প্র: নিজের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া নিয়ে আমি খুব সংশয়ের মধ্যে আছি। এই সংশয়গুলোকে কীভাবে সামলাবো, বা কেমন করে সেখানে পৌছবো যেখানে আর কোনো সংশয় থাকবে না ?

সদগুরু: আধ্যাত্মিকতার পথে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি কখনো কোনো একটা বিশেষ 'জায়গায়' পৌঁছনোর চেষ্টা করবেন না, কারণ যে মুহুর্তে আপনি বিশেষ কিছু একটা পেতে চাইবেন, আপনার মন একটা জায়গাকে কল্পনা করতে শুরু করে দেবে। তখন আপনি আপনার নিজের ব্যক্তিগত একটি স্বর্গ বানিয়ে তুলবেন।  

আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া এক পর্যায়ের ভ্রান্ত বিশ্বাস ত্যাগ করে আর এক পর্যায়ের ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরা নয়। আপনার ভ্রান্ত বিশ্বাস বা সেই দৃষ্টিভ্রমকে একেবারে ত্যাগ করে বাস্তবকে মেনে নিয়ে সেভাবে বাঁচতে পারাটাই আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া, কারণ সত্যের জন্যই তো এত সব প্রচেষ্টা।

 

সত্য হল অস্তিত্বের প্রকৃত স্বরুপ, আপনি মনে মনে কি ভেবে নিচ্ছেন তা নয়। আমি নিজের মনে দেবতাকে দেখতে পারি বা হয়তো অসুরকে দেখতে পারি - দুটোর কোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি কি দেখছেন সেটা নির্ভর করে আপনার সংস্কার আর আপনি কী অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয়েছেন তার উপর; আপনি আশাবাদী না নিরাশাবাদী তার উপর। যখন আপনি মানুষের দিকে চেয়ে দেখেন তখন আপনি তাদের মধ্যে ভগবানকে দেখেন না শয়তানকে, তার সাথে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। বাস্তবটা হল এরকম - এই মুহুর্তে আপনি এখানে রয়েছেন কিন্তু আপনি জানেন না কিসের জন্য আপনি এখানে আছেন, কোথা থেকে এসেছেন আর কোথায়ই বা যাবেন। সেটাই জীবনের বাস্তবতা।  

আশাহীন হয়ে ওঠা

বিশেষ কিছু ধর্ম সবসময়ই আশার কথা প্রচার করেছে। আশা হল একজন মানুষের জন্য সবথেকে খারাপ যা হতে পারে তাই, কারণ আশা মানে আপনি কিছু কল্পনা করে নিয়েছেন ভবিষ্যতের ব্যাপারে। "আমি এখন খারাপ আছি, কিন্তু কোনো ব্যাপার না, গরীব হলেও আমি একজন ভালো মানুষ । তাই আমি যখন স্বর্গে যাব, আমি ভগবানের কোলে বসবো।" এটাই আশা।

যে মুহুর্তে কেউ আপনাকে আশা দেয়, আপনি কিছু না কিছু কল্পনা করতে শুরু করেন। আশা হল মিথ্যেকে সৃষ্টি করার উপায়। আপনি যদি সানন্দে আশাহীন হতে পারেন, তা হলেই তো হয়ে গেল। আপনি এমন এক জায়গায় চলে আসেন যেখানে আপনার কোনো রকম আশার প্রয়োজন হয় না। যাই আসুক বা যেভাবেই আসুক না কেন, আপনি ঠিক থাকবেন কারণ আপনি নিজের অন্তরে কিছু খুঁজে পেয়েছেন।  

আপনাকে শুধু এমন ভাবে নিজেকে ধরে রাখতে হবে যে আপনি মনে মনে কিছু কল্পনা করে নেবেন না, ইতিবাচক বা নেতিবাচকের মধ্যে কোনোটাই নয় । আপনি কোনো দেবতা বা শয়তান, স্বর্গ বা নরক, ভালো বা মন্দ সৃষ্টি করবেন না।

বাস্তবকে মেনে নিয়ে বাঁচতে শেখাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। আপনি যদি নিজের মনের মধ্যে জিনিসগুলোকে বিকৃত করা বন্ধ করে দেন আর যেটা যেমন সেটাকে ঠিক তেমন করেই দেখেন, তবে মুক্তি শুধু এক ধাপ দূরে। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। সময়ই করবে। সময় আপনাকে পরিণত করে তুলবে এক অন্য মাত্রায়।  

আপনাকে শুধু নিজেকে এমন ভাবে ধরে রাখতে হবে যে আপনি মনে মনে কিছু কল্পনা করে নেবেন না, ইতিবাচক বা নেতিবাচকের মধ্যে কোনোটাই নয় । একই সঙ্গে আপনি নিজের মনে ভগবান বা শয়তান সৃষ্টি করবেন না, স্বর্গ বা নরকও তৈরি করবেন না, কোনো কিছুকে ভাল বা মন্দও করে তুলবেন না। "আমি এই মানুষটিকে পছন্দ করি, ওকে করি না" - এরকম কিছু আর থাকবে না । সমস্ত কিছুকেই - সেটা যেমন, তেমন ভাবেই দেখতে শিখবেন। নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, কাজকর্মের জন্য হয়তো আমাদের এইসব পার্থক্যের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু অন্য সময়ে, যেটা যেরকম সেরকম ভাবেই তা গ্রহণ করে নিতে পারেন।  

পরের স্টপ: বাস্তবতা!

আপনি যদি সমস্ত কিছুকেই, সেগুলো যেমন রয়েছে ঠিক তেমনই দেখেন তা হলেই দেখবেন জীবন শুধু ‘এই রকম’ বা ‘ঐ রকম’ নয়। গোটা বিশ্ব জুড়ে জীবন বিস্ফোরিত হয়ে চলেছে। “এটা জীবন, ওটা জীবন নয়, এটা প্রাণ, ওটা প্রাণহীন, ইনি পুরুষ, উনি নারী” - যদি আপনি এভাবে সব কিছুকে আলাদা করা বন্ধ করে দেন তা হলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে সত্যিই জীবন্ত সেটা আপনি উপলব্ধি করে নেবেন। শুধুমাত্র যেভাবে যা আছে সেভাবেই সবকিছুর দিকে তাকিয়ে দেখুন।  

আপনি যদি সমস্ত কিছুকেই, সেগুলো যেমন রয়েছে ঠিক তেমনই দেখেন তা হলেই দেখবেন জীবন শুধু ‘এই রকম’ বা ‘ঐ রকম’ নয়। গোটা বিশ্ব জুড়ে জীবন বিস্ফোরিত হয়ে চলেছে।... শুধুমাত্র যেভাবে যা আছে সেভাবেই সবকিছুর দিকে তাকিয়ে দেখুন।  

একবার যদি আপনি সেই মহাজাগতিক জীবনের সাথে একাত্ম হয়ে যান, জীবন তখন সম্পূর্ণ আলাদা একটি রুপে ঘটে। তখন সেটা কি সুন্দর বা কুৎসিতের গণ্ডিতে ধরা যায়? না। তখন সেটা জীবনের মতো হয়ে ওঠে, ঠিক যেমন হওয়া উচিত! ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত তেমন, এইরকম বা ঐরকম নয়। সবকিছুই যেমন হওয়া উচিত ঠিক তেমন। শুধু আমাদের মনই সবকিছুকে বিকৃত করতে থাকে। যদি এই বিকৃত করা বন্ধ করে সবকিছুর বাস্তব স্বরুপ দেখতে পান, দেখবেন জীবনের বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে। এখানে এক কোটি বছর বেঁচে থাকলেও, জীবনের এই উচ্ছ্বাসকে উপলব্ধি করতে আপনি প্রবল ভাবে ব্যাস্ত থাকতে পারেন।  

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীরাও এখন বলছেন যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সতত প্রসারিত হয়ে চলেছে। মূলত, তারা বলছেন যে কোনো ব্যাপারই কিন্তু চূড়ান্ত নয়। যারা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন তাদের পক্ষে এরকম একটা কথা বলা কিন্তু খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। কিন্তু এখন তারা উপলব্ধি করছেন যে গোটা বিষয়টাকে তারা যেভাবে দেখেছেন তাতে কিছু একটা ভুল আছে। সুতরাং, “এটাই শেষ কথা” বলে কিছু হয় না। আত্মভূত করার এ এক অনন্ত প্রক্রিয়া। ধরে নিন যদি “এটাই শেষ কথা” বলে কিছু থাকতো। তা হলে তারপরে আপনি কি করতেন? আপনার বোঝা উচিত যে আপনি যদি “বাস্তবতা” নামের একটা স্টেশনে এসে পৌঁছন, সেখানে “এটাই শেষ কথা” বলে কিছু হয় না। আপনি শুধু আপনার মনে নিষ্পত্তি করে নেন, অস্তিত্বে কখনো নিষ্পত্তি হয় না। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মনের প্রকৃতি। আমাদের মন একটা অধ্যায় শেষ করে বলতে চায়, “বুঝতে পেরেছি !”। কিন্তু জীবন হল এক অসীম সম্ভাবনা। আর সেটাই জীবনের সৌন্দর্য।