প্রশ্নকর্তা: আজকাল, যদি কোন মহিলা গৃহিণী হয় বা কোন সামাজিক কর্মক্ষেত্রে যোগদান না করেন তাহলে তাদের প্রতি একটি অবজ্ঞার মনোভাব তৈরি হয়। এমনকি তাদের যদি ছোট বাচ্চা থাকে, তাহলেও এই মনোভাব বজায় থাকছে। এরকম পরিস্থিতিতে একজনের কি করা উচিত ? 

সদগুরু: সাধারণত, অর্থনৈতিক স্বছলতা সাধন করার জন্যই মানুষ কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেন। আপনি যে কাজটি করছেন সেটি যদি আপনি সম্পূর্ণ আবেগের অনুভূতি থেকে করেন তাহলে বিষয়টি আলাদা, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকেরা আর্থিক লাভের জন্যই কাজ করেন। তাই যদি পরিবারের জন্য অর্থের প্রয়োজন হয় তখন মহিলারা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতেই পারেন বা ঘরে থেকেও কাজ করতে পারেন। আপনার কাজ করা উচিত কিনা, সেই প্রশ্নটি জরুরি নয়। আপনার কাজ করার দরকার আছে কিনা সেটাই আসল বিষয়।

যদি আর্থিক প্রয়োজনের চেয়ে সামাজিক প্রয়োজনটা বেশি জরুরি হয়, তাহলে প্রতিটি মহিলাকে কাজ করতেই হবে এটা আমি মনে করি না। এই পৃথিবী জুড়ে এত প্রযুক্তি তৈরি করার একমাত্র উদ্দেশ্য হল, একদিন এমন একটি পৃথিবী আমরা তৈরি করব যেখানে পুরুষ বা মহিলা কাউকেই কাজ করতে হবে না। আমরা ছুটি কাটানোর মত করে জীবন কাটাতে পারি! কিন্তু অনেকেই কাজ করে যান কেবলমাত্র বাধ্যতামূলক কর্মের প্রক্রিয়াতে তারা আবদ্ধ হয়ে রয়েছেন বলে। নিজের সাথে কি করতে হবে, সে বিষয়ে তাদের ধারনা নেই। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মহিলাদের বিষয়ে যদি আসি, তাহলে, প্রতিটি মহিলারই উপার্জন করা উচিত - এই ধারনাটি গত ৪০-৫০ বছরে দুর্দান্ত গতি অর্জন করেছে। পুরুষদের ওপরে আর্থিক নির্ভরতা কারণে মহিলদের ওপর নানা রকমের শোষণ হয়ে এসেছে। মূলত সেই কারণেই এই মনোভাব তৈরি হয়েছে। তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে মহিলারা ভাবলেন, অর্থ উপার্জন করাই হল একমাত্র উপায়। তবে আমি মনে করি কেবলমাত্র কয়েকটি পরিবারেই এইরকম ঘটে থাকে। অনেক পরিবারের ক্ষেত্রেই এটি সত্যি নয়। কেবলমাত্র অর্থ উপার্জন করলেই আপনি একজন প্রকৃত মহিলা হতে পারবেন, এই ধারনাটি পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব থেকে অনুপ্রাণিত। নারীজাতি মুক্তির নামে, মহিলারা পুরুষদের মূল্যবোধকে গ্রহণ করেছেন। এটাই প্রকৃত দাসত্ব। যদি কোন নারী সত্যিই স্বাধীনতা চায় তাহলে কখনওই একজন পুরুষের মূল্যবোধকে গ্রহণ করবে না। তার এটি দেখা উচিত, কিভাবে তার নারীত্বকে এই পৃথিবীতে এক সৌরভময় ফুলের মত প্রস্ফুটিত করা সম্ভব। এটি কেবলমাত্র তিনিই করতে পারেন।  

জীবন মানে শুধুই সুস্থ থাকা নয়

আপনার অর্থ উপার্জনের কারণে কখনওই পৃথিবী সুন্দর হয়ে ওঠে না। কোনও স্বতন্ত্র ব্যক্তির জীবন হোক বা পরিবার, কনও সম্প্রদায় হোক বা এই বিশ্ব, সেটি তখনই সুন্দর হয়ে ওঠে যখন কিছু মানুষ তাদের অস্তিত্ব ভালবাসাকে ঘিরে তৈরি করেন

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে, আমার মা কখনওই বাইরে কাজ করতে যান নি, এবং আমার বাবাও কখন ভাবেননি যে তার কাজ করা উচিত। তার মানে কি তার কোন গুরুত্ব ছিল না? কখনওই না। ওনাকে ছাড়া আমাদের কি হত? উনি যেভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তার সন্তানদের এবং তার স্বামীর প্রতি, আজ আমরা যা হতে পেরেছি সেটা তার জন্যই।

ওনাকে শুধুমাত্র দেখেই আমাদের মধ্যে এটা বদ্ধমূল হয়েছে যে, মানুষের প্রতি কিভাবে যত্নবান হতে হয়, কেবল নিজের কল্যাণের কথা ভাবা ছাড়াও জীবনকে কিভাবে দেখতে হয়। এই ব্যাপারটা কারোরই অগোচর হত না, কারণ, তার সারা জীবনটাই ছিল অন্যদেরকে কেন্দ্র করে, নিজেকে নিয়ে নয়। দিন হোক বা রাত, অত্যন্ত আনন্দের সাথে, তিনি তার পরিবারের সেবা করতেন। এটি কোন দাসত্ব ছিল না, শর্তহীন ভালবাসার থেকে তিনি এটি করতেন। যদি আপনি ওনাকে বলতেন যে উনি শোষণের শিকার হচ্ছেন, তাহলে উনি গভীরভাবে অসন্তুষ্ট হতেন। কারণ, এইরূপ জীবনযাপন করা তার জন্য এক অপূর্ব প্রেমের অভিব্যক্তি ছিল।

আপনার অর্থ উপার্জনের কারণে কখনওই পৃথিবী সুন্দর হয়ে ওঠে না। কোনও স্বতন্ত্র ব্যক্তির জীবন হোক বা পরিবার, কোনো সম্প্রদায় হোক বা এই বিশ্ব, সেটি তখনই সুন্দর হয়ে ওঠে যখন কিছু মানুষ তাদের অস্তিত্ব ভালবাসাকে ঘিরে তৈরি করেন, এবং নিজেদের ব্যক্তিগত কল্যাণের উর্দ্ধে গিয়ে অন্যদের জন্য কিছু করতে চান। এটাই প্রকৃতভাবে বিশ্বকে সুন্দর করে তোলে।

একটি পরিবার বিশ্ব সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্রতম একক, এবং এটি যদি পরিবারে না ঘটে তাহলে পৃথিবীর কোথাও ঘটবে না। কোন শিশু যদি এই ভালবাসা এবং উৎসর্গের অনুভুতি ছোট থেকেই না অনুভব করেন তাহলে কখনওই এটি সম্ভব হবে না।

একটি পরিবর্তন আনা

এর অর্থ এই নয় যে কোন মহিলা অর্থ উপার্জন করলে এটি করতে পারবেন না। যদি অর্থের প্রয়োজন হয় তাহলে তাঁকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। আরও একবার আমার মাকে উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যাক। তিনি অর্থ উপার্জন করতে বাইরে যেতেন না, কিন্তু তিনি বাড়িতে থেকে যা যা করা সম্ভব সেটি করতেন, যেন দোকানে যাওয়ার প্রয়োজন না হয়, এটি নিশ্চিত করতেন।

আমার শৈশবকাল জুড়ে, আমার পারিবারিক জীবন থেকে সরে আসার আগে অবধি, আমি কখনো কারুকার্য করা বালিশ ছাড়া ঘুমাইনি। তিনি সবসময় এটি নিশ্চিত করতেন যে বালিশে কিছু না কিছু সূচের কাজ করা থাকত - একটি তোতা পাখি, একটা ছোট্ট ফুল, কিছু একটা। এটা না থাকলে, আমার জীবন অন্যরকম হত। তিনি এটি দোকান থেকে কিনতে পারতেন। আমার বাবার এগুলি কেনার মত সামর্থ্য ছিল, কিন্তু তাও তিনি এটি নিশ্চিত করতেন যে এই ছোট কাজটি যেন তিনি নিজেই করেন। এটি ছিল তার অবদানের উপায়। আপনি অর্থ উপার্জন করুন বা অর্থ সাশ্রয় করুন, উভয়ই আপনার পরিবারের জন্য অবদান। সুতরাং, কোনও নির্দিষ্ট মহিলা কীভাবে কাজ করে তা একটি স্বতন্ত্র বিষয়। তবে কারোরই এমন কোনও দর্শন নিয়ে চলার প্রয়োজন নেই যে সকল মহিলাদের কাজ করা উচিত বা সকল মহিলাদের কাজ করা উচিত নয়।