যোগ প্রক্রিয়ার পুরোটাই হল, মনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যাওয়া। আসলে যতক্ষণ আপনি মনের সীমার মধ্যে আছেন, আপনার অতীতই আপনাকে শাসন করে। কেননা মন হল স্রেফ কিছু অতীতের সঞ্চয়। এখন আপনি যদি জীবনকে শুধু মনের চশমা দিয়েই দেখেন, তাহলে আপনার ভবিষ্যৎকে তো হুবহু আপনি অতীতের মতোই গড়বেন — না কিছু বেশি, না কিছু কম, এই পৃথিবীই কি তার যথেষ্ট প্রমাণ নয় ? কেননা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা অমনই নানা কিছু ভাঙিয়ে আমরা কী কী সুবিধা পেয়েছি, তাতে কিস্যু যায়-আসে না। আদতে আমরা কি ইতিহাসের একই দৃশ্যকেই বারবার ঘটিয়ে যাচ্ছি না ?

মন সক্রিয় থাকা মানেই অতীতেরও বেঁচে থাকা। ধরুন, মন যদি এই মুহূর্তেই কাজ বন্ধ করে দেয়, তখন আপনাদের অতীত কি আর থাকবে ?

আপনারা যদি নিজেদের জীবনকে একটু খুঁটিয়ে দেখেন, তবে দেখবেন সেখানেও একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। কেননা ওই যে, যতক্ষণ মনের চশমা দিয়ে দেখবেন, ততক্ষণই তো পুরোনো অভিজ্ঞতার হিসেবেই আপনি চলতে থাকবেন। অতীতকে আসলে আপনারা শুধু মনের ভিতরেই বয়ে বেড়ান। মন সক্রিয় থাকা মানেই অতীতেরও বেঁচে থাকা। ধরুন, মন যদি এই মুহূর্তেই কাজ বন্ধ করে দেয়, তখন আপনাদের অতীত কি আর থাকবে ? দেখুন, এখানে কোনও অতীত নেই, শুধুই বর্তমান। যে বর্তমানই কিনা একমাত্র বাস্তব। কিন্তু তবু অতীত রয়ে গেছে আমাদের মনের মাঝখানে। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, মনই হল কর্ম। তাই মনকে যদি আপনি শ্রেষ্ঠ করে তুলতে পারেন, তাহলে একই সঙ্গে কর্মের বন্ধনকেও অনেক উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে পারবেন। আর যদি ভাবেন, ওগুলোকে একে একে উন্নত করবেন, তবে তার জন্য দশ লক্ষ বছরও লেগে যেতে পারে। কেননা ওই সমাধান প্রক্রিয়া চলার মধ্যেও তো আপনার নতুন নতুন কর্মের তালিকা বাড়তেই থাকবে।

অর্থাৎ আপনার কর্মের পুরনো সঞ্চয় মোটেই কোনও সমস্যা নয়। আপনাকে শুধু শিখতে হবে, কীভাবে নতুন সঞ্চয় গড়া আটকানো যায়। ওটাই হল আসল ব্যাপার। পুরনো সঞ্চয় একদিন নিজেই খসে যাবে, ওটা নিয়ে তেমন কিছুই করতে হবে না। কিন্তু মূল ব্যাপার হল, আপনাকে শিখতে হবে, নতুন সঞ্চয় না গড়েও কীভাবে থাকা যায়। এটা করতে পারলে পুরনো সঞ্চয়কে ত্যাগ করা ভীষণ সহজ।

আপনারা যদি মনকে অতিক্রম করতে পারেন, তবেই কর্মের বন্ধনকেও পুরোপুরি কাটাতে পারবেন। এর জন্য আপনাদের কোনও সমাধান খুঁজতে হবে না, কারণ নিজের কর্মের সঙ্গে যুঝতে যাওয়া মানেই তো কোনও অস্তিত্বহীনের নাগাল খোঁজা। এটাই তো মনের একটা ফাঁদ। অতীতের কোনও অস্তিত্ব নেই, কিন্তু আপনার কারবার তবু সেই অস্তিত্বহীনের সঙ্গেই। তাকে নিয়ে এভাবে চলেছেন, যেন ওটাই বাস্তব। আসলে এর সবটাই হল বিভ্রম আর মন হল এর সূত্রপাত। তাই মনকে যদি একবার এর ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে একই সঙ্গে সব কিছুই উন্নত করতে পারবেন।

গোটা অধ্যাত্মবিজ্ঞানই মনের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা পেরিয়েও জীবনকে কীভাবে অনুভব করা যায়, তারই প্রচেষ্টা। বহু মানুষই বিভিন্ন রকম ভাবে যোগের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ বলেন, “যদি ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে একাত্ম হতে চান, তবে যোগই সেই মাধ্যম।” কেউ বলেন, “যদি নিজেকে অতিক্রম করতে চান, তবে যোগই সেই পথ।” আবার এমনটাও কেউ বলেন, “যদি শরীরের সমস্ত দাসত্ব থেকেই মুক্ত হতে চান, তবে শুধু যোগই সেই মার্গ।” এগুলো সবই খুব সুন্দর আর চমৎকার একেকটি সংজ্ঞা, এতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু নিজেদের অনুভূতির অঙ্ক দিয়ে এগুলোকে ঠিক মেলাতে পারবেন না। যেমন কেউ বলেন, “শুধু যোগের পথেই ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারবেন।“ কিন্তু আপনারা তো নিজেদের অবস্থাটাই জানেন না। যেমন কিনা জানেন না ঈশ্বরের ঠিকানাও। তা হলে এক হবেন কীভাবে?

যদিও পতঞ্জলি এর মীমাংসা করে গেছেন এভাবে—“মনের নানা পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে ওঠার লক্ষ্যে যখন মনকে স্তব্ধ করে দেন, যখন মনের অংশ হয়ে থাকাকে মুছে ফেলেন, তাই হল যোগ।” বিশ্বের যাবতীয় প্রভাবই আপনাদের ভিতরে পড়ছে শুধু মনেরই ক্ষমতায়। তাই সম্পূর্ণ সচেতন থেকে যদি একবারও মনের প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন, তবে খুব সহজ পথেই সবকিছুর সঙ্গে একাত্ম হতে পারবেন। আপনার সঙ্গে আমার, সময়ের সঙ্গে মহাশূন্যের—সমস্ত ব্যবধানই এই মনের কারণে। এ হল মনেরই বন্ধন দশা। কিন্তু যদি একবারও এই মনকে বাদ দিতে পারেন, তাহলেই মুছতে পারবেন সময় ও মহাশূন্যের ফাঁকটুকু। তখন আর এটা আর ওটা বলে কিছু নেই। এখানে আর সেখানে বলে কিছু নেই। এমনকী এখন আর তখন বলেও কিছু নেই। সবই এখানে এবং এই মুহূর্তেই।

যদি মনের যাবতীয় পরিবর্তন আর পরিবেশনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন, একমাত্র তখনই আপনারা এই মনকে যেভাবে ও যেদিকে খুশি চালাতে পারবেন। পারবেন জীবনের ক্ষেত্রে তার প্রচণ্ডতম প্রভাবটিকে ব্যবহার করতে। কিন্তু যদি এই মনের মধ্যেই রয়ে যান, মনের প্রকৃতিটিকে তবে কখনোই আর বুঝতে পারবেন না।