"শিবের এক মহিমাময় রাত" বা মহাশিবরাত্রির এক বিশেষ আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রয়েছে। মহাশিবরাত্রি উদযাপন করার কারণ কী এবং কীভাবে আমরা এই বিশেষ সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে পারি, এই বিষয়ে সদগুরু আলোকপাত করছেন।
সদগুরু: ভারতীয় সংস্কৃতিতে, এমন এক সময় ছিল যখন বছরে 365 টি উৎসব পালন করা হতো। অর্থাৎ, বছরের প্রতিটি দিনকে উদযাপন করার জন্য তাঁদের শুধু একটা অজুহাতের প্রয়োজন ছিল। এই 365 টি উৎসবের মূলে ভিন্ন ভিন্ন কারণ ছিল, এবং জীবনের বিভিন্ন দিকের সাথে এগুলি সংযুক্ত ছিল। প্রতিটি উৎসবের উপলক্ষ ছিল নানান ঐতিহাসিক ঘটনা, বিজয় উৎসব, কিংবা জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি যেমন বীজ বপন, চারা রোপণ, ফসল কাটা। জীবনের এক একটা পরিস্থিতির জন্য ছিল এক একটা উৎসব। কিন্তু মহাশিবরাত্রির তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা।
ভারতের আধ্যাত্মিক ক্যালেন্ডারে মহাশিবরাত্রি হল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা।
প্রতি চান্দ্রমাসের 14 তম দিন বা অমাবস্যার আগের দিনটিকে শিবরাত্রি বলা হয়। প্রতি বছর যে 12 টি শিবরাত্রি আসে, তার মধ্যে মহাশিবরাত্রির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব সবথেকে বেশি, যা ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে উদযাপন করা হয়। এই রাতে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ এমন এক অবস্থানে থাকে, যা মানব দেহতন্ত্রে শক্তির এক প্রাকৃতিক উত্থান ঘটায়। মানুষকে তার আধ্যাত্মিক সম্ভাবনার চূড়ায় পৌঁছে দিতে এই দিনে প্রকৃতি নিজেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃতির এই সুযোগটিকে কাজে লাগানোর জন্যই আমাদের ঐতিহ্যে সারারাত ব্যাপী এই উৎসবের প্রচলন শুরু হয়। প্রাণশক্তির এই স্বাভাবিক উত্থান যাতে সঠিক পথে প্রবাহিত হতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে, যে মৌলিক দিকটির খেয়াল রাখা হয় তা হল আপনি নিজের মেরুদণ্ড সোজা রেখে সারা রাত জাগ্রত অবস্থায় থাকেন।
যাঁরা আধ্যাত্মিক পথে আছেন, তাঁদের কাছে মহাশিবরাত্রি খুব বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়া, সংসারী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষজনদের কাছে এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সংসারী মানুষরা এই মহাশিবরাত্রিকে শিবের বিবাহ বার্ষিকী হিসেবে উদযাপন করেন। আর যাঁরা জাগতিক সাফল্যের দিকে ধাবিত, তাঁরা এই দিনটিকে শিবের বিজয় দিবস হিসেবে উদযাপন করেন, যেদিন ‘শিব’ তাঁর সকল শত্রুর নিধন করেছিলেন।
কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধকদের কাছে, এই দিনটি হল সেই দিন যেদিন ‘শিব’ কৈলাস পর্বতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি পর্বতের মতোই স্থির হয়ে গিয়েছিলেন – সম্পূর্ণ নিশ্চল। যোগ পরম্পরায় শিবকে ভগবান হিসেবে পূজা করা হয় না, বরং তাঁকে আদি গুরু হিসেবে দেখা হয়, প্রথম গুরু – যাঁর কাছ থেকে যোগবিদ্যার উৎপত্তি হয়। হাজার হাজার বছর ধরে ধ্যানমগ্ন থাকার পর, একদিন তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চল হয়ে গেলেন। সেই দিনটিই হল মহাশিবরাত্রি। এইদিন তাঁর সমস্তরকম গতিবিধি থেমে যায় এবং তিনি একেবারে স্থির বা নিশ্চল হয়ে যান, তাই আধ্যাত্মিক সাধকরা মহাশিবরাত্রিকে নিশ্চল হওয়ার রাত হিসেবে দেখেন।
পৌরাণিক কাহিনী ছাড়াও, যোগ ঐতিহ্যে এই দিন ও রাতের গুরুত্ব এত বেশি কারণ একজন আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে এই দিন ও রাতটি অসংখ্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। আধুনিক বিজ্ঞান অনেক পর্যায় পার করে আজ এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে তারা প্রমাণ করতে চায় যে, আপনি যা কিছুই জীবন হিসেবে জানেন, যাকে আপনি বস্তু আর অস্তিত্ব হিসেবে চেনেন, যাকে আপনি মহাবিশ্ব আর ছায়াপথ হিসেবে জানেন — এই সবকিছুই আসলে একই শক্তি যা নিজেকে লক্ষ লক্ষ রূপে প্রকাশ করছে।
এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি প্রতিটি যোগীর কাছেই একটা অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতা। "যোগী" শব্দের মানে হল যিনি অস্তিত্বের ঐক্যকে উপলব্ধি করেছেন। আমি "যোগ" বলতে, কোনও নির্দিষ্ট অনুশীলন বা পদ্ধতির কথা বলছি না। সীমাহীন মাত্রাকে জানার সমস্ত আকাঙ্ক্ষা, অস্তিত্বের মধ্যে ঐক্য খোঁজার সমস্ত প্রচেষ্টাই হল যোগ। মহাশিবরাত্রি একজন মানুষকে এই ঐক্য অনুভব করার সুযোগ করে দেয়।
শিবরাত্রি হল মাসের অন্ধকারতম দিন। প্রতি মাসে শিবরাত্রি পালন করা, আর বিশেষ করে মহাশিবরাত্রির দিনটি, প্রায় যেন অন্ধকারকেই উদযাপন করার মত। যেকোনও যুক্তিবাদী মন স্বাভাবিকভাবেই অন্ধকারকে প্রত্যাখ্যান করে আলোকে বেছে নেবে। কিন্তু "শিব" শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো "যা নেই"। "যা আছে" সেটাই অস্তিত্ব আর সৃষ্টি। "যা নেই" তাই শিব। "যা নেই" এর অর্থ, আপনি যদি চোখ খুলে চারপাশে তাকান, যদি আপনার দৃষ্টি শুধু ছোট ছোট জিনিস খোঁজে, তাহলে আপনি সৃষ্টির প্রচুর টুকরো দেখতে পাবেন। কিন্তু যদি আপনার দৃষ্টি সত্যিই বড় কিছু খোঁজে, তাহলে দেখবেন এই অস্তিত্বে সবচেয়ে বড় উপস্থিতি হল এক প্রকাণ্ড শূন্যতা।
আমরা যে কয়েকটা অংশগুলোকে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি বলি সেই অংশগুলোই বেশি নজর কাড়ে, কিন্তু যে বিশাল শূন্যতা এদের ধারণ করে আছে সেটা সবার নজরে পড়ে না। এই অসীম ব্যাপ্তি, এই অসীম শূন্যতাকেই ‘শিব’ বলা হয়। আজকের আধুনিক বিজ্ঞানও প্রমাণ করছে যে সবকিছুই আসলে শূন্য থেকে আসে আর সেই শূন্যতেই ফিরে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শিবকে, এই বিশাল শূন্যতা বা অনস্তিত্বের প্রতীক যিনি, তাঁকে ঈশ্বরের ঈশ্বর বা মহাদেব বলা হয়।
এই পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম, প্রতিটি সংস্কৃতি সর্বদাই ঈশ্বরের সর্বব্যাপী আর সর্বত্র বিরাজমান প্রকৃতির কথা বলে এসেছে। ভেবে দেখলে, একমাত্র যা সত্যিই সর্বব্যাপী হতে পারে, যা সত্যিই সব জায়গায় থাকতে পারে তা হল অন্ধকার, অনস্তিত্ব, বা শূন্যতা।
সাধারণত, যখন মানুষ কল্যাণ খোঁজেন, তখন আমরা ঈশ্বরকে আলো হিসেবে বর্ণনা করি। কিন্তু যখন মানুষ আর কল্যাণ খোঁজেন না, যখন তাঁরা নিজের জীবনের বাইরে গিয়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা ভাবেন, যখন তাঁদের উপাসনা ও সাধনার লক্ষ্য হয় বিলীন হয়ে যাওয়া, তখন আমরা সবসময় ঈশ্বরকে অন্ধকার হিসেবে উল্লেখ করি।
আলো আপনার মনে একটা ক্ষণিকের ঘটনা মাত্র। আলো কখনওই শাশ্বত নয়, আলো সবসময়ই একটা সীমিত সম্ভাবনা কারণ সেটা সীমিত সময়ের জন্যই ঘটে আর শেষ হয়ে যায়। এই পৃথিবীতে আমরা যে সবচেয়ে বড় আলোর উৎসকে জানি সেটা হল সূর্য। কিন্তু সূর্যের আলোকেও আপনি নিজের হাত দিয়ে বাধা দিতে পারেন এবং একটা অন্ধকার ছায়া সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু অন্ধকার সবকিছুকেই আচ্ছাদন করে থাকে, সব জায়গায় বিরাজমান । চিরকালই, এই জগতের অপরিণত মস্তিষ্কগুলো অন্ধকারকে শয়তান হিসেবে বর্ণনা করে এসেছে। কিন্তু যখন আপনি ঈশ্বরকে সর্বব্যাপী বলেন, তখন আসলে আপনি ঈশ্বরকে অন্ধকার হিসেবেই উল্লেখ করছেন, কারণ শুধু অন্ধকারই সর্বব্যাপী। সে সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর কারোর থেকেই কোনও সাহায্যের দরকার হয় না।
আলোর উৎস সবসময় নিজেকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে ফেলে। তার একটা শুরু আর শেষ আছে। সে সবসময়ই একটা সীমিত উৎস থেকে আসে। কিন্তু অন্ধকারের কোনও উৎস নেই। সে নিজেই নিজের উৎস। সে সর্বব্যাপী, সর্বত্র বিরাজমান। তাই আমরা ‘শিব’ বলতে, অস্তিত্বের এই বিশাল শূন্যতার কথাই বলি। এই বিশাল শূন্যতার কোলেই সমস্ত সৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে। শূন্যতার এই কোলকেই আমরা ‘শিব’ বলে উল্লেখ করি।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে, প্রাচীন যুগের প্রার্থনা কখনওই নিজেকে বাঁচানো, নিজেকে রক্ষা করা বা জীবনে উন্নতি করার বিষয়ে ছিল না। প্রাচীন প্রার্থনাগুলো সবই ছিল "হে প্রভু, আমাকে ধ্বংস করুন যাতে আমি আপনার মতো হতে পারি।" তাই যখন আমরা শিবরাত্রি বলি, যেটা মাসের সবচেয়ে অন্ধকারতম রাত, এটা একটা সুযোগ নিজের সীমাবদ্ধতাকে বিলীন করে দেওয়ার, সৃষ্টির উৎসের অসীম সম্ভাবনাকে অনুভব করার – যা প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বীজ রূপে নিহিত রয়েছে।
মহাশিবরাত্রি হল একটি সুযোগ আর সম্ভাবনা – প্রতিটি মানুষের মধ্যে বিরাজমান সেই বিশাল শূন্যতাকে প্রত্যক্ষ করার – যা সমস্ত সৃষ্টির উৎস। একদিকে শিব ধ্বংসকারী হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে তিনি সবচেয়ে করুণাময় হিসেবেও পরিচিত। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ দাতা হিসেবেও খ্যাত। যোগ ঐতিহ্যে শিবের করুণার অনেক গল্প রয়েছে। তাঁর করুণা প্রকাশের ধরন একদিকে যেমন অবিশ্বাস্য, অন্যদিকে তেমনি বিস্ময়কর। সুতরাং, মহাশিবরাত্রি প্রাপ্তির জন্যও এক বিশেষ রাত। তাই আমাদের কামনা আর আশীর্বাদ, যে আপনারা যেন এই রাতটিতে শূন্যতার এই অসীম মাত্রা, যাকে আমরা ‘শিব’ বলি, তাকে অন্তত এক মুহূর্তের জন্যও অনুভব করেন। এই রাতটা যেন শুধু জেগে থাকার রাত না হয়, এটা যেন আপনাদের জন্য এক জাগরণের রাত হয়ে ওঠে।