সদগুরু একজন বস্তুবাদী এবং একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্যের, এবং কেন আধ্যাত্মিকতা জীবনের সঙ্গে একটা অপরিবর্তনীয় প্রণয়লীলা, তার উপর দৃষ্টিপাত করছেন।

সদগুরু: কিছুকাল আগে আমি সিঙ্গাপুরের এক অন্যতম ম্যানেজমেন্ট ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্রশিক্ষণ কলেজের শিক্ষক সম্প্রদায়কে সম্বোধন করছিলাম। যেহেতু আমি খুব দ্রুত পরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্বোধন করে বেড়াচ্ছিলাম, এই অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "ভাষণের বিষয়বস্তু কি? আমার কি বিষয়ে বলার কথা?" তারা বললেন,"নেতৃত্ব সম্বন্ধে কিছু।" আমি যখন খুব দ্রুত পদে কলেজের দিকে এগোচ্ছিলাম, তখন আমার চোখে পড়লো আমার ছবি সম্বলিত একটা পতাকা যেটায় লেখাছিল, "ভারতবর্ষ থেকে আসা একজন অনুপ্রেরণামূলক বক্তার দ্বারা নেতৃত্ব বিষয় নিয়ে বাক্যালাপ।" তাই আমি ভাবলাম কোন কোন জিনিসগুলো মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয় কিছু করবার জন্য, এবং কখন আর কেন মানুষের অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হয়? শুধুমাত্র যখন আপনি সত্যিই কিছু একটা করতে চান না তখনই আপনাকে অনুপ্রাণিত করার প্রয়োজন হয়। যখন আপনি সত্যিই কিছু করতে চান তখন আপনার অনুপ্রেরণার প্রয়োজন নেই। সান্ধ্যভোজনে যাওয়ার জন্য কি আপনাকে অনুপ্রাণিত হতে হয়? না, কিন্তু আপনাদের মধ্যে কারুর কারুর হয়তো অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হয় সাধনারজন্য সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে।

যখন মানুষ যথার্থই অনুপ্রাণিত হয় তখন তাদের দ্বারা অনেক মহৎ কার্য সিদ্ধ হয় - আর তা না হলে তারা একেবারেই বুদ্ধিহীন কাজ করে। প্রেরণা সব সময় জ্ঞান সাথে নিয়ে আসে না। আমরা যদি গভীর উদ্দেশ্যমূলক এবং লক্ষ্য-নিষ্ঠ কিছু সৃষ্টি করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রয়োজন অনেক বিবেচক এবং লক্ষ্য-নিষ্ঠ মানুষের যাদেরকে অন্য কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে হয় না কারণ তারা পরিষ্কারভাবেই এটা জানেন, "আমরা ঠিক এই জিনিসটা করতে চাই।" আমরা কি করতে চাই এটা যদি স্পষ্ট হয়, তাহলে আমরা যা চাই তা সৃষ্টি করার ক্ষমতা আমাদের একদল অনুপ্রাণিতদের থেকেও অনেক বেশি থাকবে। স্বল্পমেয়াদি কাজকর্মের জন্য একদল অনুপ্রাণিত মানুষ ঠিক হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী কাজকর্ম কেবলমাত্র সেরকম লোকজন দিয়েই হতে পারে যারা আর কিছু না হোক, প্রকৃত পক্ষে সেটাই করতে চায়।

বস্তুবাদী এবং আধ্যাত্মিক: পার্থক্যটা কোথায়?

একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি এবং একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্যটা শুধুই এই: একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি একটা কুকুরের মতন যার সামনে একটা হাড় ঝোলানো আছে তার দৌড় জিতবার জন্য। কুকুরটা হাড়টা পাবার আশায় জোরে, আরো জোরে দৌড়ায়, কিন্তু সেটা কখনই হয়ে ওঠে না। একজন বস্তুতান্ত্রিক ব্যক্তিকে তার বাহ্যিক পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত কশাঘাত করে চলে। একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির কোন বাহ্যিক কশাঘাতের প্রয়োজন পড়ে না যেহেতু তিনি প্রকৃতপক্ষে যা করতে চান সেটাই করছেন।

আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া জীবনধারণের জন্য অনেক বেশি বুদ্ধিমান উপায় কারণ তার মানে হল আপনি সৃষ্টিকর্তার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একই সুরে বাঁধা। আপনি যাই ভাবুন না কেন তার কোনই তুলনা চলে না সেই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যা এই শরীর তৈরি করছে, যা মাটি থেকে একটা ফুল তৈরি করছে, মাটি থেকে খাবার, খাবার থেকে মানুষের শরীর, আবার মানুষের শরীর থেকে মাটি; যার কারণে গ্রহেরা আবর্তিত হচ্ছে, মহাকাশে নক্ষত্রপুঞ্জগুলো তাদের কাজ করে চলেছে - সেই যা সৃষ্টির একমাত্র ভিত্তি। আপনি যে ধরনেরই অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাধারার উদ্ভাবন করুন, যে ধরনেরই সমীকরণ বা সূত্র রচনা করে থাকুন, সে সবই সেই বুদ্ধিমত্তাকে বোঝবার প্রচেষ্টা, যা সৃষ্টির উৎস।

আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া জীবনের সঙ্গে একটা বিচ্ছেদ নয়। এটা জীবনের সঙ্গে অপরিবর্তনীয় এক প্রণয়লীলা।

আপনি যেটা বিজ্ঞান ভাবেন সেটা হল সৃষ্টিকর্তার বুদ্ধিমত্তাকে বোঝবার শুধুই একটা প্রচেষ্টা। আপনি যাকে প্রযুক্তি বলেন সেটা শুধু ইতিমধ্যে বিদ্যমান জীবনের প্রযুক্তির একটা নগণ্য অনুকরণ মাত্র। তাই আপনি যেটা মানুষের বুদ্ধিমত্তা ভাবেন - যৌক্তিক বুদ্ধিমত্তা - তা সেই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তুলনীয় নয় যা সৃষ্টির ভিত্তি। আপনি যদি সেই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এক হয়ে যেতে ইচ্ছুক হন, যা সৃষ্টির উৎস, তাহলে আপনি হলেন আধ্যাত্বিক। সাধারণত, বস্তুতান্ত্রিক জীবন সেই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটা কি ভুল? খাবার খাওয়া, জামা কাপড় পরা, বাস করবার জন্য একটা বাড়ি থাকা কি ভুল? এটা সেটা করা কি ভুল? প্রশ্ন সেটা নয়। আপনি যদি জীবনের পার্শ্ব পদকে প্রধান পদ হিসেবে গণ্য করেন তাহলে সেটা হবে মূর্খের মতন জীবনধারণ। আমরা বাড়ি তৈরি করি, আমরা জামা কাপড় পরি, আমরা খাবার খাই, আমরা সব কিছু করি কারণ আমরা জীবন ধারণ করতে চাই, আর সেটা সম্পূর্ণভাবে। আমরা শুধু জীবন ধারণ করতেই চাই না, আমরা জীবনকে জানতে চাই পরিপূর্ণরূপে।

শুধুমাত্র জীবনের খোলসটা উপভোগ করা বেঁচে থাকা কোন বুদ্ধিপূর্ণ উপায় নয়। আধ্যাত্বিক প্রক্রিয়া হল জীবনের ফল, জীবনের রস, জীবনের মূল উপভোগ করা। আমরা শুধু একে আস্বাদন করতেই চাইনা, আমরা একে জানতে চাই এবং উপলব্ধি করতে চাই অখন্ড রূপে।

আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া: জীবনের সঙ্গে এক প্রণয়লীলা

আধ্যাত্বিক প্রক্রিয়া জীবনের সঙ্গে একটা বিচ্ছেদ নয়। এটা জীবনের সঙ্গে অপরিবর্তনীয় এক প্রণয়লীলা। এর প্রয়োজন কিসের জন্য? কেবলমাত্র এই কারণে যে বাঁচবার জন্য এটা একটা আরও বেশি বুদ্ধিমান উপায়। কোন মানুষই জেনেশুনে চাইবে না বোকা হয়ে থাকতে। এমনকি যে বোকামি করে বেড়ায় সেও আদতে দেখাতে চায় যে সে কত বুদ্ধিমান। কিন্তু আপনি যদি ভাবেন আপনি অন্যতম এক অনন্য সৃষ্টি, আপনার জীবনের চিন্তাভাবনা, আপনার অনুভব এবং উপলব্ধি এমন হয় যেন জাগতিক অস্তিত্বে আপনি একমাত্র বিদ্যমান, তখন আপনার তথাকথিত বুদ্ধিমত্তাই আপনার বিরুদ্ধে কাজ করবে।

এটা ঘটেছিল ফরাসি বিপ্লবের পরে পরেই। ফরাসিরা মানুষের মুন্ডচ্ছেদ করার জন্য গিলোটিন যন্ত্র কে নিখুঁতভাবে তৈরি করেছিল। যেহেতু তারা এই যন্ত্রটা তৈরি করেছিল, তাদের যেন যত বেশি বার সম্ভব এর ব্যবহার করতে হত। যেখানেই হোক না কেন মস্তক দেখলেই তাদের তাকে কেটে নামানোর কথা বলা হত। একদিন, তিনজন মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল - একজন উকিল, একজন পুরোহিত, এবং একজন বাস্তুকার। তারা উকিলকে পাটাতনের উপর শুইয়ে দিল মাথার উপর একটা ঢাকনা দিয়ে এবং গিলোটিনের ফলাটায় টান দিল - ফলাটা পড়ল না। প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা! আইনানুসারে তাকে মুহুর্তের মধ্যে মেরে ফেলার কথা তাদের। কিন্তু এখন তারা তাকে সেখানে দণ্ডের জন্য অপেক্ষার অত্যাচার ভোগ করিয়েছেন অথচ দন্ডদান সম্পন্ন হলো না, যার অর্থ এই যে আগামীকাল সে হয়তো তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে - তাই তারা তাকে ছেড়ে দিলেন। এবার তারা পুরোহিতটাকে পাটাতনের উপর শুইয়ে দিলেন এবং টান দিলেন। পুনরায় কিছুই ঘটল না। তারা ভাবলেন এ নিশ্চিত দিব্যের হস্তক্ষেপ এবং তাকে ছেড়ে দিলেন। বাস্তুকার বেছে নিলেন মাথার ঢাকনা ছাড়াই প্রাণদণ্ডে নিতে । শায়িত অবস্থায় তিনি উপরের দিকে তাকালেন এবং বললেন, "দেখো আমাকে তোমাদের বলতে দাও, এর সমস্যাটা কোথায়!"

যদি কেবল জীবনের খোসাটুকু খান, তবে সে হবে এক বুদ্ধিহীনের মত অস্তিত্ব। আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া হলো জীবনের ফল খাওয়া, জীবনের নির্যাস, জীবনের শাঁসকে খাওয়া।

ঠিক এই মুহূর্তে মানুষের মেধা এই ভাবেই কাজ করছে। আমাদের অন্তঃস্থলে এবং সবকিছুতেই সৃষ্টির মূল উৎস যে বুদ্ধিমত্তা এটা তারই এক বিকৃতি। প্রতিটি জিনিস যা আপনি স্পর্শ করেন তার মধ্যে - যে খাদ্য আপনি গ্রহণ করেন, যে বাতাসে আপনি নিঃশ্বাস নেন, যে পৃথিবীর উপর আপনি হেঁটে বেড়ান আর সেই শূন্য জায়গায় যেখানে আমরা বিদ্যমান - যিনি এদিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেন, তাঁর কাছে এই সব কিছুতে সৃষ্টিকর্তার হাত খুবই স্পষ্ট। একজন মানুষ সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা করতে পারে সেটা হল ওই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একই সুরে বাঁধা থাকতে এবং এটা নিশ্চিত করতে যে তিনি যেন সৃষ্টিকর্তার হাত বিকৃত না করেন। "এরই মধ্যে, আমি কি আমার জীবন ধারণ করতে পারি? আমি কি যা চাই তাই করতে পারি?" আপনি যা চান সব কিছু করতে পারেন এবং তা সত্বেও সৃষ্টিকর্তার হাত বিকৃত করবেন না যদি আপনি - শুধুমাত্র যদি আপনি একই সুরে বাঁধা থাকেন। আপনি যদি এর সুরে বাঁধা না থাকেন, তাহলে আপনি হয়ে যান এক অনন্য বুদ্ধিমত্তা। সৃষ্টি এর জন্য জায়গা করে দেয় না।

একটা আধ্যাত্বিক প্রক্রিয়ায় দীক্ষিত হওয়ার অর্থ হল আপনার অন্তঃস্থলের সেই বুদ্ধিমত্তা যা সৃষ্টির উৎস - আপনি তাকে কার্যকর হতে দেন। আপনার মূর্খ মস্তিষ্কের প্রয়োগ করেন না। এর অর্থ এই নয় যে আমি বুদ্ধিমত্তার বিরোধী। তা আমি নই। আজ পৃথিবীতে অনেক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে। কম্পিউটারগুলো সত্যিই বুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে উঠছে, কিন্তু কোন কম্পিউটার কখনই একজন মানুষের সমকক্ষ হতে পারে না। ভবিষ্যতে কোনো এক সময় হয়তো এমন কম্পিউটার তৈরি করা হতে পারে, মানুষেরা এখন যেসব কাজ করছে, সেইসব প্রায় সমস্ত কাজই করার জন্য - কিন্তু কম্পিউটার কখনই মানুষের মুর্খামির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উঠতে পারবে না।

Intellect is not the problem. The problem is that you become an exclusive intelligence, not an inclusive intelligence. The word yoga means “union.” Union means inclusiveness, to become an inclusive intelligence, so that your intelligence does not in any way distort the intelligence which is the source of creation within you and in everything.

Editor’s Note: The ebook “Inner Management”, contains more of Sadhguru’s wisdom on opening up a new dimension that frees us from external influences. Set "0" in the price field to download for free.

Inner Management