সদগুরু এখানে বিষুব দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছেন : এ হল এমন একটি দিন, যেদিন স্বয়ং শিবই অর্ধনারী রূপ ধারণ করেছিলেন – অর্ধেক পুরুষ আর অর্ধেক নারী

সদগুরু: সদগুরু আকাশপথের বিষুবরেখা হল আসলে এক কাল্পনিক রেখা, যা পৃথিবীর বিষুববৃত্তের উপর দিয়ে প্রবাহিত এবং যা কিনা এই গ্রহকে উত্তর গোলার্ধ ও দক্ষিণ গোলার্ধে ভাগ করেছে। এই রেখাটি থেকেই উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দুটি বদলে যায় আলাদা আলাদা পথে।

মানবজীবনে বিষুব দিবসের তাৎপর্য এই যে,পুরুষ-প্রকৃতি ও স্ত্রী-প্রকৃতি সেদিন একইসঙ্গে অবিচল থাকে এবং তা আমাদের নিজস্ব শারীর-প্রক্রিয়ার মধ্যেই–যাতে দুটি প্রভাবেরই এক সমতুল্য ক্ষেত্র চালু হয়

বিষুবের দিনগুলোয় – একবার মার্চে এবং আরেকবার সেপ্টেম্বরে – আকাশের বিষুবরেখা সূর্যের সঙ্গে একেবারে নিখুঁতভাবে সমান সারিতে থাকে। এর অর্থ হল, পৃথিবীর উপর ক্রিয়াশীল সমস্ত প্রভাবেরই তখন সঠিক ভারসাম্য বজায় থাকে। মানবজীবনে এই দিনটির তাৎপর্য এই যে, তার পুরুষ-প্রকৃতি ও স্ত্রী-প্রকৃতি সেদিন একইসঙ্গে অবিচল থাকে এবং তা তার শারীর-প্রক্রিয়ার মধ্যেই – যাতে কিনা দুটি প্রভাবেরই এক সমতুল্য ক্ষেত্র চালু হয়।

পুরুষ-প্রকৃতি ও স্ত্রী-প্রকৃতির অর্থ ঠিক শারীরিকভাবে পুরুষ বা নারী হওয়া নয়। আসলে প্রকৃতিতে কিছু কিছু গুণ আছে, যেগুলোকে পুরুষ-প্রকৃতি হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তেমনই অন্যান্য কিছু গুণকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে স্ত্রী-প্রকৃতি হিসেবে। শারীরিকভাবে আপনি হয়তো একজন পুরুষ, কিন্তু হতেই পারে যে, স্ত্রী-প্রকৃতিই আপনার মধ্যে বেশি প্রভাবশালী। একইভাবে আপনি একজন নারী হলেও হয়তো পুরুষ-প্রকৃতিই আপনার মধ্যে বেশি ক্ষমতাবান। একমাত্র এই দুটি গুণই যখন কোনও মানুষের জীবনে নিখুঁত ভারসাম্যের অবস্থায় থাকে, শুধু তখনই সে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে পেতে পারে।

বিষুব দিবস ধরা হয় সেই দিনটিকেই, শিব যেদিন অর্ধনারী রূপ ধারণ করেছিলেন—অর্থাৎ অর্ধেক স্ত্রী আর অর্ধেক পুরুষ, কেননা সেই দুটি প্রকৃতিই তো আজও রয়ে গেছে। যৌগিক পরম্পরায় এ হল এমনই একটি দিন, যখন মানুষ তার শারীরিক আকাঙ্ক্ষার সীমাকে শ্রেষ্ঠত্বের গুণে ছাপিয়ে যেতে পারে। মানবশরীরের মধ্যেই কামনা-বাসনার তীব্র আকর্ষণকে অতিক্রম করার এ এক শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনা।

এক সমতুল্য প্রভাবের ক্ষেত্র

সামাজিকভাবেই হোক, অর্থনৈতিকভাবে হোক কিংবা অন্য কোনওভাবে—মানুষকে আমরা যা দিতে পারি, তা হল সমান সুযোগের এক ক্ষেত্র। সবাইকেই একই মাপের করা যায় না, কিন্তু সবাইকে সমান সুযোগ তো দেওয়া যায়। সমান সুযোগ বলতেই এক কথায় এক সমতুল্য প্রভাবের ক্ষেত্র। এই হল সেই দিনটি, যেদিন আমাদের মধ্যে থাকা দুটি মূল শক্তি ইড়া ও পিঙ্গলা—একটি পুরুষ ও অন্যটি প্রকৃতি—আসলে শিব এবং শক্তি অবিচল থাকে। অর্থাৎ কেউ কারও উপরে প্রভাব খাটায় না।

বিষুব দিবসকে এমন একটি দিন বলে ধরা হয়, যে দিন মানুষ তার কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারে। অন্যান্য সব কুসংস্কারই হল এই মূল কুসংস্কারের ফসল, প্রকৃতিগতভাবে যা কিনা একান্তই শারীরবৃত্তীয়।

অবধারিত ভাবেই ভ্রান্ত সংস্কারের সৃষ্টি হয় আমাদের মনের ভিতরে, কেননা কোনও একটি প্রভাবের কারণে আমরা অতিমাত্রায় চিহ্নিত হয়ে পড়ি। প্রকৃতিগতভাবে আপনি যদি বেশি মাত্রায় পুরুষালি চিহ্নিত হন, তবে আপনার মধ্যে পুরুষসুলভ কুসংস্কার থাকবেই। আবার প্রকৃতিগতভাবে আপনি যদি বেশি মাত্রায় মেয়েলি চিহ্নিত হন, আপনার মধ্যে থাকবে নারীসুলভ কুসংস্কার। এখন বিষুব দিবসকে এমন একটি দিন বলে ধরা হয়, যে দিনটিতে কেউ তার কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারে। অন্যান্য সব কুসংস্কারই হল এই মূল কুসংস্কারের ফসল, প্রকৃতিগতভাবে যা কিনা একান্তই শারীরবৃত্তীয়। আমাদের শরীর এমনভাবেই তৈরি হয়েছে, যাতে একটি প্রকৃতির প্রভাব বেশি থাকে আর অন্যটির থাকে কম। আর এই কুসংস্কার থেকেই অন্যান্য সব কুসংস্কারের সৃষ্টি হয়।

যোগশাস্ত্রে বছরের বিভিন্ন সময়ের জন্য বহু ধরনের সাধনা নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ যখন তাঁদের প্রাথমিক সাধনার ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়েন, তখন সাধনার অতিরিক্ত বোঝা চাপানো তো অর্থহীন। যখন প্রাথমিক সাধনা আপনার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই সহজ ও স্বাভাবিক হবে, যেন কোনও প্রচেষ্টাহীন জীবনেরই অঙ্গস্বরূপ—একমাত্র তখনই তাতে সাধনার অন্যান্য মাত্রা যোগ করা যায়।

জীবনের সঙ্গে সমানভাবে সারিবদ্ধ

জীবনের জটিলতাকে যদি গভীরভাবে এবং সব দিক থেকেই জানতে চান—ওই কোনওভাবে বেঁচে রইলাম আর মরে গেলাম, সেভাবে নয়—যদি আপনারা একে পুরোপুরি জানতে চান, তবে সবদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন, তবুও তো বলতে পারেন বছরের কোন দিন সেটি—তেমনই পারবেন গোটা এক বছর আপনাকে কোনও অন্ধকার ঘরে সাধনায় বসিয়ে রাখলেও। না, সেই রবিনসন ক্রুসোর মতো মেঝেতে দাগ কেটে কেটে নয়। ওটা হল কোনও বন্দি বা কোনও ফাঁদে পড়া মানুষের কাজ। কিন্তু আপনি যদি যা কিছু ঘটছে তাকে অনুভব করার মতোই সচেতন থাকেন—তখনই আপনি প্রতিটি বছর, মাস, দিন বার বা সময়কে নির্ভুল জানতে পারবেন। যার অর্থ হল, আপনার জীবন তখন জীবনের আরও বড় দিকগুলোর সঙ্গে একই তারে বাঁধা হয়ে গেছে।

প্রতিটি মাত্রা, প্রতিটি গ্রহের অবস্থানের জন্যই একেকটি নির্দিষ্ট সাধনা রয়েছে, যাতে আপনি তাদের সঙ্গে একই সারিতে আসতে পারেন এবং তাদের মতোই একই রকম উজ্জ্বলতা ছড়াতে পারেন—আপনার মনের কলুষস্পর্শ ছাড়াই।

আধুনিক পদার্থবিদ্যা স্পষ্টভাবেই জানাচ্ছে, আমাদের শরীরের ভিতরে যা কিছুই স্পন্দিত হচ্ছে, এক-না-একভাবে তা মহাজাগতিক স্পন্দনেরই প্রতিফলন। এ নিয়ে কোনও রকম সংশয় নেই, কেননা বিজ্ঞানীদের হাতে প্রচুর প্রমাণ উঠে এসেছে। আর এই যদি অত সবের এক ক্ষুদ্র প্রতিফলন হয়, তবে শুধু দিন-তারিখ কেন, সেই প্রতিফলনে সবকিছুই দেখা যাবে। আপনি যদি পাহাড়ের সামনে কোনও আয়না ধরেন, তবে সেই আয়নায় পাহাড়ই দেখা যায়। শুধু ওই আয়নাটাকে পরিষ্কার হতে হবে, অসমান বা ময়লা লাগা নয়। যদি একটা স্বচ্ছ স্বাভাবিক আয়না হয়, তবে তাতে পাহাড়, আকাশ সবই দেখতে পাবেন। আপনার ওই ছোট ছোট দুটি চোখ দিয়েই গোটা জগৎটাকে দেখতে পাবেন। বিশাল কোনও চোখ লাগবে না এই দুনিয়া দেখতে। তেমনই নিজের ভিতরে এক মহাজাগতিক উজ্জ্বলতা ছড়াতেও আপনার কোনও মহাজীবন হয়ে ওঠার দরকার পড়বে না। এ শুধু একই সারিতে আসার ব্যাপার।

এই সব বিষয় একমাত্র তাঁদের কাছেই প্রাসঙ্গিক, জীবনকে যাঁরা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে চান। জীবন যদি আপনার কাছে এমনটাই হয় যে, তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সম্ভাবনাগুলোকেও আপনি জানতে চান—তবে যোগের পদ্ধতিতে বছরের প্রতিটি দিনের জন্যই আলাদা আলাদা একেকটি সাধনা রয়েছে। প্রতিটি মাত্রা, প্রতিটি গ্রহের অবস্থানের জন্যই একেকটি নির্দিষ্ট সাধনা রয়েছে, যাতে আপনি তাদের সঙ্গে একই সারিতে আসতে পারেন এবং তাদের মতোই একই রকম উজ্জ্বলতা ছড়াতে পারেন—আপনার মনের কোনও কলুষস্পর্শ ছাড়াই।

ভাবনাচিন্তার ভ্রান্ত সংস্কার

জীবনের ক্ষেত্রে ভাবনাচিন্তার কোনও কাজ থাকা উচিত নয়। ওটা তো আপনার মধ্যে ঢুকিয়েও দেওয়া যায়। আপনাকে হয়তো যাহোক কিছু কিছু বলা হল আর সেটাই আপনার মনের মধ্যে অনন্তকাল ধরে চলতে লাগল। আপনার অস্তিত্বের বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই।

আপনার মধ্যে চিন্তা জন্মাতে পারে গল্পগুজব থেকে, যা কিনা চিন্তার অন্যতম ক্ষতিকর ধরন। অথবা আপনার মধ্যে এটা আসতে পারে কোনও ভাবময় কল্পনা থেকে, যা আর একটু বেশি শক্তিশালী। অথবা আসতে পারে কোনও দর্শন হিসাবে, যা আরও বেশি শক্তিশালী। আপনার কাছে এটা ধর্ম হিসেবে আসতে পারে, কিংবা সবচেয়ে বাজে ব্যাপার যেটা—ঈশ্বরের বাণী হিসেবেও আসতে পারে। আর ঠিক এই সময়েই আপনি পুরোপুরি বিকৃত, কেননা এখন আপনি সবচেয়ে মূর্খ চিন্তাটিকেও ফেরাতে পারছেন না। আপনার পার্থক্য বিচারের প্রক্রিয়াটাই এমন নষ্ট হয়ে গেছে যে, এটা যে বোকামো, তাও বুঝতে পারছেন না। আর একবার আপনি চিন্তার চাপে বিকৃত হয়ে গেলে তো আপনার জীবনের কোনও বোধই থাকবে না। তখন একমাত্র নিজের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াটুকুই আপনার কাছে বিশ্বের যাবতীয় মহাজাগতিক মাত্রার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি হয়ে উঠবে।

বিষুব দিবস হল নিজেকে ভ্রান্ত সংস্কারমুক্ত করার সেই দিন। কুসংস্কার সৃষ্টির মূল ভিত্তিই হল, আপনার শরীর ও চিন্তার ধরনটির মাধ্যমে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া। শরীরের মাধ্যমে চিহ্নিত হওয়া থেকে শুরু করে ভাবনাচিন্তার মাধ্যমে চিহ্নিত হওয়ার এই ব্যাপারটা হল ধাপে ধাপে ভ্রান্ত সংস্কারের দিকে এগোনোরই পথ। আর যখনই আপনি ভাবনাচিন্তার মাধ্যমে একবার চিহ্নিত হয়ে গেলেন, আপনার সব আশাই ফুরোল। কেননা আপনি তখন সৃষ্টি ও বাস্তব—দুটির পথ থেকেই খসে পড়েছেন আপনার নিজেরই অবাস্তব বিভ্রমের জগতে। আর একবার সেই অর্থহীন জগতের ফাঁদে পড়লে, তখন উন্মাদের মতোই যেখানে খুশি আপনি ভেসে যেতে পারেন।

বিষুব দিবস হল ভারসাম্য আনার একটি দিন, যাতে এটা-ওটা কিছুর মাধ্যমে চিহ্নিত হতে না হয়। পুরুষ কিংবা স্ত্রী হিসেবে নয়, এমনকী মানুষ বা অন্য কোনও জীব হিসেবেও নয়—শুধু বসে জীবনের স্পন্দনটুকু অনুভব করা।