প্রশ্নকর্তা: আসন করার সময়ে কেন আমরা কথা বলতে পারব না, কিংবা কেউ ভুলভাবে আসন করলেও কেন তাকে শুধরে দিতে পারব না ?

সদগুরু: আসন হল ধ্যানেরই এক অত্যন্ত শক্তিশালী পথ। যেহেতু আপনি স্থির হয়ে বসতে পারেন না, সে কারণেই ধ্যানস্থ হওয়ার জন্য আপনাকে এমন একটা কিছু করতে হয়। আপনাকে প্রাচীন যোগসূত্রের কথা মনে করিয়ে দিলে দেখবেন, স্বয়ং পতঞ্জলি বলেছিলেন— স্থিরম্‌ সুখম্‌ আসনম্‌। অর্থাৎ যা কিনা পুরোপুরি স্থির ও স্বস্তিদায়ক, তাই হল আসন। এর অর্থ হল, আপনার শরীর থাকবে স্বচ্ছন্দ, আপনার মন থাকবে শান্ত, এবং আপনার প্রাণশক্তি হবে স্পন্দনময় ও ভারসাম্যে ভরা। তাই ধ্যানের স্বাভাবিক ক্ষমতা অর্জনের জন্যই আসন হল এক প্রস্তুতির স্তর।

এক দিক থেকে দেখলে, আসন হল ধ্যানেরই এক শক্তিশালী পথ। তাই ধ্যান করার সময় আপনি কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন, এটা ভাবা যেমন উদ্ভট, তেমনই অবাস্তব হল আসনে বসে কথা বলাও। শব্দের উচ্চারণ আমাদের শারীরিক প্রক্রিয়ায় নানারকম পরিবর্তন নিয়ে আসে। আপনারা নিজেরাই এটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। প্রথমে শান্তভাবে কিছুক্ষণ আসনে বসে থাকার সময়ে নিজের নাড়ির গতি মেপে দেখুন। এরপর প্রাণ খুলে কথা বলার মাঝেই ফের নিজের নাড়ির গতি মাপুন—আর দেখুন, দুটো মাপ কতখানি আলাদা। তবে নাড়ি তো একটা মাত্র উদাহরণ। কথাবার্তা শুধু শারীরিক মাপকাঠিতেই পরিবর্তন আনে না - এমনকী প্রাণশক্তির মাপকাঠিতেও নিয়ে আসে এক নাটকীয় পরিবর্তন। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, একাগ্রতা না থাকলে আপনি আসনটা করবেন কীভাবে ?

আপনি যদি বাথরুমে ছোটার প্রয়োজন ছাড়াই, কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন ছাড়াই কিংবা কোনও কিছু খাওয়ারও প্রয়োজন ছাড়াই আসনে বসতে পারেন, একমাত্র তবেই তা আপনার যোগের যোগ্যতার একটা জোরালো বিজ্ঞাপন হতে পারে।

আমি একবার আমেরিকার এক যোগ প্রদর্শনকেন্দ্রে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। এই প্রদর্শনকেন্দ্রটি যে ভদ্রমহিলার, তিনি আগে এই ঈশা কেন্দ্রেই ধ্যান করতেন এবং বহু বছর যোগের প্রশিক্ষকও ছিলেন। তা, আমি যখন ওঁর যোগ প্রদর্শনকেন্দ্রে যাই, তখন দেখি কিছু একটা সঙ্গীত বাজছে আর সেই মহিলাটি একদল দর্শকের সঙ্গে মাইক্রোফোনে অনর্গল কথা বলতে বলতেই, আসনে বসে অর্ধমৎস্যেন্দ্রাসন যোগের ভঙ্গি দেখাচ্ছেন। ওই ব্যাপার দেখেই আমি উঠে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওই মহিলা আমাকে দেখে চিনতে পেরেই “আসুন আসুন” বলে লাফিয়ে উঠে আসন ছেড়ে সটান আমার কাছে চলে এলেন। তো আমি তখনই তাঁকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললাম, মোটেও এটা যোগ শেখানোর সঠিক পদ্ধতি নয়, কেননা এভাবে যোগাসন করলে আসনকারীর শারীরিক প্রক্রিয়ায় গুরুতর গণ্ডগোল দেখা দেবেই দেবে। তখন শুনি, ওই ভদ্রমহিলা নিজেই ওই বিপত্তিতে ভুগছেন। এর কিছুকাল পরেই তিনি যোগ শেখানো বন্ধ করে দেন আর তাঁর শারীরিক সমস্যাও ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যায়।

এজন্যই আসন করার সময়ে কোনওরকম কথা বলা উচিত নয়, আর ইচ্ছে হলেই যখন খুশি আসনে বসাও উচিত নয়। আমি এমন মানুষদেরও দেখেছি যাঁরা বাথরুমে যাওয়ার অবসরেই কোনও একটা আসন করতে বসে যান, কেননা তাঁরা দুনিয়াকে দেখাতে চান যে তাঁরা যোগ করছেন। এটা স্রেফ বোকামো। আপনি যদি বাথরুমে ছোটার প্রয়োজন ছাড়াই, কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন ছাড়াই কিংবা কোনও কিছু খাওয়ারও প্রয়োজন ছাড়াই আসনে বসতে পারেন, একমাত্র তবেই তা আপনার যোগের যোগ্যতার একটা জোরালো বিজ্ঞাপন হতে পারে। নইলে আপনি যে যোগ করেন, শুধু এটুকু জানানোর জন্যই আপনার এইসব দেহভঙ্গি করার প্রয়োজন নেই।

নিয়মানুসারে আসন করাকালীন আপনারা কখনোই কথা বলবেন না। কেননা আপনার একাগ্রতা, আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস এবং আপনার প্রাণশক্তির হাল কী দাঁড়াচ্ছে, সেটাই সবথেকে জরুরি। আর সবচেয়ে বড় কথা, আসনগুলো তো আসলে ধ্যানের প্রাথমিক স্তর মাত্র। আপনি নিশ্চয়ই ধ্যানের মধ্যে কথা বলতে পারেন না। কেননা আসনের মাঝপথে কথা বলা মানেই আপনি আপনার শ্বাস প্রশ্বাস, আপনার মানসিক একাগ্রতা এবং আপনার প্রাণশক্তির স্থিরতাকে বিঘ্নিত ও নষ্ট করছেন।

এবার আসনের ভুল শুধরানোর প্রসঙ্গ — এক দিক থেকে দেখলে, কারও ভঙ্গিকে শারীরিকভাবে, অর্থাৎ তাঁকে স্পর্শ করে, সংশোধন করার ব্যাপারটা যেন অনেকটাই ঠেকনা দিয়ে আসন করার মতন। শিক্ষক যদি ভুলত্রুটিগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে দেন, মানুষ তখন সচেতনভাবেই তাঁদের আসনের ভঙ্গিকে সঠিক করে নিতে পারেন। নয়তো পরে তাঁরা ওই একই ভুলগুলো আবারও করতে থাকবেন। এর আরেকটা দিক হল, আসনে বসার পর কেউ যদি একটা নির্দিষ্ট একাগ্রতার স্তরে পৌঁছে যান, তখন তাঁর ভুল সংশোধনের জন্য আপনি তাঁকে স্পর্শ করলে তাঁর ক্ষতিও ঘটিয়ে ফেলতে পারেন।

এর একটা উদাহরণ দিই — আমার একটি মাত্র আঙুল নাড়ানোর মধ্যেই কিন্তু বহু কিছু জড়িয়ে থাকে। যেমন আমার পেশি, বন্ধনী, এই হাড়ের কাঠামো, আমার মন আর প্রাণশক্তি। সব কিছুকেই একটা নির্দিষ্ট পথে নানা কাজ করতে হয়। অন্যদিকে, যদি আপনি আমার এই আঙুলটা ধরে নাড়িয়ে দেন, তাহলে শরীরের ভেতরকার পদ্ধতিগুলো সম্পূর্ণ অন্যভাবে কার্যরত হবে। তখন একটা পুরোপুরি আলাদা ব্যাপার হয়ে যাবে। এজন্যই যতক্ষণ না ঠিকমতো বুঝতে পারছেন, শিক্ষকের উচিত আপনাকে বারবার বুঝিয়ে দেওয়া, কীভাবে করতে হবে। আর এরপরও যদি সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তখন আপনাকেই তা করতে হবে, আর করতে হবে নিজের অন্তর থেকেই।