আনন্দ ও অতীন্দ্রিয়বাদের সহাবস্থান কি সম্ভব?
খুশি থাকাটা জীবনের আরো গভীর এবং প্রগাঢ় মাত্রা গুলোর অনুসন্ধানের পথে প্রতিরোধক কি না এই বিষয়ে সদগুরু একটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।
প্রশ্নকর্তা: নমস্কার, সদগুরু। আমি খুশি থাকতে চাই, কিন্তু আমি গভীরতাও পছন্দ করি। অতীন্দ্রিয় ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে। কিন্তু মজা মানে যদি সব সময় খিল-খিল করে হাসা হয়, তাহলে সেটা কি ভাসা-ভাসা নয়?
সদগুরু: অতীন্দ্রিয় সবকিছুই উপরের ব্যাপার, গভীরের নয়। এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা,যেটা আমি সারা বিশ্বে বদলানোর চেষ্টা করছি - খুশিতে থেকেও সবথেকে গভীর বিষয়ের চর্চা করা যায়। এই এখন, এমনকি নদী- অভিযান রালি ফর রিভার্স, -এর মত বিশাল মাপের প্রকল্পের ব্যাপারেও আমি এটা সুনিশ্চিত করতে চাই । অনেক উল্লেখযোগ্য চিকিৎসাশাস্ত্রীয় এবং বৈজ্ঞানিক প্রামাণিক তথ্য আছে যা প্রমাণ করে যে আপনার শরীর এবং মস্তিষ্ক সবথেকে বেশি সক্রিয় থাকে শুধু তখনই যখন আপনার উপলব্ধি মনোরম অবস্থায় থাকে। সুতরাং যদি আপনি কোন সুগভীর বিষয়ের সম্মুখীন হতে চান তাহলে কি আপনার মস্তিস্ক বন্ধ থাকা উচিত নাকি সক্রিয়?যে মুহূর্তে আপনি মারাত্মক রকম গম্ভীর হয়ে যান, আপনার মস্তিষ্ক জমাট বেঁধে যায়; এটা আর কাজ করে না। আপনি যদি অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে অগ্রসর হতে চান, তার মানে এই নয় যে আপনাকে একটা লম্বা মুখ করে মারাত্মক গম্ভীর হতে হবে। সব অতিন্দ্রীয়বাদীরাই আনন্দময় ছিলেন। আপনি যদি প্রগাঢ় কিছুর খোঁজ করতে চান, তাহলে আপনার একটা নির্দিষ্ট মাত্রার প্রাণোচ্ছল শক্তির প্রয়োজন। আপনি যদি মারাত্মক গম্ভীর হন, আপনি কি আর স্পর্শ করবেন, বৃহৎ কিছু কি ঘটবে? আনন্দ মানে সর্বক্ষণ খিল-খিল করে হাসা নয়। আপনি এমনভাবে আনন্দময় হতে পারেন যেঅবিরাম আপনার অশ্রু ধারা বইবে। ওপরে ওপরে, আপনি যখন লোকজনের সঙ্গে থাকেন, আপনি ফিক্ -ফিক্ করে হাসুন বা জোরে জোরে হাসুন বা যা-কিছু করুন।
কিভাবে স্বচ্ছন্দে থাকা যায়
আনন্দ মানে এই যে আপনি মধুরতার একটা নির্দিষ্ট স্তরে আছেন। মধুরতা মানে আপনার মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। আপনি যদি এখানে বসে থাকেন, আপনি স্বচ্ছন্দে আছেন। এটাই এক মহা আনন্দ। বেশিরভাগ মানুষই জানেননা কিভাবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছন্দে এখানে বসে থাকা যায়। ধরুন আমি আপনাকে এতগুলো লোকের সামনে উপস্থিত করলাম; আপনি যা নন, তেমন কিছু হওয়ার জন্য আপনি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে যাবেন। আপনি যদি নিজে যা নন, তার থেকে অন্য রকম হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনি কখনোই স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন না। আপনি নিজের ওপর কাজ করুন এবং নিজেকে এমন জায়গায় তুলে ধরুন যে আপনি যেরকম, সেটাই মনোরম।
এটা এমন নয় যে প্রত্যেকের মধ্যে কিছু ভুল আছে। এটা শুধু এই যে, তারা অন্য কোন একজন হতে চায় - ভুল এটাই। সমস্যাটা হ'ল - শুধুমাত্র শারীরিক চেহারায় নয়, এমনকি কথায় এবং ব্যবহারেও - মানুষ এমন কিছু হওয়ার চেষ্টা করছে যা তারা নিজেরা নয়। আমি সৎসঙ্গে এমনভাবে কথা বলি যে রকম ভাবে আমি বাথরুমেও বলব। যদিও আমি বাথরুমে কথা বলি না। আমি এটা বলছি এই কারণে যে বেশিরভাগ মানুষই গান গায় শুধুমাত্র বাথরুমে। আমি দর্শনে বসি এবং গান গাই; এই কারণে নয় যে আমি গান জানি, আমি লজ্জাহীন এই কারণে। কারণ আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই দেখিনা।
আমি স্বচ্ছন্দে আছি কারণ আমি কারুর অভিমত দিয়ে তৈরি নই। কারুর অভিমত কোনোভাবেই আমাকে খুশি বা অখুশি করে না। লোকেরা আমাকে হয় বলছে, "সদগুরু, আপনি ভগবানের থেকেও বড়" বা অন্য কিছু কটু কথা বলছে- এক মুহূর্তের জন্যেও কখনই এটা বা ওটা কোনটাই কিছু ব্যাপার নয়। আপনি যদি মনে করেন আমি ভগবানের থেকেও বড়, তাহলে সেটা আপনার জন্যই ভালো। যদি আপনার মনে হয় আমি কদর্য, তাহলে আপনার মনের ভিতরেই কদর্যতা ঘটছে। আপনি মনে করেন আমি অপূর্ব, কারণ আপনার ভেতরে অপূর্ব কিছু ঘটছে। এটা চমৎকার! আপনি মনে করেন আমি ভয়ঙ্কর, কারণ আপনার ভেতরে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটছে। তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই - সে ব্যাপারে আমি একদমই পরিষ্কার।
অতীন্দ্রিয়বাদীরা বিরক্তিকর নয়
অতীন্দ্রিয়বাদ মানে মারাত্মক রকম গম্ভীর হয়ে যাওয়া নয়। গম্ভীর হয়ে যাওয়ার মানে এই নয় যে আপনি কোন ব্যাপারকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। গাম্ভীর্যের কারণ আপনি নিজেকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। আপনি নিজের ভাবনা, আবেগ, ধারণা, মতামত এবং দর্শন যেগুলো নিজের ভিতর প্রতিপালন করেন, সে গুলোকে খুবই বেশি গুরুত্ব দেন। আপনি যদি আমাকে গুরুত্ব দেন, তাহলে আপনি গম্ভীর হয়ে উঠবেন না। ভারতবর্ষে আমরা ইংরেজি ভাষাটা যেভাবে ব্যবহার করি, যদি কেউ বলে, "আমার ঠাকুমার অবস্থা গুরুতর" আমরা মনে করি তিনি বুঝি উপরে যাবার পথে। আপনি যদি খুব গম্ভীর হয়ে যান, আপনাকে আমরা অতীন্দ্রিয়বাদী মনে করিনা। আমরা মনে করি আপনি বিরক্তিকর।
অতীন্দ্রিয়বাদ একটা অন্বেষণ। . আপনি যখন আনন্দময় তখন আপনার জীবনে আপনি কোন সমস্যা নন। যখন আপনি আনন্দের সন্ধানে রয়েছেন, তার অর্থ আপনি একটা সমস্যা - আপনি নিজের জন্য একটা সমাধান খুঁজছেন। যখন আপনি নিজের স্বভাবেই আনন্দময়, তখন আপনি কোন সমস্যা নন। শুধুমাত্র যখন আপনি কোন সমস্যা নন, তখনই আপনি জীবন ধারণের দুশ্চিন্তার বাইরে কোন কিছুর খোঁজ করবেন।
অতীন্দ্রিয়বাদ থেকে কিছু লাভ করার নেই। ঠিক বিজ্ঞানের মত। বিজ্ঞান থেকে কোন লাভ হয় না। প্রযুক্তিবিদ্যা হল লাভজনক। বিজ্ঞান শুধুমাত্র জানবার আকাঙ্ক্ষা। জানবার আকাঙ্ক্ষা একটা পাগলামি! কিছু জানবার জন্য অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। অনেক বিজ্ঞানী এবং অতীন্দ্রিয়বাদের সাধকেরা নিজেদের জীবন নষ্ট করেছেন এবং মারাও গেছেন। অন্য অনেকে মারা গেছেন খুঁজতে খুঁজতে, কারণ খোঁজের প্রকৃতিই ওরকম। সত্য হল এই প্রকৃতির । আপনি যখন খুঁজবেন, সে নিজেকে উন্মোচিত নাও করতে পারে - সে তার মুখ খুলে আপনাকে গ্রাস করতে পারে। যে সব মানুষেরা মহাশূন্যে যান, তাদের ফিরে আসবার কোন নিশ্চয়তা থাকে না। যা কিছু ঘটতে পারে। কিসের জন্য? আপনি কি মনে করেন তারা কি টুথপেস্ট বা অন্য কিছুর দামে ছাড় পাবে? কেবলমাত্র জানবার জন্য! শুধুমাত্র নতুন কিছু দেখবার জন্য।
এটাই বিজ্ঞানের প্রকৃতি। এটাই অতীন্দ্রিয়বাদের প্রকৃতি। এটা শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন আপনি একটা সমস্যা নন, এবং আপনি দুশ্চিন্তাও নন। সেটা শুধুমাত্র তখনই ঘটবে যখন আপনি আনন্দময়। অতীন্দ্রিয় খোঁজের পথে প্রথম পদক্ষেপ হল -এটা সুনিশ্চিত করা যে আপনি নিজেই যেন আপনার জীবনের সমস্যা না হন। আপনার জীবনে হাজারো সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু আপনি নিজেই সে সমস্যা হওয়া উচিত নয়। আনন্দময় হওয়া মানেই হল যে আপনি সমস্যা নন। আপনার অবশ্যই নিজেকে নিয়ে সেটা করা উচিত - আপনি অতীন্দ্রিয়বাদ অনুসরণ করুন অথবা আপনি জীবনটা সাধারণভাবে কাটাতে চান - উভয় ক্ষেত্রেই এটা প্রয়োজন যে সমস্যাটা যেন আপনি নিজে না হন, যেন আপনি একজন আনন্দময় মানুষ হতে পারেন।
টিকে থাকার উর্ধ্বে যাওয়া
আনন্দকে কোন যোগ্যতা হিসেবে দেখবেন না। এটা একটা মৌলিক পরিবেশ, জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্য এর প্রয়োজন আছে। এই গাছগুলোর বৃদ্ধি এবং তাদের ফুল ও ফল ধারণের জন্য জমি উর্বর রাখতেই হবে। সেটা একটা মৌলিক চাহিদা। একইভাবে আপনি যদি উপলব্ধির এক সুখময় অবস্থায় থাকেন, শুধুমাত্র তখনই বড়ো কিছুর খোঁজ করবেন। অন্যথায় আপনি সর্বদাই নিজের জন্য কতকগুলো গণ্ডি খাড়া করবার চেষ্টা করছেন। আপনি কেবলমাত্র ছোট ছোট কাজ করতে চান; এর বাইরে আর কিছুই নয়। যখন আপনার ভেতর কষ্ট থাকবে তখন আপনি বিশাল কিছুর খোঁজ করবেন না। যতক্ষণ অব্দি আপনি কষ্ট ভোগ করতে সমর্থ, ততক্ষণ আপনি স্বেচ্ছা-পঙ্গু। যন্ত্রণা ভীতি আপনাকে দমিত এবং নিয়ন্ত্রিত রাখবে: "কি হবে?" "যাই ঘটুক না কেন, তবুও আমি জানতে চাই!" - সেই ধরনের পাগলামির জন্য আপনাকে অবশ্যই হতে হবে উচ্ছল এবং প্রাণবন্ত।
যারা এটাকে পাগলামি বলে, তারা কোষ্ঠবদ্ধ। কিন্তু শুধুমাত্র এইরকম "পাগল" মানুষদের জন্যই বিজ্ঞান, দুঃসাহসিক অভিযান, ভৌগোলিক জ্ঞান এবং এরকম অনেক জিনিস ঘটেছে। এই গ্রহের ভূগোলের, মহাশূন্যের, প্রযুক্তির অনুসন্ধান - সবকিছুই ঘটেছিল এই কারণে যে কোন একজন তাদের আরামদায়ক অবস্থান এর বাইরে পদক্ষেপ নিতে রাজি ছিলেন। তারা অস্বাচ্ছ্যন্দে থাকতে রাজি ছিলেন কারণ তারা জানতে চেয়েছিলেন তাদের বর্তমান অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতার গণ্ডি ছাড়িয়ে কিছুকে জানবার পরিপূর্ণতা এবং পরমানন্দকে।
সেই পরিমাণ ক্ষুধা উদ্রেকের জন্য, আপনাকে অবশ্যই কয়েক বছর আনন্দময় হয়ে থাকতে হবে আর বুঝতে হবে যে প্রকৃতপক্ষে আপনি যা-ই কিছুই করছেন খুব সাধারণ জিনিস, যা নিয়ে মানুষেরা অত্যধিক বাড়াবাড়ি করছে - কোন চাকরি পাওয়া ,চাকরি করা ,গৃহ নির্মাণ করা, বিবাহ করে দুটি সন্তান উৎপন্ন করা - এগুলো বড় কোন কৃতিত্ব নয়। এটা প্রত্যেকটি জীবই করছে। একটা পাখি তার বাসা বাঁধছে, ডিম পাড়ছে, তা দিয়ে বাচ্চা ফোটাচ্ছে, তাদের বড় করছে আর তারা উড়ে যাচ্ছে পনেরো দিনের মধ্যে। আর আপনি এই নিয়ে এত বিরাট হইচই করছেন।
বর্তমান জগতে, মানব জাতির ইতিহাসে এই প্রথম বার, আমাদের জীবন ধারণের প্রক্রিয়া আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত। এটাই সময় অতিন্দ্রীয়বাদের জন্য। এটাই সময়, মানুষকে তাদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বৃহতের খোঁজ করতে হবে। কাজেই আমরা ঠিক সময়ে উপস্থিত রয়েছি । চলুন আমরা এটা করে দেখাই।
Editor’s Note: Click here to read what Sadhguru has to say about Kailash, which he calls the Greatest Mystical library on the planet.
A version of this article was originally published in Isha Forest Flower January 2020. Click here to subscribe to the print version.