সুস্বাস্থ্য তৈরি করার জন্য যে তিনটি মৌলিক বিষয়ের দিকে আপনাকে নজর দিতে হবে, তা নিয়েই আলোচনা করছেন সদগুরু।

#১ সঠিক খাদ্য গ্রহণ করা

সদগুরু: খাদ্যের বিষয়ে বলতে হলে, যে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি নিয়ে আপনাকে সচেতন হতে হবে তা হল, কোন ধরনের খাদ্য কত দ্রুত হজম হয় এবং আপনার শরীরের অংশে পরিণত হয়। আপনি কিছু খেলেন এবং সেটা যদি তিন ঘণ্টার মধ্যে হজম না হয়, তাহলে হয় আপনাকে সেই খাবারটি এড়িয়ে চলতে হবে অথবা পরিমাণে কম খেতে হবে। যদি খাবারটি তিন ঘণ্টার মধ্যে আপনার পেট থেকে বেরিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে খাবারটি সেরা কিছু না হলেও, আপনার শরীর অন্তত সেই খাবারটিকে সহজে হজম করতে সক্ষম।

আপনার বয়স যদি তিরিশ বছরের বেশি হয় তাহলে আপনার জন্য দিনে দুবার ভালো ভোজনই যথেষ্ট হবে – একবার সকালে এবং একবার সন্ধ্যায়।

মাঝখানে কিছু না খেয়ে, যদি আপনি দুটি আহারের মধ্যে পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টার স্পষ্ট ব্যাবধান রাখেন, তাহলে আপনার শরীরের প্রতিটি কোষের পরিশোধন হবে। কোষের স্তরে এই পরিশোধন স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার বয়স যদি তিরিশ বছরের বেশি হয় তাহলে আপনার জন্য দিনে দুবার ভালো ভোজনই যথেষ্ট হবে – একবার সকালে এবং একবার সন্ধ্যায়।

সন্ধ্যার খাদ্য গ্রহনের তিন ঘণ্টা পরেই ঘুমানো উচিত। যদি তার মধ্যে কুড়ি থেকে তিরিশ মিনিটের হাল্কা শারীরিক ক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকে, যেমন ধরুন কিছুটা হাঁটাহাঁটি, আপনার শরীর অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর থাকবে। যদি আপনি পেটের ভেতর খাবার নিয়ে ঘুমোতে যান, তবে এটি আপনার শরীরে একটা জড়তা তৈরি করবে। শারীরবৃত্তীয় দিক থেকে, এই জড়তা আপনাকে মৃত্যুর দিকে ত্বরান্বিত করে। মৃত্যুই হল চূড়ান্ত জড়তা।.

আরেকটি ব্যাপার হল, আপনি যদি খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই ঘুমোতে যান, তবে এটি আপনার শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হবে। সেইজন্যই, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনি যে খাবারটি খেয়েছেন সেটি ঘুমোতে যাওয়ার আগে যেন আপনার পেট থেকে বেরিয়ে যায়। বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঘুমানোর সময় আপনার পেট যেন আপনার শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে।

#২ আপনার শরীরকে ব্যাবহার করুন

যখন কাজকর্মের কথা আসে, তখন একটি বিষয় যা আমাদের খেয়াল রাখা উচিত, তা হল, আমরা যেন আমাদের শরীরকে সামনে, পিছনে বা বিভিন্ন দিকে বাঁকাতে সক্ষম হই। যে কোনও প্রকারেই হোক, এইটুকু ক্রিয়া আমাদের শরীরে অবশ্যই হওয়া উচিত। ধ্রুপদি হঠযোগ এটি করার সর্বোত্তম উপায় এবং এটি বৈজ্ঞানিক। হঠযোগ যদি এখনও আপনার জীবনের অংশ না হয়ে থাকে, তবে আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে প্রতিদিন আপনি কোনও না কোনও ভাবে শরীরকে সামনে, পিছনে, দুপাশে বাঁকাতে এবং মেরুদণ্ডটি যেন প্রসারিত করতে সক্ষম হন। আপনি যদি আপনার পুরো দেহতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে চান- বিশেষত স্নায়ুতন্ত্রকে, তাহলে রোজ সবার জন্যই এটা জরুরি, অন্যথায় বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

#৩ পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন…তবে খুব বেশি নয়!

একজন ব্যক্তির কতটা বিশ্রামের প্রয়োজন তা বিভিন্ন কারণ দ্বারা নির্ধারিত হয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল আপনি যে খাদ্যগ্রহণ করছেন, সেটির প্রকার এবং পরিমাণ। আপনাকে অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের খাবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কোন খাবারটি খেয়ে ভারি বোধ করছেন এবং কোনটিতে আপনি হাল্কা এবং তরতাজা অনুভব করছেন। আপনি যদি নিশ্চিত করেন আপনার আহারের শতকরা ৪০% ভাগ টাটকা শাকসবজি এবং ফল রয়েছে, তবে দেহে হাল্কা ভাব থাকবে।

শরীরের যা প্রয়োজন তা হল বিশ্রামরত অবস্থা, সেটা যে ঘুম হতেই হবে তা নয়। নিদ্রাই বিশ্রাম করার একমাত্র উপায়, এটি ভাবাই একটি ভুল ধারনা। এমনকি আপনি বসে থেকে বা দাঁড়িয়ে থেকেও বিশ্রাম করতে পারেন অথবা উত্তেজিত বা জড়তায় থাকতে পারেন। যদি আপনি প্রাণবন্ত অবস্থায় বিশ্রামরত থাকেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, তাহলে দেখবেন, আপনার প্রয়োজনীয় ঘুমের পরিমাণ হ্রাস পাবে।

শরীরের পাঁচটি স্তর

যোগে আমরা মানব তন্ত্রকে পাঁচটি স্তর হিসেবে দেখি। মন সহ, মানব তন্ত্রের প্রতিটি বিষয়কেই দেহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং এটিকে রূপান্তরিত করার প্রযুক্তি হল যোগ। দেহের এই পাঁচটি স্তরকে বলা হয় অন্নময় কোষ, মনোময় কোষ, প্রাণময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ এবং আনন্দময় কোষ।.

অন্ন মানে খাবার। আপনার ভৌত দেহ বা অন্নময় কোষ হল মূলত আপনি যে খাবারটা খেয়েছেন - তা সে বড় না ছোট হবে তা আপনার পছন্দ, কিন্তু আদতে শরীরটি আসলে একটি খাবারের স্তূপ। বাইরে থেকে সংগৃহীত উপাদান দিয়ে গঠিত যেমন একটি ভৌতিক শরীর আছে, ঠিক তেমনি একটি মানসিক শরীরও রয়েছে। মন দেহের কোনও একটি নির্দিষ্ট অঙ্গ নয় – দেহের প্রতিটি কোষের একটি নির্দিষ্ট নিজস্ব স্মৃতি এবং বুদ্ধি রয়েছে। এই মানসিক শরীরটি মনোময় কোষ নামে পরিচিত। ভৌত দেহটি হল হার্ডওয়্যার এবং মানসিক দেহ হল সফট্‌ওয়্যার।

ভৌত শরীর, মানসিক শরীর এবং প্রাণ শরীর, সবই ভৌতিক সীমায় আবদ্ধ, তবে এরা অবস্থান করে সূক্ষ্মতার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে।

হার্ডওয়্যার এবং সফট্‌ওয়্যার সঠিক উপায়ে কাজ করবেনা যদি না আপনি তাতে সঠিক মানের শক্তি সঞ্চারিত করেন। দেহের তৃতীয় স্তরটিকে প্রাণময় কোষ বা প্রাণ শরীর বলা হয়। ভৌত শরীর, মানসিক শরীর এবং প্রাণ শরীর, সবই ভৌতিক সীমায় আবদ্ধ, তবে এরা অবস্থান করে সূক্ষ্মতার ভিন্ন ভিন্ন স্তরে। সাদৃশ্য টেনে বলতে হলে, আপনি স্পষ্ট দেখেন যে, বৈদ্যুতিক বাল্বটি হল ভৌত। কিন্তু এটা যে আলোক বিচ্ছুরিত করে, সেটিও ভৌত। আবার এর পিছনে থাকা বৈদ্যুতিক শক্তিও ভৌত। বাল্ব, আলো এবং বিদ্যুৎ - সবই হল ভৌত, সূক্ষ্মতার মাত্রায় তারতম্য আছে। একই ভাবে ভৌত শরীর, মানসিক শরীর এবং প্রাণ শরীর – সবই ভৌতিক কিন্তু সূক্ষ্মতার তারতম্য আছে।

দেহের পরবর্তী স্তরটি হল পরিবর্তনশীল, যেটি বিজ্ঞানময় কোষ নামে পরিচিত। এটি ভৌতিক থেকে আভৌতিকের রূপান্তরে সহায়তা করে। এটি কোনও ভৌতিক গুণাবলিকে বহন করে না, তবে একই সাথে এটি পুরোপুরি আভৌতিকও নয়। পঞ্চম স্তরটিকে বলা হয় আনন্দময় কোষ, ইংরাজিতে যেটি দাঁড়ায় ‘ব্লিস্‌ বডি’ (bliss body) বা আনন্দময় শরীর। এর অর্থ এই নয় যে আপনার মধ্যে একটি আনন্দের বুদবুদ রয়েছে। আমরা এটিকে আনন্দময় শরীর এই কারণে বলি যে, আমাদের অনুভবে, যখনই এটিকে স্পর্শ করি আমরা পরমানন্দে পূর্ণ হয়ে উঠি। পরমানন্দ এর প্রকৃতি নয়, আমাদের জন্য এটি যে প্রভাব সৃষ্টি করে সেটিই পরমানন্দ। আনন্দময় কোষ হল সেই আভৌতিক মাত্রা, যা কিনা, যা কিছু ভৌতিক সেই সবেরই উৎস।

আপনি যদি ভৌত শরীর, মানসিক শরীর এবং প্রাণ শরীরের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য এবং ভারসাম্য নিয়ে আসতে পারেন, তবে আপনার কোনও শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা থাকবে না। আমি আপনাদের শত সহস্র মানুষকে দেখাতে পারব যারা তাদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা থেকে, বিশেষত দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা এবং মানসিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সামঞ্জস্য তৈরি করে। এগুলির মধ্যে অসামঞ্জস্যই সব রকমের সমস্যার সৃষ্টি করে। শরীর যখন স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, তখন কোনও রোগও থাকে না।

আপনি যদি শুধুমাত্র দেহের এই প্রথম তিনটি স্তরের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে পারেন, তবেই সেখানে আনন্দময় কোষকে স্পর্শ করার একটি পথ এবং সম্ভাবনা তৈরি হবে, যেখানে পরমানন্দে থাকাটাই একটি স্বাভাবিক অবস্থা হয়ে উঠবে। কোনও বিশেষ কিছুর জন্য আনন্দময় নয়, এমনিতেই আনন্দময়, কারণ সেটিই জীবনের প্রকৃতি।

সম্পাদকের কথা: ব্যস্ততায় ভরা জীবন, টেবিলে বসে কাজ ও দূষণের এই বিশ্বে সুস্বাস্থ্যকে যেন এক দুর্লভ বস্তু বলে মনে হয়। এই ভিডিওতে সদগুরু আমাদের স্বাস্থ্যের কিছু অনন্য যৌগিক প্রেক্ষিত দিয়েছেন। কয়েকটি সাধারণ মৌলিক বিষয়ের ওপর নজর দিলে আপনিও নিজের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন।