গৌতম গম্ভীর: জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে দাঁড়ানো উচিত কি না তা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সে ব্যাপারে আমি আপনার অভিমত জানতে চাই। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, দেশ আমাদের জীবনকে যেভাবে সমৃদ্ধ করে তাতে ওই বাহান্ন সেকেন্ডের জন্য উঠে দাঁড়ানো নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকাই উচিত নয়, তা সে সিনেমা হল বা স্কুল, যেখানেই বাজানো হোক না কেন। আমার ভাবনা সঠিক কি না, আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।

সদগুরু: নমস্কার গৌতম! তোমাকে যে এই প্রশ্নটা আজ এ দেশে দাঁড়িয়ে করতে হচ্ছে, তা কি যথেষ্ট হাস্যকর ও দুর্ভাগ্যজনক নয়?

আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, দেশ বা জাতি কোনও ঈশ্বর প্রদত্ত জিনিস নয়। এটি একটি বিমূর্ত ধারণা মাত্র, যার সাথে আমরা সকলে সহমত হয়েছি। এক দেশ বা জাতির এই ধারণাটি মুর্ত হয়ে ওঠে সংবিধানের মাধ্যমে এবং এর প্রতীকী রূপটি প্রতিফলিত হয় জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। সুতরাং, মৌলিক বোধটি হল, যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে ক্রীয়াশীল হতে চাই, একক জাতি হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই বা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে চাই, সেক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল দেশের জন্য গর্বের অনুভূতি ও আনুগত্য প্রকাশের সদিচ্ছা।  

আপনি শেষ কবে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে অংশ নিয়েছেন ? আপনি শেষ কবে স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন করেছেন ? শেষ কবে আপনি জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছেন ?

আমি জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা বলার মানুষ নই। আমি মানবতাবাদে আস্থাশীল। আমি মানব অস্তিত্বের সার্বজনীনতায় বিশ্বাসী। কিন্তু এই মুহূর্তে যে সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা তুমি ভাবতে পারো, সেটিই হল দেশ। বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা একশো তিরিশ কোটি। এই দেশটি নিজেই যেন একটি পৃথিবী। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা যদি দৃঢ় এক জাতিত্ব বোধের উন্মেষ ঘটাতে না পারি, এ দেশ সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারবে না, বিশ্ব সভায় আমরা কোনও অবদান রাখতে পারবো না, হয়তো আমাদের কোনও তাৎপর্যই থাকবে না একদিন। 

 

এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের একটি দিক হল জাতীয় সঙ্গীত। “আমার কি ঊঠে দাঁড়ানো উচিত”? ঠিক আছে, যদি তোমার দুটি পা-ই না থাকে, তোমাকে আমরা ছাড় দিতে পারি। কিন্তু তোমার পা দুটি না থাকলেও জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার জন্য সামান্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন তোমার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য, কারণ, ওই দুটিই হল এক জাতিত্বের নীরব প্রতীক। ঐ দুটি প্রতীক দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখে। যদি তুমি যথেষ্ট গর্বের অনুভূতি নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে না পারো, এক জাতির প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? 

দেশের প্রতিটি পরিণত বয়সের মানুষের ভাবনা ও আবেগের গভীরে এক জাতিত্বের বোধ তৈরি করা আশু প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এই এক জাতিত্বের বোধটি তৈরি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি আমরা

“সিনেমা হলে কেন আমি উঠে দাঁড়াবো ? আমি তো সেখানে বিনোদনের জন্য যাই”! এসব যারা বলেন, তাদের আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি শেষ কবে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে অংশ নিয়েছেন ? আপনি শেষ কবে স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন করেছেন ? শেষ কবে আপনি জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছেন ? খুব বেশি হলে হয়তো স্কুল জীবনে বাধ্য হয়ে করতেন ওই কাজগুলো। তারপর তো শুধু অগণিত সুযোগ সুবিধা নিয়েই চলেছেন দেশের কাছ থেকে, কিন্তু তবুও আপনি এই দেশটির প্রতি সামান্য অবদান রাখতে বা একে রক্ষা করতে উদগ্রীব নন। 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েক লক্ষ জওয়ান অবিরাম নিজেদের জীবনের ঝুঁকির বিনিময়েও সীমান্ত রক্ষা করে চলেছেন, প্রতিদিনই সেখান থেকে কোনও না কোনও মৃত্যুর খবর আসতেই থাকে। দয়া করে ওই সেনা জওয়ানদের বলে দিন, এদেশের সার্বোভৌমত্ব নিয়ে আপনারা এতটুকুও চিন্তিত নন, তারাও যেন বাড়ি ফিরে গিয়ে পরিবার জীবন কাটাতে শুরু করে, নিজের প্রাণের ঝুঁকির বিনিময়ে আপনাদের জন্য সীমান্ত পাহারার কোনও প্রয়োজন নেই আর। 

আজও যে ৪০ কোটি ভারতবাসী দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায়না, আমরা যদি তাদের কথা প্রকৃতই ভাবতে চাই, এক জাতীর আবেগ দিয়ে আপামর দেশটাকে বেঁধে রাখা অত্যন্ত জরুরী

দেশের প্রতিটি পরিণত বয়সের মানুষের ভাবনা ও আবেগের গভীরে এক জাতিত্বের বোধ তৈরি করা আশু প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এই এক জাতিত্বের বোধটি তৈরি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি আমরা। যত দ্রুত সম্ভব ওই এক জাতিত্বের বোধটি তৈরি করা অতীব জরুরী। কারণ একটি দেশ বা জাতি বেঁচে থাকে সংশ্লিষ্ট মানুষজনের ভাবনা ও আবেগের স্তরে। স্বাধীন ভারতে ওই ঐক্যবদ্ধ জাতির বোধটি তৈরি করা যায়নি বলেই আজও এদেশের মানুষ ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় বা লিঙ্গ ভেদের পরিচয়কেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছেন। 

আমাদের কি জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে দাঁড়ানো উচিত ? একশো ভাগ উচিত। জাতীয় সঙ্গীতের জন্য উঠে দাঁড়ানোর মাধ্যমে দেশকেও কি সম্মান প্রদর্শন করা হয় ? হ্যাঁ! বাহান্ন সেকেন্ডের জন্য। আর বিতর্কের কারণ? আমার মনে হয় সিনেমার দর্শকদের সমস্যা হল, তাদের দুটি হাত কোক ও পপকর্ণ দিয়ে এমন ভাবে ভর্তি থাকে যে, উঠে দাঁড়ালে সেগুলো ছড়িয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এই কারণেই উঠে দাঁড়ানোতে এত আপত্তি তাদের।

আমরা একটিই ভারতীয় জাতি, এই কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ হল, দেশের নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের প্রতি আমরা সকলেই এক সাথে উঠে দাঁড়িয়ে সমান শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করতে প্রস্তুত থাকবো 

এই বিতর্ক এখানেই থামিয়ে দেওয়া উচিত। আজও যে ৪০ কোটি ভারতবাসী দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায়না, আমরা যদি তাদের কথা প্রকৃতই ভাবতে চাই, এক জাতীর আবেগ দিয়ে আপামর দেশটাকে বেঁধে রাখা অত্যন্ত জরুরী। ঐক্যবদ্ধ আবেগ ছাড়া ভারতীয় জাতি বলে কিছুই থাকে না। সকলের সহমতের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া এক মানবিক চুক্তির ভিত্তিতেই জন্ম হয় একটি দেশ বা জাতির। আমরা একটিই ভারতীয় জাতি, এই কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ হল, দেশের নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের প্রতি আমরা সকলেই এক সাথে উঠে দাঁড়িয়ে সমান শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করতে প্রস্তুত থাকবো।  

সম্পাদকের কথা: যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.

Youth and Truth Banner Image