সদগুরু: শিব পুরাণে বলা হয়েছে আদিযোগী শিব ছিলেন একজন সন্ন্যাসী এবং এক কঠোর তপস্বী যিনি খুলির মালা পরে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি এতই ভয়ঙ্কর ছিলেন যে কেউই তাঁর কাছে যেতে যাওয়ার সাহস পেত না। তখন সব দেবতারা তাঁর অবস্থা দেখে ভাবলেন, "উনি যদি এই অবস্থাতেই থাকেন, তাহলে ধীরে ধীরে ওনার প্রাণশক্তি আর কম্পনের প্রভাব পুরো পৃথিবীকে প্রভাবিত করবে আর সবাই সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। এটা আত্মজ্ঞান ও মুক্তি লাভের জন্য ভালো, কিন্তু আমাদের কি হবে? আমাদের লীলা তো বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের যা চাই মানুষ আর সেই চাহিদা পূরণ করবে না। আমরা নিজেদের খেলা খেলতে পারব না, তাই আমাদের কিছু একটা করতেই হবে।"
অনেক অনুনয়-বিনয় আর বোঝানোর পর, কোনওভাবে তাঁরা তাঁকে সতীর সঙ্গে বিয়ে দিলেন। এই বিয়ের পর, তিনি আংশিকভাবে সংসারী হলেন। কিছু কিছু মুহূর্তে তিনি খুবই দায়িত্বশীল সংসারী হয়ে থাকতেন; আবার এমন সময়ও আসত যখন তিনি একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন মাতাল হয়ে যেতেন; এমন মুহূর্তও আসত যখন তিনি এতটাই রাগান্বিত হতেন যে সম্পূর্ণ সৃষ্টিকেই পুড়িয়ে দিতে পারতেন; আবার এমন সময়ও আসত যখন তিনি সৃষ্টির জন্য শীতলতা আর প্রশান্তি প্রদান করতেন। এভাবেই তিনি বদলে বদলে যেতেন।
সতী তাঁকে পুরোপুরি ধরে রাখতে পারেননি, যেমনভাবে এই বিশ্বের তাঁকে প্রয়োজন ছিল। তারপর ধারাবাহিকভাবে এমন কিছু ঘটনা ঘটল যে সতী নিজের দেহত্যাগ করলেন, আর শিব আবার আগের চেয়ে আরও তীব্র, আরও কঠোর এক তপস্বী হয়ে উঠলেন। এবার পুরো পৃথিবী সন্ন্যাসের পথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেল আর এই দেখে দেবতারা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
দেবতারা আবার তাঁকে বিয়ের ফাঁদে ফেলতে চাইলেন। তাই তাঁরা মাতৃদেবীর আরাধনা করে তাঁকে অনুরোধ করলেন পার্বতীর রূপ ধারণ করতে। তিনি পার্বতী হিসেবে জন্ম নিলেন শুধুমাত্র একটাই লক্ষ্য নিয়ে – যেভাবেই হোক শিবকে বিয়ে করা। তিনি বড় হওয়ার পর নানাভাবে শিবকে নিজের দিকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। তখন দেবতারা কামদেবের সাহায্য নিয়ে যেকোনওভাবে শিবকে প্রভাবিত করলেন, আর এক মুহূর্তের জন্য শিব কোমল হলেন এবং আবার গৃহস্থ হয়ে উঠলেন। সেই থেকে তিনি নিজের অন্তরে অসাধারণ সামঞ্জস্য আর ভারসাম্য সহকারে সন্ন্যাসী আর সংসারী – এই দুই ভূমিকাই পালন করতে শুরু করলেন।
শিব পার্বতীকে আত্মজ্ঞান প্রাপ্তির উপায় শেখাতে শুরু করলেন। নানান অদ্ভুত আর খুবই ঘনিষ্ঠ পন্থায়, তিনি তাঁকে আত্মজ্ঞান প্রাপ্তির উপায় শেখালেন। পার্বতী পরমানন্দের অবস্থায় উন্নীত হলেন। কিন্তু যেকোনও সাধকের ক্ষেত্রেই যা ঘটে, তাঁর ক্ষেত্রেও তাই হলো — যখন কেউ শিখরে পৌঁছে যান, প্রথমে তিনি পরমানন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন, কিন্তু কিছু সময় পর করুণা এসে তাঁর হৃদয় ভরিয়ে তোলে আর সবার সঙ্গেই তিনি সেটা ভাগ করে নিতে চান। আপনি চান যেভাবেই হোক সবাই যেন এই অবস্থার উপলব্ধি করে।
মহাশিবরাত্রির দিনটিতেই শিব ও পার্বতীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। আদিযোগী ছিলেন একজন সন্ন্যাসী, বন্ধনে জড়িয়ে পড়ার কোনও ভয় না থাকায় তিনি তাঁর চরম বৈরাগ্য নিয়ে এই দিনেই আবেগের জগতে প্রবেশ করেন; আর এই আবেগই তাঁর গভীর জ্ঞান আর উপলব্ধি সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার এক মাধ্যম হয়ে ওঠে।
পার্বতী জগৎ সংসারের দিকে তাকান আর শিবকে বলেন, "আপনি আমাকে যা শিখিয়েছেন তা সত্যিই অসাধারণ, এটা সবার কাছেই পৌঁছানো দরকার। কিন্তু আমি জানি, যেভাবে আপনি আমাকে এই জ্ঞান প্রেরণ করেছেন, সেভাবে সম্পূর্ণ পৃথিবীতে এই জ্ঞান বিতরণ করা সম্ভব নয়। তাই পৃথিবীর জন্য অন্য কোনও উপযুক্ত পন্থা বিকশিত করা উচিত।" এর পরই শিব যোগ প্রক্রিয়ার নানান উপায় প্রতিষ্ঠা করা শুরু করেন। তিনি সাতজন শিষ্য বেছে নেন, যাঁদের আজ আমরা সপ্তঋষি নামে জানি। এর পরই ‘যোগ’ হয়ে উঠল আত্মজ্ঞান প্রাপ্তির এক বিজ্ঞান। খুব প্রণালীবদ্ধ আর বৈজ্ঞানিক এক পন্থা যা সবাইকেই শেখানো সম্ভব।
এইভাবে শিব দুটো পদ্ধতি বিকশিত করলেন - ‘তন্ত্র’ আর ‘যোগ’। তিনি তাঁর স্ত্রী পার্বতীকে তন্ত্র শিক্ষা দিলেন। তন্ত্র খুবই ঘনিষ্ঠ এক বিদ্যা, অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ও গূঢ় জ্ঞান, যা শুধুমাত্র খুব কাছের গোষ্ঠীর মধ্যেই আদান-প্রদান করা সম্ভব, কিন্তু যোগ বড় সংখ্যক মানুষকে শেখানো যেতে পারে। এটা আমাদের চারপাশের পৃথিবীর জন্য আরও উপযুক্ত, বিশেষ করে এখনকার সময়। তাই আজও শিবকে যোগের প্রথম গুরু বা ‘আদি গুরু’ হিসেবে মান্য করা হয়।