৃত্যুর আগে তাঁকে বলেছিলেন, “তোমাকে ডাক্তার হতে হবে,” কারন তাঁর মনে হয়েছিল অন্য কোনও সেরকম ডাক্তার থাকলে হয়ত তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। 

আমি শুধু একটা কথাই জানতাম - আমি এখানে আছি বাঁচার জন্য। সমস্ত জীবই এখানে বাঁচার জন্য আছে। একমাত্র মানুষই মনে করে তারা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে।

সুতরাং আমার বাবা ডাক্তার হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিলেন। এবং বারো বছর বয়সে যখন তাঁর বাবা তাকে জোর করে ব্যবসায় ঢোকানোর চেষ্টা করলেন, তিনি তাঁর ধনী পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, এবং বাইরে রাস্তায় থেকে পড়াশুনা করলেন। তিনি পড়াশুনায় খুবই ভাল ফল করলেন এবং ডাক্তার হলেন। এর পর সবার প্রথমে তিনি মাইসোর যক্ষা আরোগ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা করেন। টানা তিন বছর এই আরোগ্য কেন্দ্রে তিনি পঞ্চাশ টাকা মাসিক বেতনে কাজ করেন। তিনি ছিলেন সেই ধরনের চিকিৎসক - যাঁরা সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত। পরে তিনি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করেন। তাঁর কাছে সাফল্যের অর্থ ছিল ডাক্তার হওয়া - যদি আপনি ডাক্তার না হন আপনি কোনও কাজের নন। অন্তত তার নিজের সন্তানদের ক্ষেত্রে সেটাই তিনি আশা করেছিলেন। তিনি ভবিষ্যতে যাতে দুঃখ না পান তাই দশ বছর বয়সেই আমি তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, “এই একটি জিনিস আমি কখনোই হচ্ছি না।” 

সামাজিক বিবেচনার ভিত্তিতে পেশা নির্বাচন? 

আমি বলেছিলাম, “আমি যদি কোন বিশেষ প্রশিক্ষন না নিই, আমি যা চাইবো তাই-ই করতে পারবো।”

সবসময়ই আমার বাবা আমাকে নিয়ে চিন্তিত থাকতেন যে কোনও বিষয়েই আমার তেমন প্রশিক্ষন হচ্ছে না। আমি যখন ডাক্তার হওয়ার ব্যাপারে “না”বলে দিলাম, তিনি নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে অবশেষে বললেন, “ বেশ, অন্ত্যত ইঞ্জিনিয়ারিং কর।” তখন আমি বললাম, “আমি যখন বললাম আমি ডাক্তার হতে চাই না, তখন যদি আপনি বলতেন ‘পশু চিকিৎসক হও,’ আয়ুর্বেদিক ডাক্তার হও,’ ‘হাতুড়ে ডাক্তার হও’ বা ওই রকম কিছু - আমি ভেবে দেখতাম। কিন্তু আমি যেই ডাক্তার হতে অস্বীকার করলাম, আপনি ইঞ্জিনিয়ার হতে বললেন - আপনার সমস্যাটা আসলে সামাজিক, অস্তিত্বের সমস্যা নয়। তখন তিনি বললেন, ”তাহলে তুমি কি করবে? তুমি তো কোনও প্রশিক্ষনই নিচ্ছ না।” আমি বললাম, “আমি যদি কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ না নিই, তাহলে আমি যা চাইবো তাই করতে পারবো।” 

আমি এ কথা তাঁকে অসম্মান করে বলছি না। তিনি এতটাই একনিষ্ঠ চিকিৎসক ছিলেন যে তিনি যেখানেই যেতেন মানুষ আক্ষরিক অর্থে তাঁকে পুজো করত। আমি তাঁর পেশাকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম, কিন্তু গুরুত্ব দিইনি । আমি যে এই কাজকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতাম তার কারন আমি নিজের চোখে দেখেছি এই কাজ মানুষের কি বিরাট উপকারে লাগে । আমার মা সব সময়ই নালিশ করতেন , কারন আমরা সব সময়ই এমন সব জায়গায় থাকতাম যে, যখন তখন বাবার ডাক আসত, এমন কি মাঝ রাত্রেও। আর উনি সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতেন। বহুবার হয়েছে, হয়তো উনি খেতে বসেছেন, ফোন বেজে উঠলো, উনি মাঝপথে খাবার ফেলে রেখে উঠে চলে যেতেন।  

মা অনুনয় করতেন, “মাত্র তিনটেমিনিটের ব্যাপার, খাওয়াটুকু শেষ করে যাও!” কিন্তু তিনি বলতেন, “না” এবং চলে যেতেন। আবার কখনো কখনো তিনি বাড়ি ফিরতেন রাত ২টো বা ভোর ৪টের সময়। ওনার এই বাপারটাই আমার সব থেকে আকর্ষনীয় লাগত - মানুষটি যে কাজটা করতেন তার প্রতি সম্পূর্ন সমর্পিত ছিলেন।

জীবিকা নির্বাহ করাটাই কি মুখ্য ব্যাপার? 

এই রকম নিষ্ঠার কারনেই আমি তাঁর জন্য গর্ব বোধ করতাম। কিন্তু আবার একই সঙ্গে তিনি আমাকে বলতেন কিভাবে রোজগার করতে হবে সেই সব কথা। “ ডাক্তার হও, রোজগার কর।” আমি বললাম, “আমি ওভাবে রোজগার করতে চাই না।” তখন তিনি বললেন, “ইঞ্জিনিয়ার হও, রোজগার কর।” আমি বললাম,”আমি ওভাবে রোজগার করতে চাই না।” তখন ওরা বললেন, “ অন্তত কোনও ব্যাবসা কর। কিছু উপার্জন কর।” আমি বললাম, “না।” বললাম, “উপার্জন করাটা কখনোই আমার চিন্তার বিষয় ছিলনা।” 

এটা বোঝা খুবই জরুরী যে, জন্মের মুহুর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা শুধুই জীবন, জীবন আর কেবল মাত্র জীবন - জীবন ছাড়া আর কিছুই না।

যখন আমার আল্প বয়স, আমি মোটর সাইকেলে সারা দেশ ঘুরেছি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ একা জঙ্গলে থেকেছি, গভীর অরন্যে টিকে থেকেছি বাইরের কোনও সাহাজ্য ছাড়াই। আমি বললাম, “আমি যে কোনও যায়গায় বাঁচতে পারবো।” তখন আমি জানতাম না আমি কিসের সন্ধান করছি। আমি শুধু জানতাম আমি টেবিলে বসে কাজ করে উপার্জন করব না - আমার কাছে এটুকু একশ শতাংশ স্পষ্ট ছিল। কী করব, তা আমি জানতাম না। আমি শুধু একটাই জিনিস জানতাম - আমি এখানে আছি বাঁচার জন্য। এখানকার প্রত্যেকটি জীব এখানে আছে বাঁচার জন্য। শুধু মানুষই মনে করে তাদের এখানে থাকার আরও অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে। 

আরও বেশি কিছু খুঁজছেন? 

অন্য সব জীব জানে তারা এখানে বাঁচতে এসেছে। এটাই যে, তাদের কাছে বেঁচে থাকা মানে, খাওয়া, ঘুমোন, বংশবৃদ্ধি করা এবং মরে যাওয়া - তাদের জীবন সম্পূর্ণ। কিন্তু যখনই আপনি মানুষ হয়ে আসবেন, যত খুশি খেতে পারেন, যত খুশি ঘুমোতে পারেন, আপনি যত খুশি বংশবৃদ্ধি করতে পারেন - তবুও জীবন যেন সম্পূর্ণ হয় না। আপনার ভিতরের জীবন অন্য আরও কিছু চায়। সেই “ অন্য কিছুটা” যদি না পাওয়া যায়, আপনি অসম্পূর্ণ বোধ করেন। 

ঠিক এই মুহুর্তে, সপ্তাহান্তের মানুষেরা - যারা শুধু সপ্তাহশেষের ছুটিতে বাঁচেন - মদ্য পান করেন, কারন তাদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা নেই। আমি এতটাই উদ্দীপনায় ভরপুর যে আমার বাইরে থেকে তা নেওয়ার দরকারই হয় না। শুধু যারা উদ্দীপনা হারিয়েছেন, তাদেরই বাইরের উদ্দীপনার প্রয়োজন হয়। তাদের বিরতির দরকার হয় - সেটা একদম ঠিক আছে । কিন্তু নিজের কাজ এবং জীবনকে এভাবে আলাদা করে দেখবেন না , এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । 

 

জীবন ছাড়া আর কিছু না। 

আপনি যা করছেন, তা যদি আপনার জীবন না হয়ে থাকে , তবে দয়া করে তা করবেন না। আপনি যা করছেন সেটাই আপনার জীবন হওয়া উচিৎ। এটাই আপনার জীবন। আপনাদের মধ্যে অনেকেই পরিবারের থেকে কাজের জায়গায় বেশি সময় দেন। তাহলে সেটা কেন আপনার জীবন আর এটা কেন নয়? কাজও তো জীবন। এটা জিবনের একটা দিক - ওটা আর একটা দিক। কিভাবে সময় ভাগ করবেন, কতটা বিরতি নেবেন, তা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যদি আপনি প্রত্যেক সপ্তাহান্তে বাড়িতে সময় দেন, নিশ্চই আপনার পরিবার সেটা উপভোগ করে। অন্য আর একটা পরিবারে হয়তো প্রত্যেক সপ্তাহে আপনাকে বাড়িতে নাও চাইতে পারে। এটা মানুষ এবং পরিস্থিত অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। এটা বোঝা খুবই জরুরী যে, জন্মের মুহুর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা শুধুই জীবন, জীবন আর কেবল মাত্র জীবন - জীবন ছাড়া আর কিছুই না।  

Editor’s Note: This article was originally published in the December 2019 edition of Forest Flower magazine. Click here to subscribe.