সদগুরু: গোরক্ষনাথ ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ খ্যাতিসম্পন্ন যোগীদের মধ্যে অন্যতম এবং আজও সেই খ্যাতি অটুট। তাঁর অনুগামীরা সাধারনত কানফট নামে পরিচিত - আর তাঁদের কানের বড় ফুটো দেখেই সবসময় তাদের চেনা যায়।

গোরক্ষনাথের গুরু ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। মৎস্যেন্দ্রনাথ, ছিলেন একজন অতি উচ্চমার্গের যোগী এবং অতিন্দ্রীয়বাদী, যাঁকে স্বয়ং শিবের অবতার বলে গণ্য করা হত। বলা যায়, তিনি প্রায় মানুষই ছিলেন না, তিনি ছিলেন পার্থিব জগতের অনেক উর্দ্ধের এক সত্তা। তিনি অত্যন্ত নির্জনে জীবনযাপন করতেন, লোকসমাজ থেকে দূরে, শুধু তাঁর গুটিকয়েক অগ্নিসম শিষ্য ছাড়া, যাদের মধ্যে গোরক্ষনাথ ছিলেন অন্যতম। গোরক্ষনাথ এসেছিলেন পশ্চিম উপকূল থেকে: যেখান থেকে এসেছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ‌ও - এমনকি আজও তাঁর নামে একটা পর্বত আছে।

প্রায় দু-হাজার বছর আগের ঘটনা:

একদিন গোরক্ষনাথ দেখলেন তাঁর গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ কোনও একজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য আসাম গেছেন, এবং তারপর তিনি আর ফিরলেন না। তিনি তাঁর অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা দেখলেন তাঁর গুরু দৈহিক সুখভোগে মগ্ন। এই দেখে তিনি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরলেন-"কি করে আমার গুরুর এই অবস্থা হতে পারে?" তাই তিনি পশ্চিম উপকূল থেকে হেঁটে আসেমের দিকে গেলেন, যার দূরত্ব ছিল তিন হাজার কিলমিটারেরও বেশি। তিনি সমস্ত পথ পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছে দেখলেন তাঁর গুরু এক পতিতার বাড়িতে বসে আছেন আর দুজন মহিলাকে কোলে নিয়ে আদর করছেন, শারীরিক আনন্দ ভোগ করার আশায়। তিনি এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি ভাবলেন "মৎস্যেন্দ্রনাথের সাথে এমনটা কিভাবে হতে পারে? তিনি তো স্বয়ং শিব"। গোরক্ষনাথ মৎস্যেন্দ্রনাথকে কত বিভিন্ন শক্তিশালী রূপে অনুভব করেছেন, আর এখানে সেই মানুষটি দুজন পতিতার সঙ্গে বসে আছেন।

তখন গোরখনাথ তাঁকে বললেন,"আপনাকে আসতেই হবে", তাঁর প্রচণ্ড মূর্তি দেখে পতিতারা ভয়ে চলে গেল। তিনি তাঁর গুরুকে সেখান থেকে বার করে আনলেন এবং নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন। পথে মৎস্যেন্দ্রনাথ স্নান করতে গেলেন। তাঁর হাতের ঝুলিটা গোরখনাথ কে দিয়ে বললেন, "এটা সামলে রেখো। এরমধ্যে অতি মূল্যবান জিনিস আছে।" এরপর তিনি নদীতে স্নান করতে নামলেন। ঝুলিটা ছিল খুব ভারী, তাই গোরক্ষনাথ সেটা খুলে দেখলেন ভিতরে দুটো বড় বড় সোনার বাট । দেখে তার মন ভেঙ্গে গেল,"আমার গুরুর একি হল? প্রথমে পতিতাদের সঙ্গে , আর এখন সোনা সংগ্রহ করছেন! তিনি চাইলে পাথরের উপর মূত্রত্যাগ করেই গোটা পাথরকে সোনায়ে পরিণত করে দিতে পারেন; তাঁর মধ্যে সেই মাত্রার অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু এই মানুষটির দুটো স্বর্ণ বাটের প্রতি এত আসক্তি। ‍ কিন্তু কেন?" আর তিনি সোনার বাট দুটো নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপর তাঁরা দুজনে ফিরে এলেন।

Gগোরক্ষনাথ নিজের গুরুকে, এভাবে পথভ্রষ্ট হতে দেখে চরম মনোকষ্টে ছিলেন, আর এখন তিনি গর্বিত অনুভব করছিলেন এইজন্যে যে, তিনি গুরুকে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য তিন হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটেছেন। যখন তাঁর মধ্যে এই গর্ব বোধ এল, মৎস্যেন্দ্রনাথ গোরক্ষনাথের মাথায় হাত রাখলেন, আর গোরক্ষনাথ হঠাতই উপুলব্ধি করলেন তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই বসে আছেন। না তিনি আসাম গেছেন হেঁটে, না দেখেছেন পতিতা, না দেখেছেন কোন সোনা - কিছুই না। এসবই ঘটছিল তাঁর মনের মধ্যে। কিন্তু তাঁর কাছে এসবই সত্যি ছিল-তিনি প্রকৃতপক্ষেই হেঁটেছিলেন, সেখানে গিয়েছিলেন এবং সেসব দেখেছিলেন। এসবই ঘটেছিল তাঁর গুরুর অলৌকিক ক্ষমতার বলে। মৎস্যেন্দ্রনাথ বাস্তবেই এই সবকিছু তাঁর চারপাশে তৈরি করেছিলেন। এবার গোরক্ষনাথ একেবারে ভেঙে পড়লেন- "আমিই এ সব ঘটিয়েছি।। আমি আমার গুরুকে পতিতাদের সঙ্গে কল্পনা করেছিলাম। আমি কল্পনা করেছিলাম আমার গুরু সোনার জন্য লালসায়ে ভুগছে " তিনি সম্পূর্ণভাবে মানসিক যন্ত্রনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন - তখন মৎস্যেন্দ্রনাথ বললেন,"আচ্ছা ঠিক আছে। অন্তত আমাকে রক্ষা করার জন্য তুমি তিন হাজার কিলোমিটার হাঁটতে তো প্রস্তুত। তোমার জন্য এটাই অসাধারণ; নিজের মধ্যে এটাই বজায় রেখো।"