চোরকে কীভাবে হারানো যেতে পারে - একটি জেন্-এর গল্প
একটি স্বভাব-চোর বারবার ধরা পড়তো। তাকে কি করা উচিত? এখানে বলা দুটি গল্প শাস্তি, করুণা ও মানব চরিত্রের বিষয়ে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
একজন ব্যক্তি অসহনীয় ক্ষুধা আর দারিদ্রের মধ্যে বাস করতে করতে ছোট ছোট চুরি করতে শুরু করে। সে ধরা পড়ে জেলে যায় এবং সেখান থেকে বার বার পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে; কিন্তু প্রতিবারই ধরা পরে যায়। এভাবে তার জেলের শাস্তি প্রত্যেকবার বেড়ে যেতে থাকে। অবেশেষে, অনেক বছর পরে, সে সমাজে আরেকবার ফিরে আসে।
শীত ও ক্ষুধা তাকে পীড়িত করত। পয়সা-কড়ি তার কিছুই ছিল না এবং এক বেলা খাবার অর্জন করার সামর্থও ছিল না। একজন দাগী আসামিকে কেউই বিশ্বাস করতে বা কাজে নিতে রাজি ছিল না। সে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ালো কিন্তু সে যেখানেই গেল, সবাই তাকে তাড়িয়েই দিল। একটি গ্রামে লোকেদের হাতে মার খেয়ে সে শেষমেশ ওই গ্রামেরই পুরোহিতের বাড়িতে আশ্রয় পেল।
সে পুরোহিতের কাছে ওরকম সাদর অভ্যর্থনা আশা করেনি - "এটা হলো ভগবানের বাড়ি। একজন অপরাধী হোক বা পাপী, এখানে যারাই আশ্রয় খুঁজতে আসে সবাই ঈশ্বরের সন্তান।" এভাবে পুরোহিত তাকে সান্তনা দিল, খাবার দিল, জামাকাপড় দিল আর থাকার ঘর দিল।
সে ভাল করে খেল, ঘুমাল, তারপর মাঝরাতে নতুন উদ্যম নিয়ে জেগে উঠল। তার দৃষ্টি পড়ল ঘরের কিছু রুপোর বাসনপত্রের উপর। চুরির প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে, সে একটা তুলে নিয়ে চম্পট দিল। একবারও ভাবল না, তাকে যে আশ্রয় দিয়েছে তাকে প্রতারণা করা হবে।
গ্রামের মধ্যে রুপোর বাসন নিয়ে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে সে গ্রামবাসীদের সন্দেহের চোখে পড়ল। পুলিশ তাকে ধরল এবং জিজ্ঞাসাবাদ করল। তার কাছ থেকে কোনও সদুত্তর না পেয়ে, পুলিশ তাকে পুরোহিতের বাড়ি নিয়ে গেল। "আমাদের ধারণা যে ও আপনার কাছ থেকে এই রূপোর জিনিস চুরি করেছে। আপনি দেখে বলবেন এটা আপনার কিনা?" পুলিশ পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করল।
মানুষটি কাঁপতে লাগল এই ভেবে যে ,তার চুরি ধরা পরে যাবে আর তাকে আবারও অনেক বছরের জন্য জেলে পাঠানো হবে।
কিন্তু পুরোহিতের মুখ করুণায় ভরপুর ছিল। তিনি বললেন, "বন্ধু আমার, আমি এর সাথে রুপোর মোমবাতিগুলোও তোমাকে দিয়েছিলাম। ওগুলো তুমি ফেলে রেখে গেছ কেন?" তারপর তিনি মোমবাতিগুলো তাকে দিলেন। পুলিশ বলল, "আমাদের মাফ করবেন, আমরা ভেবেছিলাম এটা একটা চুরির ঘটনা" এবং মানুষটাকে ছেড়ে দিয়ে ওখান থেকে চলে গেল। মানুষটা পুরোহিতের করুণায় অভিভূত হয়ে গেল। --- ওপরের অংশটি "লা মিসারেবল্স্" থেকে নেওয়া।
জেন ট্র্যাডিশন থেকে অনুরূপ একটা গল্প আছে, সেটা হয়তো পশ্চিমী গল্পকারদের অনুপ্রাণিত করে থাকবে। ওটাও একই রকম বার্তা দেয়:
একজন জেন মাস্টার তার শিষ্যদের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করলেন আর তাদের জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে।
"লোকটা আবার চুরি করেছে", তারা বলল এবং একজন শিষ্যকে ধাক্কা দিয়ে গুরুর সামনে আনলো। উনি বললেন "ওকে ক্ষমা করে দাও"।
"কখনই নয়। আমরা আপনার জন্য ওকে অনেকবার ক্ষমা করেছি। এখন আপনি যদি ওকে তাড়িয়ে না দেন, আমরা সবাই চলে যাবো", শিষ্যরা হুমকি দিল।
"তোমরা সবাই চলে গেলেও, আমার ওকে তাড়ানোর কোনও ইচ্ছা নেই" – গুরু বললেন।
যে শিষ্যটি অপরাধ করেছিল, গুরুর পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগল।
সদগুরুর ব্যাখ্যা
সদগুরু: একজন মানুষের যে কোনও রকমের শাস্তি সহ্য করে নেওয়ার শক্তি থাকতে পারে, কিন্তু অপরিসীম করুণার কাছে সে পরাজিত হবে। শাস্তি একজন মানুষকে পাথরের মতো কঠোর করে দিতে পারে, কিন্তু কারণাতীত করুণা তাকে চুরমার করে দেবে।আপনি যখন একজনের উপর ক্রমাগত কঠিন হতে থাকেন, সে আপনার শাস্তি নেওয়ার জন্য আরও বেশি করে সক্ষম হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র করুণাই তাকে গলাতে পারে। একজন আধ্যাত্বিক শিক্ষক বা গুরু, এই মুহূর্তে একজন কেমন তা দিয়ে তার বিচার করেন না। একজন যে নারকেল গাছ লাগায়, সে ওটাকে চার সপ্তাহের পর, ফল ধরেনি বলে কেটে ফেলেনা। তেমনি, একজন গুরু দেখবেন যে তার প্রত্যেক শিষ্যের মধ্যে কী ধরনের সুপ্ত সম্ভবনা আছে এবং চেষ্টা করবেন কীভাবে সেটাকে সার্থক ও ফলপ্রসূ করা যায়। তিনি এই কারণে কাউকে অবহেলা করবেন না যে তার এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা নেই।
যারা নিজেদের তার শিষ্য বলে মনে করে, তারা তাদের বিকাশ ও রূপান্তরের প্রতিটি সুযোগ ব্যবহার করতে আগ্রহী হবে। বিশেষত যদি অপ্রীতিকর কোনও পরিস্থিতির উৎপত্তি হয়, সেটা তাদের উন্নতির উত্তম উপায় হবে। অন্যথায় যদি তারা গুরুর ওপর বিভিন্ন শর্ত চাপাতে থাকে, এটা ওটা করার জন্য, তার অর্থ হল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নিজেদের জাহির করা। তারা সত্যিকারের উন্নতির জন্য আগ্রহী নয়। এ ধরণের লোকেরা শিষ্য হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়ার যোগ্য নয়। তাদের সাথে সময় নষ্ট করার থেকে, তাদের ছেড়ে দেওয়াই ভাল।