কাহিনী:

একদিন, শিষ্যরা তাদের জেন মাস্টারকে ঘিরে বসলেন। তাদের মধ্যে একজন বললেন, "গুরদেব! আজ আমাদের একটি গল্প বলুন!"

গুরু বললেন, "ঠিক আছে, তবে গল্পের শেষে আমি তোমাদের একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব।"

গল্পটি শোনার উৎসাহে তারা সকলেই বললেন, "অবশ্যই! আমরা প্রস্তুত।"

গুরু গল্পটি বলতে শুরু করলেন। "এক গ্রামে একটি বিশাল মহিষ থাকত। যে মাঠগুলোতে সে চরে বেড়াত সেই মাঠে যাওয়ার পথে একটি কুঁড়েঘর পড়ত। সেই কুঁড়েঘরটির চাল প্রচুর খরের আঁটি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল, যাতে ঘরটি ঠাণ্ডা থাকে।

মহিষটি তার মাথা উঁচু করে যে খড়ের আঁটিগুলোর নাগাল পেত, সেগুলোকে সে টেনে নামিয়ে খেতে থাকত। যখন ছাদে আর কোনও খড়ের আঁটি নাগালের মধ্যে রইল না, তখন সে ভাবল, "যদি ছাদে এত খড় থাকে, তাহলে ঘরের ভেতরে না জানি কত খড় থাকবে?” কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, কুঁড়েঘরের জানালা সব সময় বন্ধ থাকত এবং ভিতরে কী ছিল তা মহিষটি দেখতে পেত না।

একদিন মাঠে যাওয়ার পথে মহিষের চোখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল - কুটীরের জানালা খোলা ছিল! মহিষটি আনন্দে উৎসাহে জানালার কাছে গিয়ে খুব সাবধানে, নিজের শিং বাঁচিয়ে, তার মাথা ভেতরে ঢোকাল। ঠিক যেমনটি আশা করেছিল, ঘরের কোণে প্রচুর খরের আঁটি রাখা ছিল!

অনেক চেষ্টা করেও তার মুখ সেই খরের আঁটি অবধি পৌঁছল না। এবার সে চেষ্টা করল সেই জানালা দিয়ে কোনোভাবে নিজের বিশাল শরীরটি ঢোকাতে। শিং, মাথা, ঘাড় জানালা দিয়ে ঢুকল, কিন্তু তাও সে খরের নাগাল পেল না।

এবার, আস্তে আস্তে, মহিষটি তার সামনের পা জানলা দিয়ে কুঁড়ে ঘরের ভিতরে ঢোকাল। দেওালের ওপর পা দিয়ে চাপ দিয়ে নিজেকে ভেতরে টেনে ঢোকানোর চেষ্টা করল। একটু একটু করে তার বিশাল দেহটি জানালার শিকগুলো ভেঙে ভিতরে ঢুকতে লাগল। দেহের সবচেয়ে বড় অংশগুলি - কুঁজ এবং পেট - ভিতরে চলেও গেল! বাকি রইল পিছনের দুটো পা। নিজেকে স্থির করে, ধীরে ধীরে, একটা একটা করে পিছনের পা দুটোও ঢুকিয়ে ফেললো।

মহিষটি ভাবল সে পুরোপুরি কুঁড়েঘরটিতে ঢুকে পড়েছে, আর সেই আনন্দে হাম্বা হাম্বা করতে লাগল! কিন্তু যেই খড়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য সে তার ঘাড়টি বাড়াল, সে দেখল যে সে নাগাল পাচ্ছে না, কারণ তার লেজটি তখনও আটকে ছিল!"

গুরু এখানেই তার কাহিনী থামালেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এই কাহিনীটি সম্ভব না সম্ভব নয়?”

শিষ্যরা বললেন, “এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়!”

“কেন?”

"একটি মহিষের ক্ষুদ্রতম অংশটি হোলো তার লেজ। সে যদি তার মাথা এবং পেট ভিতরে প্রবেশ করাতে পারে তবে কেন সে তার লেজটি ভিতরে আনতে পারবে না?"

গুরু বললেন, "তোমাদের মধ্যে অনেক মহিষ রয়েছে।"

সদগুরুর ব্যাখ্যা:

সদগুরু: বাহুবলীকে নিয়ে একটি চমৎকার গল্প আছে। বাহুবলী অনেক যুদ্ধ দেখেছিল। এক সময়ে, তাকে তার নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। সেই যুদ্ধে অনেক যোদ্ধার মাথা কাটা পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্র মৃতদেহতে এবং রক্তের নদীতে ভরে ওঠে।

এই সকল দৃশ্য তাকে নাড়া দেয়। তার মধ্যে একটা রূপান্তর ঘটে। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন জাগে, "কেন আমি এত প্রাণ নিলাম?" কিন্তু তিনি কোনও উত্তর খুঁজে পান না। এবং পরের মুহূর্তেই যুদ্ধ এবং জীবনে যা কিছু করছিলেন সব ত্যাগ করলেন। সম্পূর্ণ একাগ্র হয়ে, একটি ইঞ্চিও না নড়ে, বাহুবলী চোদ্দ বছর গভীর ধ্যানে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সেই সাধনার তীব্রতার মধ্যে দিয়ে তিনি যে সকল বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন তার অনেক কিছুর থেকেই তিনি মুক্ত হলেন।

যে মানুষটি গোটা বিশ্বকে জয় করতে চেয়েছিলেন তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সেই স্থানে দাঁড়িয়ে রইলেন - একটি গাধার কাছেও নত হওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তাও, তার আলোকপ্রাপ্তি ঘটল না।

এই চোদ্দ বছরে তিনি কারও কাছে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, তাঁর অবস্থান পর্যন্ত পরিবর্তন করেননি। কিন্তু কেন তার আলোকপ্রাপ্তি ঘটেনি, সেটাও বুঝতে পারেননি। তারপর, একজন যোগী সেখানে এলেন। যোগী বাহুবলীর দিকে তাকালেন। বাহুবলী মনে-প্রাণে তাকে জিজ্ঞাসা করতে চাইলেন, "আমার আর কী করা উচিত?" কিন্তু চোদ্দ বছর নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে এখন মুখ খুলে প্রশ্ন করার মতন সাহস তিনি পেলেন না। মনের প্রশ্নটি তার বাঁ চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রুর আকারে বেরিয়ে এল,:

"আমি আমার রাজ্য হারিয়েছি। আমি আমার পরিবার, প্রাসাদ এবং স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছি। এমনকি আমি একটি পতঙ্গের কাছেও কাছে মাথা নত করার মত অবস্থায়ে নিজেকে বিলীন করে ফেলেছি। আমার আর কী করার আছে?"

যোগী বললেন, “আপনি এক অপূর্ব মানুষে পরিণত হয়েছেন। আপনি যে কোনও কীট-পতঙ্গের কাছেও মাথা নত করতে পারেন, কিন্তু আপনি কি এইরকমভাবে আপনার ভাইয়ের কাছে মাথা নত করতে পারবেন? না। আর এটিই আপনাকে আটকে রাখছে।”

বাহুবলী নিজের অবস্থা বুঝতে পারলেন। ভাইয়ের প্রতি তার ঘৃণার ফলে তিনি যে আবদ্ধ হয়ে ছিলেন, সেটাকে তিনি বিলীন করে দিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার আলোকপ্রাপ্তি ঘটল।

এরকম অনেকেই নিজের বাড়ি, অর্থ এবং পরিবারের আরাম-আয়েশ ছেড়ে ঈশা যোগ কেন্দ্রে আসেন। অনেকে অল্প বয়সে আসেন, যৌবনের আনন্দ-উপভোগ ত্যাগ করে। তারা পছন্দ মতন খাবার খান না, মাদক সেবন করেন না, তারা কামনার দাস নয়, তারা কী করছেন তা নিয়ে কোনও অহংকার ছাড়াই দিনরাত কাজ করেন। তবে তারা অজান্তেই নিজেদের ভেতরে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে রয়েছেন।

মাঝে মাঝে যখন আমি এটা দেখি, তখন বিষয়টাকে এত দুরভাগ্যজনক লাগে যে আমি কষ্ট পাই, "তারা এরকম বোকার মতন এই জিনিসটাকে কেন ধরে রেখেছে?"

এক মাত্রা থেকে অন্য মাত্রায় প্রবেশ করার সময়, বা নতুন কোনো অচেনা জায়গায় প্রবেশ করার সময়, লোকেরা অচেতনভাবে এমন কোনও জিনিসকে আঁকড়ে ধরে থাকে যা তারা আগে থেকে চেনে, এবং সেটাকে তারা ছাড়তে চায় না। তারা অতীতের কিছু, বা অর্জন করে থাকা কোনো জ্ঞান, বা কোনো এক সময় উপভোগ করে থাকা কোনো এক জিনিসকে আঁকড়ে ধরে থাকে।

আপনি যদি তাদের স্বর্গেও নিয়ে যান, তবেও তারা তাদের ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে কিছু একটা বস্তুকে আঁকড়ে ধরে থাকবে। সেটা একটা মোবাইল-ফোন বা বিছানার চাদরের মতন সধারন এক বস্তুও হতে পারে। অথবা তারা কোনও নির্দিষ্ট এক জায়গাকে তাদের নিজেদের মনে করে এবং কেবল সেখানে বসেই ধ্যান করবে।

যদি পুরো শরীরটাও ঢুকে যায়, তাও এইভাবে কেবল লেজটুকু আটকে থাকে। সঠিক সময়ে যদি লেজটি কেটে ফেলা হয়, তাহলেই তারা আলোকপ্রাপ্ত হবেন।