বীরেন্দ্র সহবাগ: নমস্কার সদগুরু! আমি ভারতের বর্ণপ্রথার অন্তরালের সত্যটা জানতে চাই। কীভাবে আমরা আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিকরণ ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করতে পারি ?

সদগুরু: নমস্কার বীরু। আমাদের বুঝতে হবে যে, বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথা প্রধানত শুরু হয়েছিল শ্রম বিভাজনের উদ্দেশ্যে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হল, কালক্রমে এই বিভাজন বৈষম্যমূলক হয়ে ওঠে এবং মানুষের মধ্যে তীব্র ভেদভাবের জন্ম হয়। 

সমাজকে সক্রিয় রাখতে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ অবশ্যই হবেন দক্ষ কারিগর, কেউ বা হবেন ব্যবসায়ী, কিছু মানুষ সামলাবেন প্রশাসন, কেউ বা তদারক হবেন শিক্ষাব্যবস্থার এবং কেউ কেউ দায়িত্ব নেবেন আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার। এভাবেই জন্ম হয়েছিল চারটি মৌলিক বিভাগের। 

আমাদের অবশ্যই বোঝা উচিত যে, সেই প্রাচীন সামাজিক পরিসরে কোনও কারিগরী বা চিকিৎসা বিদ্যার প্রতিষ্ঠান ছিল না…পেশাগত দক্ষতা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়ে চলতো বর্ণপ্রথার মাধ্যমে

আমাদের অবশ্যই বোঝা উচিত যে, সেই প্রাচীন সামাজিক পরিসরে কোনও কারিগরী বা চিকিৎসা বিদ্যার প্রতিষ্ঠান ছিল না। যদি তোমার বাবা ছুতোর মিস্ত্রী হ’তেন, তাহলে তুমি শৈশব থেকেই সূত্রধরের কাজই শিখতে এবং একজন দক্ষ সূত্রধর তৈরি হতে। পেশাগত দক্ষতা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়ে চলতো বর্ণপ্রথার মাধ্যমে। 

এভাবে চলতে চলতেই জাতিভেদের বিকৃত রূপটি সামনে আসতে শুরু করল, স্বর্ণকার ভাবতে শুরু করল সে কর্মকারের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। যদিও কর্মকারের কাজ স্বর্ণকারের তুলনায় সমাজের জন্য বেশী উপযোগী, কিন্তু তবুও এই শ্রেষ্ঠত্বের ভাবনাই একের পর এক প্রজন্ম ধরে চলতে চলতে ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। এই শ্রেষ্ঠত্বকে নিশ্চিত করতে গিয়েই শুরু হল অন্যের প্রতি শোষণ ও দমন মূলক আচরণের এবং এই সামাজিক ব্যাধিটি ধীরে ধীরে চূড়ান্ত বর্ণবিদ্বেষে পরিণত হল।

বংশ পরম্পরায় কর্ম দক্ষতা সঞ্চারণের পদ্ধতিটি আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই জাতিভেদ বা বর্ণপ্রথা আজ আর একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়

এই জাতিভেদের নামে কয়েকশো বছর ধরেই বহু মানুষের জীবনে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলেছে। আজও ভারতের অনেক গ্রামে যারা নীচু জাতের মানুষ বা যারা দলিত বলে পরিচিত – মানুষের মৌলিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। যদিও বিগত ২৫-৩০ বছরে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তবুও অসংখ্য নারকীয় ঘটনা আজও ঘটে চলেছে এদেশে। 

 

এর থেকে পরিত্রাণের পথ কী ? একটা ব্যপার হলো, আজকাল পেশাগত নৈপুণ্য সম্প্রসারিত করার বহুবিধ পদ্ধতি উন্মুক্ত হয়ে গেছে। প্রথাগত শিক্ষা এবং তার পাশাপাশি কারিগরী ও প্রযুক্তিবিদ্যা প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান আজ সহজলভ্য। বংশ পরম্পরায় কর্ম দক্ষতা সঞ্চারণের পদ্ধতিটি আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই জাতিভেদ বা বর্ণপ্রথা আজ আর একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়।

কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে বর্ণপ্রথার গুরুত্ব একই রয়ে গেছে। নিজেদের জাতি ও সম্প্রয়দায়কে রক্ষা করতে মানুষ সর্বদাই সচেষ্ট হয়। স্বজাতি বা একই সম্প্রদায়ের কেউ কষ্টে থাকলে সকলেই চায় তার পাশে দাঁড়াতে। যতদিন না দেশব্যাপী প্রতিটি নাগরিকের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে, ততদিন পর্যন্ত এই জাতিভেদ প্রথার ক্ষীণ উপস্থিতি রয়েই যাবে। 

এই মুহূর্তে জরুরী হল, প্রতিটি মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে

Jবর্ণপ্রথাকে সরাসরি কুঠারাঘাত করতে চাইলে বা শুধুমাত্র এই প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আজও মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে এই জাতিভেদকে রক্ষা করতে চায় মূলত সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে। এই মুহূর্তে জরুরী হল, প্রতিটি মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে। এরকম কিছু ঘটলে জাতিভেদ বা বর্ণপ্রথা তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলবে এবং আমার মনে হয় একমাত্র তখনই এই প্রাচীন প্রথাটির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে।

সম্পাদকের কথা: যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.

Youth and Truth Banner Image