সদগুরু: কেদারনাথ অত্যন্ত অসাধারণ এক জায়গা। এখানে “শিভা(শিব)” ধ্বনিটির উচ্চারণ সম্পূর্ণ নতুন এক মাত্রা এবং তাৎপর্য লাভ করে। এই স্থানটিকে এই নির্দিষ্ট ধ্বনিটির জন্যই বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। যখন “শিভা(শিব)” ধ্বনিটি আমরা উচ্চারণ করি, তখন আমরা “এখনও আকারপ্রাপ্ত না হওয়ার স্বাধীনতা”, “এখনও যা সৃষ্ট হয়নি, যে অব্যক্ত” তার বাধনহীন মুক্ত অবস্থার কথা বলছি। যদিও এমনটা বলা ঠিক হবে না, কিন্তু তাও বলি - মনে হয় যেন শিভা(শিব) শব্দটা এই গ্রহে কেদারনাথ থেকেই নির্গত হচ্ছে। হাজার হাজার বছর ধরে ওই স্থানটিকে মানুষ এই ধ্বনিটিরই অনুরণন হিসেবে অনুভব করে এসেছেন।
যখন আমরা বলি “শিভা(শিব)”, তখন আরেকটা মূর্তি অথবা দেবতা তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে না যাঁর কাছে গিয়ে আরও সমৃদ্ধি বা জীবনে আরও ভাল কিছু চাইতে পারি। ‘শিভা(শিব)’ ধ্বনির অর্থ “যা কিছু নয়”। আজকে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের প্রমাণ দিয়ে বলছে সবকিছু শূন্য থেকে আসে এবং শূন্যতেই ফিরে যায়। অস্তিত্বের ভিত্তি এবং মহাকাশের মূল বৈশিষ্ট্য হল অসীম শূন্যতাই। সেখানে ছায়াপথগুলো খুবই ছোটখাটো ঘটনা – ছিটেফোঁটা মাত্র। বাকিটা জুড়ে কেবলই অসীম শূন্য স্থান–যাকে “শিভা(শিব)” হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
কিংবদন্তিতে কথিত আছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে, পাণ্ডবরা খুব আবেগ পীড়িত হয়ে পড়েছিলেন কারণ তাঁরা নিজেদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী – তাঁদের নিজেদের ভাই আর আত্মীয়-স্বজনদেরকে হত্যা করেছিলেন। একে বলা হত ‘গোত্রবধ’। তাঁরা এই কাজের জন্য অপরাধ বোধ করছিলেন আর কালিমালিপ্ত হয়ে নিজেদের পাপ মোচনের জন্য একটা উপায় খুঁজছিলেন। তাই তাঁরা শিবের খোঁজে গেলেন।
শিব তাঁদের এই জঘন্য কৃতকর্মের ভার থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দটা এতো দ্রুত দান করতে চান নি, তাই শিব নিজে এক ষাঁড়রূপ ধারণ করে পলায়ন করতে চাইলেন। কিন্তু তাঁরা শিবকে তাড়া করে ধরতে চেষ্টা করলেন। শিব মাটির ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং যখন উঠে এলেন, তখন দেহের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন জায়গায় উঠে এলো। ষাঁড়ের কুঁজটা কেদারনাথ, সামনের দুই পা তুঙ্গনাথে প্রকট হল, যা কেদারের পথেই পড়ে। ভারতের অংশের হিমালয়ে নাভি আবির্ভূত হল যাকে বলা হয় মধ্য-মহেশ্বর যেটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মনিপুরক লিঙ্গ, আর শিবের জটা যেখানে আবির্ভূত হল তাকে বলা হয় কল্পনাথ। এইভাবে, দেহের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন জায়গায় উদিত হয়েছিল।
এই দেহাংশগুলোর সঙ্গে সাতটি চক্রের সম্পর্ক রয়েছে। এই মন্দিরগুলোকে মানুষের শরীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এটা অসামান্য এক গবেষণা ছিল–একটা বিশালাকায় মানুষের শরীর তৈরি করার প্রচেষ্টা। এমন একটা শরীর ভারতীয় হিমালয়ের দিকে তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমের দিকে অনুকরণ করে এমন আরেকটি শরীর নির্মাণের প্রচেষ্টা হয়েছিল, সম্পূর্ণ নেপালকেই একটা শরীরে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
কেদারনাথ হল শক্তির এক অদ্ভুত অসাধারণ সংমিশ্রন। এই স্থানে হাজার হাজার যোগী এবং নানা ধরনের ঋষি-মুনি তাঁদের সাক্ষ্য রেখে গেছেন। নানা ধরনের বলতে যে বৈচিত্রের কথা বলছি, তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। এঁরা এমন মানুষ যাঁরা কাউকে কোনও শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তাঁদের শক্তি, পথ, কাজ, সর্বস্বকে এই স্থানে একটি বিশেষ উপায়ে যে রেখে গিয়েছিলেন, সেটাই ছিল জগতকে দেওয়া তাঁদের উপহার।
কোনও আধ্যাত্মিক ব্যক্তির কথা বললে, আপনি হয়তো কল্পনা করেন তাঁর আচরণ, পোশাক বা কথাবার্তা একটি নির্দিষ্ট ধরণ বা ধাঁচেরই হবে । কিন্তু এই ভূমি শুধু সেই ধরনের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদেরই ভূমি নয়। আপনার ধারণা-বোধে আধ্যাত্মিক বলে যাঁদের গণ্য করেন তেমন মানুষতো ছিলেনই, কিন্তু যাঁরা সভ্যতার বাঁধনের ধরা-ছোঁয়ার সম্পূর্ণ অতীত, যাঁরা কখনওই আপনার ধারণায় আধ্যাত্মিক বলে পরিগণিত হবে না, এমন অনেকেও ছিলেন। কিন্তু এঁনারাই সেই মানুষ যাঁরা অস্তিত্বের সর্বোচ্চ শীর্ষকে লাভ করেছেন। আমরা "যোগী" বলতে, কোনও নির্দিষ্ট আচরণ বা নৈতিকতার মানুষকে বোঝাই না। একজন যোগী জীবনের সাথে পুরোপুরি একই সুরে বাঁধা। এতটাই একসুরে যে, তিনি জীবনকে ভেঙে ফেলে আবারও জুড়ে দিতে পারেন। আপনি যে মৌলিক জীবন, সেটাকে যদি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলে পুনর্গঠিত করতে পারেন, তবেই আপনি একজন যোগী। এমন বহু অসাধারণ মানুষের সাক্ষী থেকেছে এই ভূমি।
যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক উন্নতি খুঁজছেন, তা যে পথেই হোক, তাঁর জন্য কেদারনাথ এক আশীর্বাদ স্বরূপ, এখানে কল্পনারও অতীত মাত্রায় কৃপা বর্ষিত হচ্ছে। এর অর্থ ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। আপনি ভাবতে পারেন - হাজার হোক, এটাতো একটা মাটির ওপরে বেরিয়ে আসা পাথর মাত্রই। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে যে ধরনের মানুষ এখানে বাস করেছেন তাঁরা এই স্থানটির সাথে যা করেছিলেন তার জন্যই এই বিপুল পার্থক্যটা তৈরি হয়েছে। এটা সেই জায়গা যেখানে বহু যোগী তাঁদের দেহ ত্যাগ করেছিলেন। এর অভিজ্ঞতা আপনার অবশ্যই হওয়া দরকার। আপনি ভারতে জন্মগ্রহণ করলে, অতিরিক্ত বয়স্ক বা একেবারে অকেজো হয়ে যাওয়ার আগে এই অভীষ্ট লাভ করতে আপনার অবশ্যই হিমালয়ে অন্তত একবার যাওয়া দরকার।
আদি শঙ্করাচার্য ছিলেন একজন অত্যন্ত বড় মাপের মনীষী, একজন প্রতিভাবান ভাষাতাত্ত্বিক। তাঁর জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিসরে তিনি দেশের সমস্ত জায়গায় ভ্রমণ করেছিলেন। শংকরাচার্য এসেছিলেন কালাডি নামের এক গ্রাম থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘পায়ের নিচে’। দক্ষিণ ভারতে আমরা ভারত মাতার পায়ে রয়েছি। ভারতের তাৎপর্য হল, আমরা সব সময় শিখে এসেছি দৈবশক্তির পায়ে নত হতে। নত হওয়ার মাধ্যমেই আমরা বিবর্তিত এবং বিকশিত হয়েছিলাম। এই সংস্কৃতি আড়ম্বর বা শক্তি-কৃতিত্ব জাহির করার সংস্কৃতি নয় বরং সহজাত ভক্তি ও বিনম্রতার এক সংস্কৃতি।
আদি শংকরাচার্য বলেছিলেন,”সবকিছু মায়া”। মায়া মানে বিভ্রম, অর্থাৎ সবকিছু যেভাবে আছে সেটাকে ঠিক তার আসল রূপে আপনি দেখছেন না। যেমন এই এখন আপনার সুনিশ্চিত একটা শরীর রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটাও কিন্তু যে খাবার আপনি খাচ্ছেন, যে জল পান করছেন, যে বাতাসে আপনি শ্বাস নিচ্ছেন, তার মাধ্যমে প্রতি নিয়ত বদলে চলেছে, আপনার শরীরের কোষগুলো প্রতিদিন মরে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কোষ জন্ম নিচ্ছে। তার মানে কিছুদিন বাদে আপনার সম্পূর্ণ শরীরটাই নতুন হয় যাবে, সম্পূর্ণ নতুন কোষে ভরে যাওয়ার ফলে। কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে যেন শরীরটা চূড়ান্ত স্থির কিছু– এটাই মায়া। একই রকম ভাবে, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যেভাবে সৃষ্টিকে অনুভব করেন, সেটা সম্পূর্ণরূপেই ভুল–এটাই সেই বিভ্রম, মায়া, যেটা শংকরাচার্য বলেছিলেন।
একটা গল্প আছে, একবার কাশীতে শংকরাচার্য ভোরবেলা স্নানের পরে একটা মন্দিরে ঢুকছিলেন, সেই সময় এক চন্ডাল তাঁর চলার পথে এসে পড়ে। চন্ডালরা ছিল এক বিশেষ জাতি যারা শ্মশানগুলোর দেখাশোনা করত। তাদের সবচেয়ে নিচু জাতেরও নিচুতম এবং অশুভ মনে করা হতো। বিশ্বাস করা হতো, কোনও চন্ডালকে দেখে ফেলা মানেই মৃত্যু ঘটবে। তাদের সাথে কেউ ওঠাবসা করতে চাইতো না, তাদেরকে এড়িয়ে চলা হত।
তাই যখন এই লোকটি শঙ্করাচার্যের সামনে এলো, শঙ্করাচার্য বললেন “সরে যাও”। লোকটি সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল “কে সরে যাবে – আমি না আমার শরীর?” এই কথাটি শঙ্করাচার্যকে খুব জোর আঘাত করল। তিনি এতদিন সবাইকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, “এই দেহ তুমি নও, এ সবই মায়া”। এখন যখন এই লোকটি তাঁকে এই প্রশ্ন করল, এটা তাঁর বিবেককে জাগ্রত করল। এরপর থেকে তিনি আর একটা কথাও কখনও উচ্চারণ করেননি, কখনও কোনও শিক্ষা দেননি। তিনি একেবারে হিমালয়ে চলে গেলেন। কেদারনাথে আজও তাঁর একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে–তাঁর হাত এবং দণ্ডটি মার্বেলে খোদাই করা। এই জায়গাতেই তাঁকে শেষ দেখা যায়। কথিত আছে তিনি আরও উপরে উঠে যান এবং শিবের মধ্যে লীন হয়ে যান।
এটাই আমাদের দেশ এবং সংস্কৃতির মৌলিক প্রকৃতি–আমাদের উত্থান অন্যকে দমন করে নয়–আমাদের উত্থান শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। সে ঈশ্বর, পুরুষ, নারী, শিশু, জীবজন্তু, গাছ বা পাথর যাই হোক না কেন–আমরা প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে শিখেছি। এটাই আমাদের শক্তি হয়ে এসেছে, এর মাধ্যমেই আমরা পথ পেয়েছি, এর মাধ্যমেই আমাদের বিবর্তন হয়েছে, এটাই আমাদের উপলব্ধির প্রক্রিয়া হয়ে এসেছে।
হিমালয়ে ১৩ হাজার ৭০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত বদ্রিনাথ এক অসম্ভব সুন্দর জায়গা। বদ্রিনাথ সম্পর্কে একটি কাহিনী আছে। এখানেই শিব এবং পার্বতী বাস করতেন। একদিন শিব এবং পার্বতী বেড়াতে বেরোলেন। যখন ফিরে এলেন, তাঁদের বাড়ির প্রবেশপথে একটি ছোট্ট শিশু কাঁদছিল। শিশুটিকে প্রাণপনে কাঁদতে দেখে পার্বতীর মাতৃহৃদয় জেগে উঠলো, তিনি গিয়ে শিশুটিকে কোলে তুলে নিতে চাইলেন। শিব তাঁকে থামালেন এবং বললেন,”ওই শিশুটিকে স্পর্শ করো না”। পার্বতী উত্তর দিলেন ”কী নিষ্ঠুর আপনি, কীভাবে আপনি এটা বলতে পারেন?”।
শিব বললেন,”এই শিশুটি ভাল নয়। নিজে থেকে কীভাবে সে আমাদের দোরগোড়ায় উপস্থিত হল? এখানে আশেপাশে কেউ নেই, বরফের উপরে ওঁর বাবা-মায়ের কোনও পায়ের ছাপ নেই। এটা কোনও শিশু নয়”। কিন্তু পার্বতী বললেন, “আমি পারছি না! আমার মাতৃহৃদয় শিশুটিকে এই ভাবে পড়ে থাকতে দেবে না”। তিনি শিশুটিকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। শিশুটি পার্বতীর কোলে খুব আরামে বসে, শিবের দিকে খুব মহানন্দে তাকিয়ে রইল। শিব এর পরিণতি জানতেন কিন্তু তিনি বললেন, “বেশ, দেখা যাক কী হয়”।
পার্বতী শিশুটিকে আদর করে খাবার খাওয়ালেন তারপর তাঁকে বাড়িতে রেখে শিবের সঙ্গে পাশের এক উষ্ণপ্রস্রবনে স্নান করতে গেলেন। যখন তাঁরা ফিরে এলেন, দেখলেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পার্বতী আতঙ্কগ্রস্থ হলেন, “কে দরজা বন্ধ করল?” শিব বললেন, “আমি তোমাকে বলেছিলাম, শিশুটিকে তুলে এনো না। তুমি শিশুটিকে বাড়ির ভেতর এনেছ আর এখন সে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।”
পার্বতী বললেন, “আমাদের এখন কী করব?”
শিবের কাছে দুটো উপায় ছিল: এক, তাঁর সামনে সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা। আরেকটি উপায় ছিল অন্য কোনও পথ খুঁজে চলে যাওয়া। তাই তিনি বললেন,”চলো অন্য কোথাও যাই। যেহেতু এ তোমার প্রিয় শিশু, আমি একে স্পর্শ করতে পারব না।”
এই ভাবেই শিব তাঁর নিজের ঘর হারালেন আর শিব-পার্বতী হয়ে উঠলেন “অবৈধ বহিরাগত!” তাঁরা চারদিকে ঘুরে বেড়ালেন, বাস করার জন্য একটা আদর্শ জায়গা খুঁজতে লাগলেন, আর শেষমেষ কেদারনাথে গিয়ে স্থায়ী ভাবে বাস করতে লাগলেন। আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন_শিবতো সবই জানতেন। আপনিও অনেক কিছু জানার পরেও কোনও কিছু ঘটতে দেন কিনা।
শিবকে খুব শক্তিশালী এক স্বত্বা হিসেবে চিরকাল দেখা হয়, আবার একইসঙ্গে তিনি জাগতিক বিষয়ে তত কুশলী নন। তাই শিবের একটা রূপ হলো ভোলানাথ, কারণ তিনি হলেন শিশুর মত। তিনি যে বোকা তা নয় কিন্তু তিনি এই সব বিষয়ে তুচ্ছভাবে বুদ্ধিমত্তাকে প্রয়োগ করার প্রয়োজন বোধ করেন না।
কেবল ধূর্ত, নিচু স্তরের বুদ্ধিমত্তাই অনবরত ভেবে চলেছে কীভাবে অন্যের থেকে কিছু আদায় করা যায়। বুদ্ধিমত্তা এবং বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ছলচাতুরি দুটো আলাদা জিনিস। চালাক হওয়াটা সব সময়ই অন্যের সঙ্গে তুলনায় হয়। বুদ্ধিমান হওয়াটা অন্য কারোর তুলনায় হয় না, এটা যার যার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকৃতি। বুদ্ধিমত্তা তাৎপর্যপূর্ণ কারণ বুদ্ধিমত্তা কখনও প্রতিযোগিতায় থাকে না, এটা শুধুমাত্র জীবনের এক অভিব্যক্তি।
কিংবদন্তিতে কথিত আছে শিব এবং পার্বতী কান্তি সরোবরের তীরে বাস করতেন, আর কেদারে, অনেক যোগীরা ছিলেন যাঁদের সাথে তাঁরা দেখা করতেন। ২০১৩ সালের বন্যায় কান্তি সরোবরের জলই উপচে পড়ে কেদারে নেমে এসেছিল। এখন একে গান্ধী সরোবর নামে ডাকা হয়। এর আসল নাম কান্তি সরোবর। কান্তি মানে কৃপা, সরোবর মানে জলাশয়। এটি কৃপার জলাশয়। যোগের সংস্কৃতিতে, শিবকে কোনও দেবতা হিসেবে দেখা হয় না। তিনি এই মাটিতে হেঁটেছেন এবং যোগ পরম্পরার উৎসও তিনিই। তিনি হলেন আদিযোগী বা প্রথম যোগী, ও আদিগুরু বা প্রথম গুরু। যোগ বিজ্ঞানের প্রথম দীক্ষা হয় এই কান্তি সরোবরের তীরেই, যেখানে আদিযোগী তাঁর প্রথম সাতজন শিষ্য, যাঁরা এখনকার দিনে সপ্ত-ঋষি নামে সুপ্রসিদ্ধ, তাঁদের কাছে এই অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তির প্রণালীবদ্ধ ব্যাখ্যা শুরু করেছিলেন।
আমি একা, প্রত্যেক বছর এক-দুই মাস হিমালয় ভ্রমণ করতে যেতাম, বহু বছর আগে। সেই সময়ে আমি একা যেতাম, লোকাল বাসে চেপে। সাধারণত আমি বাসের মাথায় চড়ে যেতাম কারণ পাহাড়কে দেখা থেকে একটুও বঞ্চিত থাকতে চাইতাম না। এই বাসগুলো খুব অদ্ভুত হতো! হরিদ্বার থেকে ওরা ভোর চারটে - সাড়ে চারটে নাগাদ রওনা দিত - সোজা যেত হয় গৌরীকুন্ডে অথবা বদ্রিনাথে। লোক ওঠানো বা নামানো ছাড়া কোথাও থামত না–এমনকি খাবার খাওয়ার জন্যেও নয়। এদেরকে বলা হতো “ভুখ-হরতাল বাস”, অর্থাৎ “অনশন-ধর্মঘট বাস”। ড্রাইভার তাঁর নিজের রুটি রোল পাকিয়ে রাখত যেটা সে গাড়ি চালাতে চালাতে খেতো, আর এদিকে আপনি নিজে দুপুরে কী খাবেন তা ভেবে চলেছেন!
একবার আমি গৌরীকুণ্ড থেকে অনেকক্ষণ হেঁটে কেদারে পৌঁছেছিলাম, আমি কান্তি সরোবর সম্পর্কে শুনেছিলাম, তো একদিন বিকেলে দুটো আড়াইটা নাগাদ রওনা হয়ে ঘন্টাখানেকের একটু বেশি সময় বাদে ওখানে পৌঁছলাম। ওখানে সরোবর ছিল আর ছিল একে ঘিরে তুষার শৃঙ্গ, প্রাকৃতিক দৃশ্য হিসেবে এটা চমৎকার–বিশাল সরোবরের একেবারে স্থির জল, কোনও গাছপালা নেই আর সব তুষারাবৃত শৃঙ্গ সম্পূর্ণ স্থির জলে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। সে এক অবিশ্বাস্য জায়গা।
আমি শুধু বসলাম সেখানে, আর সেই প্রশান্তি, নিস্তব্ধতা এবং বিশুদ্ধতা আমার চেতনায় প্রবেশ করল। এই পাহাড়ে চড়া, উচ্চতা এবং এই জনমানবহীন স্থানের সৌন্দর্য আমাকে রুদ্ধশ্বাস করে ফেলল। আমি এই নিস্তব্ধতায় চোখ খুলে আমার চারপাশের প্রত্যেকটি আকারকে নিজের ভিতরে গ্রহণ করতে করতে একটা ছোট পাথরের উপর বসে রইলাম। ধীরে ধীরে চারিদিকের সবকিছু তাদের আকার হারিয়ে ফেলল আর শুধুমাত্র নাদ– শব্দ– বিদ্যমান রইল। পাহাড়, এই সরোবর আর সমগ্র চারিপাশ, এমনকি আমার শরীরটারও সহজাত আকারের কিছুই রইল না- সবকিছুই কেবল শব্দ। আমার ভিতরে একটা সংগীত উদ্গত হলো- ”নাদ ব্রহ্ম বিশ্ব স্বরূপ।”
নাদ ব্রহ্ম বিশ্বস্বরূপ
নাদ হি সকল জীব রূপ
নাদ হি কর্ম নাদ হি ধর্ম
নাদ হি বন্ধন নাদ হি মুক্তি
নাদ হি শংকর নাদ হি শক্তি
নাদম নাদম সর্বম নাদম
নাদম নাদম নাদম নাদম
আমি সব সময়ই সংস্কৃত ভাষা শেখাটা এড়িয়ে এসেছি। যদিও এই ভাষাটা খুবই পছন্দ করি আর এর গভীরতাও বুঝি। আমি শেখাটা এড়িয়ে গেছি, কারণ সংস্কৃত শিখলেই অবধারিতভাবে শাস্ত্র পাঠে নিমগ্ন হতে হবে। কখনও কোনও ব্যাপারে আমার নিজের ধারণা-উপলব্ধি বিফল হয়নি, এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও নয়, তাই আমি নিজেকে শাস্ত্র আর এইসব প্রথাগত জিনিস দিয়ে ঘেঁটে ফেলতে চাই না। তাই আমি সংস্কৃত এড়িয়েছিলাম।
যখন আমি সেখানে বসে ছিলাম, আমার মুখ নিঃসন্দেহে বন্ধ ছিল আর চোখ খোলা ছিল, আমি খুব উচ্চস্বরে এই সংগীত শুনতে পাচ্ছিলাম, নিজেরই কন্ঠস্বরে। আমার কণ্ঠস্বরেই গানটি হচ্ছিল, আর গানটা ছিল সংস্কৃতে। আমি পরিষ্কার শুনছিলাম, বেশ জোরে। এত জোরে যে মনে হচ্ছিল পুরো পাহাড়টাই যেন গাইছে। আমার অভিজ্ঞতায়, সবকিছু শব্দে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এইরকম অবস্থায় আমি এই সংগীতটিকে উপলব্ধি করেছিলাম। আমি এটাকে তৈরি করিনি, আমি এটা লিখিওনি–এটা যেন স্বয়ং নিজেই আমার উপরে নেমে এল। সম্পূর্ণ সংগীতটা বেরিয়ে এলো সংস্কৃতে। পুরো অভিজ্ঞতাটাই ছিল বিহ্বল করে দেওয়ার মতো।
ধীরে ধীরে কিছু সময় পরে, সবকিছু আবার তাদের আগের আকারে ফিরে এলো। আমার সচেতনতার পতন – নাদ থেকে রূপে পতন– আমার দুচোখ জলে ভরিয়ে দিল।
নাদব্রহ্ম কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল জগৎকে শব্দ হিসেবে অনুভব করা, আকার হিসেবে নয়। আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে প্রত্যেক শব্দের সাথে একটা আকার সংযুক্ত আছে, আর প্রত্যেক আকারের সাথে একটা শব্দ সংযুক্ত আছে। এটা একটা বিজ্ঞানসম্মত বাস্তব। আর এখন আমরা এও জানি যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে জড়বস্তু বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। যেখানেই কম্পন আছে, সেখানে শব্দ থাকতে বাধ্য। তাই যোগে আমরা বলি সমগ্র সৃষ্টিই শব্দ।
আপনি যদি নিজেকে শুধু এই সঙ্গীতে উৎসর্গ করেন, এক ধরনের শক্তি আছে এর মধ্যে। যে কোনও ব্যক্তিকে বিলীন করে দেবার ক্ষমতা এর আছে, যদি সত্যি সত্যি এর মধ্যে ডুব দিতে পারেন।