সদগুরু: আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, গঙ্গা নাকি শিবের জটা থেকে ঝরে পড়ে। হিমালয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে, যে প্রতিটি শৃঙ্গই হল স্বয়ং শিব। হিমালয়ের শৃঙ্গগুলো বরফে ঢাকা, আর এই বরফাচ্ছন্ন পর্বত থেকে যে ছোট ছোট জলধারা বেরিয়ে আসে, সেগুলো ধীরে ধীরে একত্রিত হয়ে ছোটো ছোটো নদীতে পরিণত হয় আর তারপর সেগুলি প্রবাহমান নদী হয়ে ওঠে। এই কারণেই তাঁরা বলতেন এই পর্বতগুলি ঠিক শিবের মতো, আর এই নেমে আসা জলধারাগুলি হল জটা যা পরিণত হয় গঙ্গায় এবং এই প্রবাহ শুরু হয় আকাশ থেকে – যা একেবারেই সত্যি কারণ বরফ তো আকাশ থেকেই পড়ে।
এই প্রতীকী অর্থই গঙ্গার কিংবদন্তি সৃষ্টি করেছে, আর এটিকে সবচেয়ে বিশুদ্ধ জল মনে করা হয় কারণ এটি আকাশ থেকে আসে। সর্বোপরি, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে এটি একটি বিশেষ গুণ অর্জন করেছে। 19 বছর বয়স থেকে আমি প্রতি বছর একা হিমালয়ে ট্রেকিং করতাম, এবং প্রায়শই ঠান্ডায় কাঁপতাম ও খিদেতে থাকতাম, কারণ তেমন কোনও প্রস্তুতি বা সরঞ্জাম ছাড়াই আমি সেখানে যেতাম। আমার কাছে শুধু একটি ডেনিম প্যান্ট আর একটি মোটা টি-শার্ট থাকত। আমার অনেকবার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে শুধু কয়েক আঁজলা গঙ্গা জল আমাকে 48 ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চালিয়ে নিয়ে গেছে, কোনওরকম ক্লান্তির অনুভূতি ছাড়াই। এছাড়া আমি অনেকের কাছ থেকেই সরাসরি শুনেছি যে কীভাবে শুধু গঙ্গা জল পান করেই তাঁদের রোগ সেরে গেছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, কারোর মৃত্যুর সময় ভারতে আমরা তাঁকে একটু গঙ্গাজল দিয়ে থাকি।
গঙ্গার জল অত্যন্ত বিশেষ কিছু হতে পারে, তবে সেটা আপনার বিশ্বাসের হয় না, এটা কেবল জলের গুণমানের কারণে। হিমালয় পর্বতমালা নিজেই এই জলের গুণাগুণ বোদলে দেয়।
কিংবদন্তি অনুযায়ী ‘গঙ্গা’ মহাকাশ থেকে এই গ্রহে অবতরণ করেছিলেন, আর ওনার বেগের কারণে পৃথিবীতে বিপর্যয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় ‘শিব’ তাঁকে নিজের জটার মধ্যে ধারন করে ধীরে ধীরে হিমালয় বেয়ে প্রবাহিত হতে দেন। মানুষের কাছে এর মূল্য আর পবিত্রতা কী, সেটাকে এখানে রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। এই নদীর নির্মলতাই এখন ভারতীয়দের কাছে স্বয়ং পবিত্রতার এক প্রতীক হয়ে উঠেছে। নদীর সঙ্গে আপনার যদি কোনও ঘনিষ্টতা থাকে, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই জানবেন যে প্রতিটি নদীরই নিজস্ব একটা জীবনকাল আছে। এই সত্য পৃথিবীর সর্বত্রই প্রযোজ্য, সেটা মিশরের ‘নীল’ নদ হোক বা ইউরোপের ‘দানিউব’ বা রাশিয়া ও মধ্য-এশিয়ার দেশগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ‘ভোলগা’ বা আমেরিকার ‘মিসিসিপি’ বা দক্ষিণ আমেরিকার ‘আমাজন’ নদী। এগুলোকে শুধুই জলাধার হিসেবে দেখা হয় না। আমরা জানি, বেশিরভাগ সংস্কৃতিই খুব স্বাভাবিকভাবেই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে, কিন্তু যাঁরা কোনও নদীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, তাঁদের কাছে এটা একটা জীবন্ত সত্তা হয়ে ওঠে। এর নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে; নিজস্ব মেজাজ, আবেগ আর খামখেয়ালিভাব আছে।
নদী হল একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া আর এটা ভারতের গঙ্গার ক্ষেত্রেও সত্য। আমার সৌভাগ্য হয়েছে গঙ্গার উৎস গোমুখ পর্যন্ত যাওয়ার আর এর প্রায় সমস্ত প্রধান শাখা – যেমন ‘মন্দাকিনী’, ‘অলকনন্দা’, আর অবশ্যই গঙ্গার মূল অংশ ‘ভাগীরথী’ – অনুসরণ করে উপরে ওঠার। হিমালয়ে গঙ্গা মানে হল পবিত্রতা আর বিশুদ্ধতা, কিন্তু সমতলে নেমে আসার পর গঙ্গা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর ভাগের জীবনদায়ী হয়ে ওঠেন। যুগ যুগ ধরে গঙ্গা অসংখ্য সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়েছে। দেশের ওই অংশের মানুষদের জন্য ‘গঙ্গা’ শক্তি ও সমৃদ্ধির এক নিরন্তর উৎস হয়ে এসেছে।
আজ এমন এক সময় এসেছে, যখন আমরা গঙ্গাকে কেবল একটি সম্পদ হিসেবে দেখছি এবং হিমালয়ে বাঁধ দিয়ে একে আমরা আটকে রাখছি; যা সেই সকল মানুষের অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে, যাঁরা গঙ্গাকে জীবন্ত মা কিংবা দেবী রূপে দেখেন। আর সমতলে নেমে এটা এখন ভয়ানকভাবে দূষিত হয়ে উঠেছে। কিছু উদ্বিগ্ন মানুষ যদিও গঙ্গাকে তার আদি ও বিশুদ্ধ রূপে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। আমি ত্রিশ বছর ধরে হিমালয়ে যাতায়াত করছি এবং দেখেছি বরফের পরিমাণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বরফে ঢাকা অনেক পাহাড়ের চূড়া এখন আর বরফে ঢাকা নেই, একেবারে বরফশূন্য, ধারালো, খাঁজকাটা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এনদী হিসাবে গঙ্গার জন্য কঠিন বিপদ দেখা দিয়েছে এবং হিমবাহ দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে, যা আমরা গোমুখের প্রবেশমুখেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এর নাম গোমুখ, কারণ এটি গরুর মুখের মতো দেখতে ছিল। আমার মনে আছে, যখন আমি প্রথম সেখানে গিয়েছিলাম – 1981সালের অগাস্ট মাসে – তখন এটি ছিল মাত্র 15 থেকে 20 ফুটের একটি ফাটল, যেখান থেকে জল বের হচ্ছিল; এবং এটি সত্যিই গরুর মুখের মতো দেখাত। আজ এটি 200 ফুট চওড়া একটি গুহা, যার ভিতরে আপনি চাইলে প্রায় আধ মাইল পর্যন্ত হেঁটে ঢুকে যেতে পারেন।জলবায়ু পরিবর্তন গঙ্গার জীবনে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলছে, আর কোনও সময়ে যদি এটা নদীর অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে, তাহলে ভারতের উত্তরাঞ্চলে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, কারণ গঙ্গাই সেখানে মানুষের জন্য জীবনদায়ী হয়ে এসেছে।
প্রতিটি সংস্কৃতি, প্রতিটি জনগোষ্ঠী, প্রতিটি সভ্যতার এমন একটি প্রতীকের প্রয়োজন হয়, যা তাদের জীবনে এক ভিন্ন পবিত্রতার মাত্রা যোগ করে অনুপ্রাণিত করে। গঙ্গা চিরকাল এই ভূমিকা পালন করে আসছে এবং এর তীরেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানব সমাবেশ কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আট থেকে দশ কোটিরও বেশি মানুষ একত্রিত হন। পৃথিবীর অন্য কোথাও মানুষের এমন সমাগম দেখা যায় না। গঙ্গা এবং এর প্রতীকী পবিত্রতা সর্বদা মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার মূল স্রোত ছিল। এই প্রতীকের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গঙ্গাকে বাঁচানো এবং এর পবিত্রতা রক্ষা করা কেবল আমাদের টিকে থাকার প্রশ্ন নয়, বরং মানুষের চেতনা ও মনোবলকে উচ্চ স্তরে ধরে রাখার জন্যও অপরিহার্য।