মহাভারতের অনেক গল্পের মধ্যে একটি, যা কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তা এবং ক্রীড়াশীল দুষ্টুমির কথা বলে। এই গল্পটি এমন একটি বিষয় সম্পর্কে যেখানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে দুর্যোধন ও অর্জুন উভয়ই যায় কৃষ্ণের কাছে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগদান করতে। দুর্যোধনের মনোভাব এবং নির্বাচনের জন্যে তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হয়, যদিও তিনি তত্ক্ষণাৎ তাঁর বোকামি বুঝতে পারেন না।

সদগুরু: মহাভারতে একটি সুন্দর ঘটনা ঘটেছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আসন্ন। তখন দুটি মাত্র পক্ষ - কৌরব এবং পাণ্ডব, এবং এই দুই দল প্রচার চালাচ্ছে। তারা যত সম্ভব সমর্থন জোগাড় করতে চেষ্টা করছে, কারণ এক একজন মানুষ গুরুত্বপূর্ণ। আপনি চাইবেন আপনার কাছে সর্বাধিক বৃহৎ সৈন্যদল থাকুক, কারণ যুদ্ধ কোনো নির্বাচন নয়, এটা জীবন–মৃত্যুর খেলা। তারা একের পর এক সাম্রাজ্যে গিয়ে প্রচার চালাল এবং উভয়পক্ষই বিশাল সৈন্যদল জড় করল।

Puppets from a Wayang beber play depicting the Mahabharata in Indonesia. From right: Drona, Duryodhana, Karna and Dushasana.

কৃষ্ণ কোনো রাজা নন, তবে তাঁর দশ হাজারেরও বেশি সৈন্যের একটি প্রশিক্ষিত সেনা রয়েছে, যারা প্রচুর অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে। তার সৈন্যদল এক বিশাল সম্পদ। কৃষ্ণ তখন দুপুরের সময় ঘুমের ভান করছেন। তিনি এই রকম - ঘুমের ভান করছেন কারণ যখন আপনি জানেন যে পরবর্তী পদক্ষেপটি কী এবং আপনি খেলাটিকে নষ্ট করতে চান না, তখন কিছুটা ছলনা করতেই হয়। তাই বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে তিনি ঘুমের ভান করছিলেন।

কৌরবদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন এসে এই ঘরে ঢুকলেন এবং দেখলেন কৃষ্ণ ঘুমাচ্ছেন। তিনি তাঁর জাগার অপেক্ষায় বসে রইলেন। এদিকে, কৃষ্ণ মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি মেখে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর পা দুর্যোধনের দিকে করা ছিল। দুর্যোধন এটি দেখলেন এবং তার এই ব্যাপারটা পছন্দ হল না। তিনি ভাবলেন, “কৃষ্ণ তো রাজাও নন; তিনি এক গোপালক মাত্র, আর আমি এক মহান সম্রাট! আমি কেন তাঁর পায়ের কাছে বসবো?” এই ভেবে তিনি আস্তে আস্তে উঠে কৃষ্ণের মাথার কাছে এসে বসলেন। তখন অর্জুন এলেন - তিনি কৃষ্ণের ভক্ত। দুর্যোধন যেখানে আগে বসেছিলেন তিনি সেখানে গিয়ে বসলেন। কৃষ্ণের পা তাঁর দিকে করা ছিল, এটি অর্জুনের কাছে আশীর্বাদের মতন। তাই তিনি সেখানেই বসে রইলেন। কৃষ্ণ কিছুক্ষণ পরে চোখ খুললেন - ঘুম থেকে ওঠার ভান করে! দেখুন, এই হল সমস্যা। একবার ঘুমের ভান করলে ঘুম থেকে ওঠার ভান ও করতে হয়। একটি কর্ম থেকে আরও অনেক কর্মের ধারা তৈরি হয়।

 

তিনি ঘুম থেকে ওঠার ভান করলেন, চোখ খুলে বললেন, “ওহ্, অর্জুন! তুমি এসেছ!” অর্জুন বললেন, “হ্যাঁ ভগবান, আমি এসেছি।” তাঁরা আর কোনো কথা বলার আগে দুর্যোধন নিজের উপস্থিতি জানানোর জন্য তাঁর গলা ঝাড়লেন। কৃষ্ণ বললেন, “ওহ দুর্যোধন, তুমিও! তোমরা দুজনেই এক সাথে এসেছ – বল কি কারণে এসেছ তোমরা।" যদিও, কৃষ্ণ সবকিছুই জানেন।

তখন দুজনেই বললেন যে তাঁরা যুদ্ধে তাঁর সাহায্য চাইতে এসেছেন। কৃষ্ণ বললেন, “তোমরা দুজনেই এসেছ এবং তোমরা দুজনেই একই জিনিস চাইছ। আমার বক্তব্য এটা – তোমাদের মধ্যে একজন আমার সৈন্যদল কে নিতে পারো, অন্যজন আমাকে নিতে পারো। তবে আমি লড়াই করব না, আমি কেবল সঙ্গে থাকব। যেহেতু আমার দৃষ্টি প্রথমে অর্জুনের উপরে পড়েছিল, সেই প্রথমে চাইবে!” দুর্যোধন বলে উঠলেন, “আমি এখানে প্রথম এসেছি!” কৃষ্ণ বললেন, “তাতে আমি কী করতে পারি? আমি অর্জুনকে প্রথমে দেখেছি।”

তখন কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, "তুমি যেটা চাও, বেছে নাও।" অর্জুন বললেন, "ভগবান, আমরা আপনাকে চাই, আপনার সেনাবাহিনীকে নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমরা শুধু আপনাকে আমাদের সাথে পেতে চাই।” কৃষ্ণ সতর্ক করলেন, “আমি কিন্তু তোমাদের পক্ষে লড়াই করব না। আমি কেবল তোমাদের সঙ্গে থাকব।” অর্জুন বললেন, “আপনাকে কিছু করতে হবে না, আমরা কেবল আপনাকে আমাদের সাথে চাই”। এটা দেখে দুর্যোধন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাঁচলেন এবং খুব খুশি হলেন! তিনি পাণ্ডবদের বোকা ভাবতেনই, কিন্তু তিনি কখনও ভাবেন নি যে এরা এতোটাই বোকা, যে তারা দশ হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্যদের বিরুদ্ধে একজনকে বেছে নেবে। তার ওপর, সেই একজন মানুষটি যুদ্ধও করবেন না! শুধু পাণ্ডবদের সাথে থাকবেন, তাদের রথ চালাবেন। ১০,০০০ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যকে না নিয়ে একজন মানুষকে নেওয়া যিনি কিনা যুদ্ধও করবেন না – এটা বোকামির চরম পর্যা! কিন্তু সেই নির্বাচনটিই সমস্ত পার্থক্য করে দেয়, যুদ্ধের পরিণতির ওপর বিপুল প্রভাব ফেলে।