টাইম্‌স্‌ নাও টি ভি চ্যানেল সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন যোগী ও অতিন্দ্রীয়বাদী সদগুরুর, অভিনেত্রী নন্দিতা দাস ও বিজঙ্গাপন-পরিচালক প্রহ্লাদ কক্করের সাথে। বিষয় হল “আধ্যাত্মিকতা কী?”"

সদগুরু: আধ্যাত্মিকতা মানে বিশেষ কোন অনুশীলন নয়। এটা জীবন যাপনের এক ধরন। সেখানে পৌঁছতে গেলে, অনেক কিছু করার আছে। এটা আপনার বাড়ির বাগানের মতন। যদি মাটি, সূর্যের আলো বা গাছ যেমন তেমন ভাবে থাকে তাহলে ফুল ফুটবে না, আপনাকে সেগুলো নির্দিষ্ট ভাবে রাখতে হবে। যত্ন নিতে হবে। সেরকম ভাবেই আপনি যদি আপনার শরীর, মন, আবেগ, শক্তি এগুলোকে বিশেষভাবে পরিচর্যা করেন তাহলে আপনার মধ্যে আলাদা কিছু একটা প্রস্ফুটিত হবে – সেটাই আধ্যাত্মিকতা। যতক্ষণ আপনার বিচারবুদ্ধি অপক্ক রয়েছে সেটা সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখে। কিন্তু যখনি সেটি পরিণত হয়, তখন সেটি সবকিছুকে এক আলাদা মাত্রায় অনুভব করতে শুরু করে।

যখনই কোন মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতার বৃত্তর বাইরে বৃহত্তর কিছু অনুভব করেন, সেটাকেই আমরা চিরাচরিত ভাবে ভগবান বলে এসেছি। ভগবানের গোটা ধারণাটাই হল – আপনার চেয়ে বৃহত্তর কিছু। সেটা কোনও মানুষ হতে পারে, অনুভূতি হতে পারে, প্রকৃতির কোনও দিক হতে পারে। কিন্তু এটাকে কি আধ্যাত্মিক বলা যায়? না, এটা স্রেফ জীবন। যখন আমি বলছি ‘স্রেফ জীবন’ আমি কিন্তু ব্যাপারটাকে একেবারেই ছোট করছি না। জীবনই শ্রেষ্ঠতম। কিন্তু একমাত্র যখন আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা বিহ্বলকারী, প্রগাঢ় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে, তখনই আপনি এই প্রশ্ন করেন যে এটার সৃষ্টিকর্তা কে।

আপনি যদি জীবনের উৎস বা প্রক্রিয়াকে জানতে চান, তাহলে এটা মানবেন তো যে আপনার নিকটতম সৃষ্টির নজির আপনার নিজের শরীর? এই শরীরে স্রষ্টা বন্দী হয়ে রয়েছে। এটা যেন আপনার নজর এড়িয়ে না যায়। যদি আপনি নিজের মধ্যে সৃষ্টির উৎসর সন্ধান খুঁজে পান, তার মানেই আপনি আধ্যাত্মিক।

ভগবানে বিশ্বাস করা মানেই কি আধ্যাত্মিক হওয়া?

একজন অনীশ্বরবাদী আধ্যাত্মিক হতে পারেন না। একজন ঈশ্বরবাদীও আধ্যাত্মিক হতে পারেন না। এর কারণ হল এই দুজনের মধ্যে তফাৎ নেই। একজন বিশ্বাস করেন ভগবান আছেন, অন্যজন বিশ্বাস করেন ভগবান নেই। সত্য আপনার জানা নেই, এটা স্বীকার করার মতন সততা যদি আপনার না থাকে তাহলে সেটা আপনার সমস্যা। তাই, আদতে এই দুই ধরণের মানুষই এক, কেবল বিশ্বাসের বস্তুগুলো আলাদা। একজন আধ্যাত্মিক মানুষ হল সেই ব্যক্তি যিনি বুঝেছেন যে তিনি সত্য কি তা জানেন না, এবং তাই তিনি অনুসন্ধান করছেন।

কোনও কিছু বিশ্বাস করে নেওয়া মানে আপনি বাকি সবকিছুর থেকে চোখ বন্ধ করে নিলেন। এই গোটা বিশ্বের সমস্যা ভালো-মন্দ নিয়ে নয়, যেটা নাকি প্রচার করা হচ্ছে। সমস্যাটা বিভিন্ন মানুষের বিশ্বাসের মধ্যে সংঘর্ষ। কোন একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতাটা যত না আধ্যাত্মিক তার চেয়ে অনেক বেশী মনস্তাত্বিক। কোন কিছুকে আঁকড়ে ধরে থাকলে নিরাপদ মনে হয়, মনে হয় আপনি অনেক কিছু জানেন। এটা অত্যন্ত অপরিণত মনের ফল। আপনি যদি সৃষ্টির সম্বন্ধে কিছুই না জানেন তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আদতে আপনি কোনও কিছুই জানেন না। এবং সেটা একটা সুন্দর ব্যাপার! আপনি এটা দেখুন নিজের অন্তরে নিজেকে কিভাবে আনন্দময় করে তুলবেন, যেটা কিনা আপনার হাতে রয়েছে।.

আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা কি?

পাহাড় বা সমুদ্রের অভিজ্ঞতা সুন্দর মনে হতে পারে, বিশ্বের নানা জিনিসের আনন্দ অবশ্যই উপভোগ করা উচিত, কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে মাছের কাছে সমুদ্রে বসবাস করাটা, কিম্বা একটা ছাগলের কাছে পাহাড়ে বিচরণ করাটা কিন্তু আধ্যত্মিক অভিজ্ঞতা নয়। তাদের শহরে নিয়ে এলে শহরের অভিজ্ঞতাটা তাদের কাছে আধ্যাত্মিক মনে হতেই পারে। উদ্দেশ্যটা হল আপনার পরিধিগুলোকে ভাঙ্গা। আপনি একটা খোলসের মধ্যে রয়েছেন। এটা ভেঙে বেরিয়ে আর একটা বড় খোলসে ঢুকে পড়লেন। আমি যেটা বলছি তা হল, কিছুদিন পর এই বড় খোলসের অভিজ্ঞতাটাও আগের ছোট খোলসটার মতনই লাগবে।

তো, আপনার উদ্দেশ্য যদি অনন্তকে ছোঁওয়া হয়, এবং সেটা যদি আপনি শারীরিক উপায়ে পেতে চান তাহলে আপনি কিস্তিতে পৌঁছতে চাইছেন অসীমের কাছে। আপনি ১,২,৩,৪... করে অনন্ত অবধি গুনতে পারবেন? না, এরম করে কেবল অনন্তকাল ধরে গোনা চলবে। শরীরী উপায়ে কখনও অসীমে পৌঁছনো যায় না। প্রত্যেকটা মানুষই অসীম হতে চাইছে। সে যেটা চাইছে সেটা তাকে দেওয়া হলে দুই-তিন দিন ঠিক থাকবে। কিন্তু চতুর্থ দিনেই আবার অন্য কিছু একটা চাইবে। এটাকে অনেকেই লোভ বলবে, কিন্তু আমি বলছি এটা ভুল দিশায় চলা জীবন প্রক্রিয়া। আপনি যদি অনন্ত প্রকৃতিকে জানতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই শরীরীর চেয়ে বৃহত্তর কিছু উপলব্ধি করতে হবে। এই জিনিসটার স্বাদ হয়তো আপনি অনেকভাবেই পেয়েছেন – যখন সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, বা পাহাড় দেখেছিলেন, বা নৃত্যে মেতে উঠেছিলেন, বা যখন চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন, এরম অনেক কিছুতেই। জিনিসটা আপনি ছুঁয়েছেন, কিন্তু এবার প্রশ্ন হল সেটাকে ধরে রাখার।

একটি সহজ প্রক্রিয়া

একটা সহজ প্রক্রিয়া করা যায়, যেটা ব্যাক্তিবিশেষ। এরম কোনও ব্যাক্তিবিশেষ প্রক্রিয়া কখনও দায়বদ্ধহীন পরিবেশে শেখানো যায়না। তো, আপনি যদি নিজেকে প্রত্যেক দিন একটু জায়গা দিতে পারেন যেখানে আপনি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করবেন এবং সমর্পিত থাকবেন, তাহলে আপনাকে একটা সহজ প্রক্রিয়া শেখানো যেতে পারে। ২১ মিনিট বিনিয়োগ করে আপনার দিনটি একটি বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া দিয়ে শুরু করতে পারবেন, এক অত্যন্ত শক্তিশালী প্রক্রিয়া যা আপনাকে সমস্ত দিন শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময় রাখবে।

এছাড়া, এটাকে ধরে রাখতে, একটা সহজ অভ্যাস যেটা প্রত্যেকেই করতে পারে তা হল বাছবিচারহীনভাবে সব কিছুর সাথে নিবিষ্ট হওয়া। একটা মানুষ, একটা গাছ, আকাশের মেঘ প্রত্যেক বস্তুর সাথেই আপনার সমানভাবে নিবিষ্ট হওয়া উচিত। ঠিক ততটাই যতটা আপনি নিজের শরীর, নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতি নিবিষ্ট। কোনও ভেদাভেদ ছাড়াই আপনি যদি জীবনের প্রত্যেকটি বস্তুর প্রতি একভাবে সমর্পিত হন তাহলে আপনি সর্বদাই আধ্যাত্মিক থাকবেন। আপনাকে আধ্যাত্মিকতা শেখানোর কোনো প্রয়োজন পড়বে না।