সদগুরু এবং প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, ফ্যাশন ডিজাইনার, কবি ও শিল্পী মুজফফর আলির মধ্যে বহুমুখী এক আলোচনার সময়ে হঠাৎই উঠে আসে অতীতের বিশিষ্ট কবিদের প্রসঙ্গ। সদগুরু তখন বলেন, রুমি বা কবীরের মতো কবিদের অমর সৃষ্টির অনুকরণ না করে আমাদের উচিত আত্ম-উপলব্ধির দিকে দৃষ্টি দেওয়া, যা থেকেই একদিন জন্ম নিয়েছিল কাব্যের অমৃতধারা। বিশ্ব কবিতা দিবসের প্রেক্ষাপটে মানুষের সুগভীর আত্মিক উপলব্ধি ও তার ভাবপ্রকাশ নিয়ে দুই কবির এই অমূল্য আলোচনার রস উপভোগ করুন।

মুজফফর আলি: দৃষ্টান্তমূলক মনীষীদের জীবন আমরা বুঝব কীভাবে ? এমন কিছু মনীষীজীবন রয়েছে, যা কিনা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং নিবিড় মানব-সম্পর্ক স্থাপনের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত জরুরি। রুমি, খসরু বা কবীরের মতো ব্যক্তিত্বদের তাই আজ নতুন করে বরণ করা উচিত—কেননা তাই হয়তো আমাদের জীবনকে আলোকিত করার এক নতুন সূত্র হবে।

সদগুরু: আপনি যখন দৃষ্টান্তমূলক কথাটা বললেন, তখন আপনি নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছিলেন যে অন্যান্যদের জীবনে তা উদাহরণ হয়ে উঠবে। কিন্তু রুমি বা কবীরের মতো ব্যক্তিত্বদের আমাদের এমনিই উপভোগ করা উচিত। তাঁদের অনুকরণ করা উচিত নয়। ওঁরা হলেন বাগানের ফুলের মতন। আর আপনি কোনও ফুল হওয়ার চেষ্টা করেন না। ফুলকে আপনি স্রেফ উপভোগ করেন। যেখানেই জন্মান, ওসব মানুষ খুব সুন্দর হয়েই ফুটে ওঠেন। অমন অনেকেই ফুটে উঠেছিলেন।

গদ্যের বিপরীতে কবিতা কেন বেশি তাৎপর্যময়, তার কারণ হল, মানুষের জীবনে এমন অসংখ্য উপলব্ধি ঘটে, যাকে কোনও যুক্তির কাঠামোয় বাঁধা যায় না।.

এমনকী আজও প্রতিটি গ্রাম বা শহরেই কেউ না কেউ ঠিকই রয়েছেন, যাঁরা হয়তো সেই মাপের খ্যাতি পাননি। কেউ হয়তো কিছুটা উঁচুতে উঠেছেন, কেউ তাও পারেননি—ওটা তো সমাজ বা ইতিহাসের ব্যাপার, কিন্তু সেই দিক বা দেখার ভঙ্গিটা তো আর ফুরিয়ে যায়নি, কখনও তা ফুরোতে পারে না। কোথাও ঠিকই তা নানাভাবে পথ খুঁজে নেয়। আসলে কবীরকে আমাদের জন্য উদাহরণ না বানিয়ে, আমাদের উচিত কবীরের অন্তরের সেই উপলব্ধির দিকে ফিরে যাওয়া, যা তাঁকে করে তুলেছিল অমন এক উচ্ছ্বাসময় মানব।

মানুষের বাইরের সক্ষমতার কথাই যদি ধরা হয়, তবে আমাদের সকলেই কিন্তু আলাদা আলাদা বিষয়ে দক্ষ। আপনি যা করতে পারেন, আমি তা করতে পারি না। আবার আমি যা করতে পারি, আপনি তা করতে পারেন না। কিন্তু অন্তরের সম্ভাবনার বেলায় আমরা সকলেই কিন্তু সমান দক্ষ। অথচ কেন একজনের ভিতরে সেই সম্ভাবনাটুকু বিকশিত হল, আবার আরেকজনের বেলায় হলই না? এর একমাত্র কারণ হল, একজন সেই দিকটিতে মনোযোগী হয়েছিলেন, আরেকজন কিন্তু মোটেও হননি।

কবীর যা কিছুই ছিলেন, যা কিছুই ছিলেন রুমি, কৃষ্ণ কিংবা আদিযোগী—আমাদের সকলেই তা হতে পারি। কিন্তু আমরা সকলেই কি অমন কবিতা পারি—অমন সঙ্গীত, নৃত্য কিংবা জটিল গণিত ? সম্ভবত পারি না। অথচ আমাদের সকলেরই তো ওই একই অনুভুতি বা উপলব্ধি অর্জনের ক্ষমতা আছে। তাই কবীরের মধ্যে যখন সেটা ঘটে, হয়তো সেই বোধই বয়ে এসেছিল তাঁর কবিতায় — যে সামাজিক বা অন্যান্য পরিস্থিতির মধ্যে তিনি ছিলেন, তার উপরে ভিত্তি করে। তবে আজ যদি কারও মধ্যে এমনটা ঘটত, তিনি হয়তো সম্পূর্ণ অন্য কিছুই করতেন। অন্তত তিনি নিশ্চয়ই হুবহু একই জিনিস করতেন না।

কোনও মানুষ কীভাবে তাঁর ভাবটুকু প্রকাশ করছেন, তার থেকেও অনেক জরুরি হল তাঁর সেই ভিতরের-উপলব্ধি, যার জোরেই তিনি এই সব কাব্য, নৃত্য, সঙ্গীত, গণিত বা বিজ্ঞান সৃষ্টি করতে পারছেন। এই ভাবের প্রকাশ আলাদা আলাদা মানুষের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা রকমের হলেও তা থাকে একই রকম নিখুঁত সুন্দর। কোনও কিছু দেখে আপনি হয়তো একটি চলচ্চিত্র বানাতে চান। আবার আমি কিছু দেখলেই তক্ষুনি ভাবতে বসি, কীভাবে এ থেকে কোনও শাস্ত্র বা পদ্ধতি বানানো যায়, যা মানুষের কাছে সেই অনুভবটি এনে দেবে।

কীভাবে এই বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তা অন্য কথা, এবং তার অত আলাদা রকমের হওয়াটাও চমৎকার। কিন্তু অন্তরে যা ঘটে, তা আমাদের সকলের জন্যই সম্ভব। এটা ঘটছে না কারণ সঠিক মনোযোগ বা তৎপরতা দেওয়া হচ্ছে না। সকলেই যে অন্যান্য এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত। এই কারণে প্রতিটি প্রজন্মে, বিগত কীর্তির প্রশংসা করার বদলে মানুষের মধ্যে সেই অনুভব নিয়ে আসার অবিরাম চেষ্টা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, আমরা সেই স্রষ্টাদের সম্মান, স্মরণ ও বরণ করব বইকী। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আমাদের মধ্যেও যে সেই একই সম্ভাবনা রয়েছে, তাঁরা এই স্পষ্ট বার্তাই আমাদের মনে করিয়ে দেন।

তাঁরা যদি বিশুদ্ধ হন এবং তাঁরা যা অনুভব করেছেন তা যদি আজ আর সম্ভব না হয়, তা হলে বুঝতে হবে সেটা একটি অবান্তর প্রক্রিয়া। ফলে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রতিটি প্রজন্মেই সেই উপলব্ধি করার মতো হাজার হাজার মানুষ চাই। একমাত্র তখনই ঐতিহ্য প্রাণ ফিরে পাবে এবং তা সজীব থাকবে। তাই অনুভবকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন অতীতের বলা বা লেখাকে নিছক অনুসরণ না করে, তাকে তন্নতন্ন করে ঘেঁটে তার সারমর্মটুকু উপলব্ধি করা।

মুজফফর আলি: অতীন্দ্রিয়বাদী বা ঐশ্বরিক মনীষীদের কবিতাকে বোঝার জন্য আমি আমার গোটা জীবনটাকেই উৎসর্গ করেছি, আর তাঁদের কবিতায় একটা ব্যাপারই আমি খুঁজে পেয়েছি, তা হল জ্বালা। তবে বরাবরই এমন কবিতা খুঁজে বেড়ালেও এখনকার কবিতায় সেই শুদ্ধতা কিন্তু আমি আর পাই না, যা মানুষের অন্তরকে ছুঁতে পারে। এই একুশ শতকে ওই ধরনের কবিতা হারিয়ে গেছে, কেননা মানুষের মধ্যে আর সেই জ্বালা নেই, আর তাই তারা এমন কিছু লিখতেও পারে না, যা মানুষের অন্তরে মিশে যাবে। এটাই হল এই সমাজের একটা মারাত্মক লক্ষণ। হতে পারে আপনার গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞান থেকে ব্যাপারটার কারণ আমরা খুঁজে পাবো, কিন্তু সত্যিই এ এক মারাত্মক ব্যাপার ঘটছে। আমার কাছে, কবিতা হল সেই পবিত্রতম শিল্প, বাদবাকি সমস্ত শিল্পেরই যা জন্ম দেয়। এটি এমন এক শিল্প, যার মধ্যে গোটা বিশ্বের এবং সমস্ত সমাজেরই মুখ দেখা যায়। কবিতাকে ঠিক কেনা যায় না, তাকে আসতে হয় ভেতরের সেই জ্বালা থেকে। কবিতাই আমাদের বহু পথের হদিশ দেয়। কবিতা নিয়ে যেতে পারে স্থাপত্যের দিকে, নিতে পারে কারুশিল্পে, বা সঙ্গীতে, এমনকী নৃত্যেও — যে কোনও পথেই পৌঁছে দিতে পারে কবিতা। কিন্তু যদি ওই জ্বালাটি না থাকে, তা হলে নৃত্যও থাকবে না।

সদগুরু: গদ্যের বিপরীতে কবিতা কেন বেশি তাৎপর্যময়, তার কারণ হল, মানুষের জীবনে এমন অসংখ্য উপলব্ধি ঘটে, যাকে কোনও যুক্তির কাঠামোয় বাঁধা যায় না। আপনারা হাইস্কুল বা কলেজে পড়ার সময়ে যদি কোনও ব্যাং কেটে তার হৃৎপিণ্ডটাকে দেখে থাকেন, তবে তা থেকে একেবারেই গদ্যের ভাষায় কোনও গবেষণামূলক প্রবন্ধ হয়তো বা লিখে থাকতে পারেন। কিন্তু ধরুন, খুব প্রিয় কেউ আপনার হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। তখন তা নিয়ে যদি আপনি গদ্যের আকারে কিছু লিখতে চান, সেটাকে তো বোকামো মনে হবে, কেননা যুক্তির দিক দিয়ে তা মোটেও ঠিক নয়। অর্থাৎ সেই সব মানুষ যাঁরা কিনা উপলব্ধির যুক্তিহীন দিকগুলোকেও ছুঁতে পারেন, তাঁদের কবিতারই আশ্রয় নিতে হয়, কেননা তাই হল একমাত্র উদ্ধার।

যখনই আপনি কবিতা লেখেন, প্রেম ব্যাপারটা যেন হঠাৎই বড় সুন্দর হয়ে ওঠে, কেননা একমাত্র কবিতার মধ্য দিয়েই যে যা-কিছু যুক্তিহীন, তা ভাষা খুঁজে পায়। এজন্যই অতীন্দ্রিয়বাদী বা ঐশ্বরিক মনীষীরা সকলেই কবিতার দিকে ঝুঁকেছেন, কারণ কবিতা কীভাবে আসে ? এ তো আপনার বেছে নেওয়ার বিষয় নয়, এ হল একান্তই বাধ্যতামূলক কিছু ! কেননা ওই সব উপলব্ধিকে ভাষায় প্রকাশের যে আর কোনও রাস্তা নেই।

মুজফফর আলি: এ হল মূল সত্যেরও মূল কথা, তারও মূল সারটুকু। আর এর মধ্যেই রয়েছে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছনোর ছন্দটুকু, কেননা সব কিছুরই গভীরে যেতে হলে একটি ছন্দ লাগে।

সদগুরু: না, কবিতার থেকে কিন্তু আপনার ভিতরে ছন্দ আসে না। আসলে আপনার ভিতরে ছন্দ থাকার জন্যই কবিতা আপনার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

সম্পাদকের মন্তব্য: সদগুরুর যাবতীয় কবিতাই দুটি সংকলনে পাওয়া যায়। ‘পোয়েটিক ফ্লিং’ (কাব্য নিক্ষেপ) নামে এক ডিভিডি-তে, সদগুরু যেখানে তাঁর কবিতা আবৃত্তির সঙ্গেই যে-পরিস্থিতিতে সেগুলির সৃষ্টি তা ব্যাখ্যা করছেন, এবং ‘ইটারনাল ইকোস’ (শাশ্বত প্রতিধ্বনি) নামের ই-বুক মাধ্যমে, যা ওঁর মোট ৮৪টি কবিতার এক মনোজ্ঞ সংকলন।.