বহুকাল ধরেই কৈলাশকে এক পবিত্র পর্বত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। সদগুরু এখানে ব্যাখ্যা করছেন, এটি আসলে অসংখ্য অলৌকিক রহস্যেরই এক সংগ্রহশালা এবং তিনি আমাদের অন্তর্দৃষ্টি দান করছেন এই পবিত্র ক্ষেত্রের মর্মার্থ বোঝার জন্য ও এর তীর্থযাত্রীদের দুর্লভ অভিজ্ঞতা জানার জন্য।

প্রশ্নকর্তা:২০১২ সালে আমি কৈলাশে যাই, তখন আপনিই আমাদের দলের সবাইকে হিমালয়-ভক্তির দীক্ষা দিয়েছিলেন। আজ পর্যন্ত সেটাই হল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আপনি কি দয়া করে ওই ব্যাপারটাই একটু বিশদে ব্যাখ্যা করবেন?

সদগুরু:সাধারণত দীক্ষাদান কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই করা হয়। আপনাকে যদি শূন্যের বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য দীক্ষা দেওয়া হয়, তার উদ্দেশ্য হল, আপনার যাতে ধ্যানের অভ্যাস হয়, প্রচুর প্রাণশক্তি জন্মায় এবং আপনি তখন মানসিক চিন্তাভাবনা থেকে নিজেকে আলাদা করতে সচেতন হন। সেরকমই প্রতিটি দীক্ষার পিছনেই আলাদা আলাদা একেকটি উদ্দেশ্য থাকে। আবার এরই উল্টো দিকে, যখন আমরা সাধারণভাবে কৈলাশে যাই, আমরা কোনও বিশেষ জ্ঞানলাভের জন্য যাই না, অথচ আপনাদের সামনে কী বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে ওখানে - আর সেটাই হল সবচেয়ে জরুরি বিষয়। সেজন্যই অমন কোনও দীক্ষাদানের অর্থ হল, আপনাদের জন্য একটা দরজা খুলে দেওয়া আর লক্ষ্য করা যে, আপনারা তা থেকে কতটুকু গ্রহণ করতে পারলেন, কেননা ওই গোটা পর্বতটাই যে এক বিপুল বিস্ময়ের ক্ষেত্র। আপনাদের একেকজন সেই দীক্ষাকে একেকভাবে অনুভব করেন। এখন আপনারা যদি চান আর প্রস্তুত থাকেন, তবে বিস্ময়কর বহু কিছুই আপনাদের সামনে খুলে যেতে পারে।

প্রশ্নকর্তা: সদগুরু, কৈলাশকে আপনি ব্যাখ্যা করেছেন অলৌকিক রহস্যের এক সংগ্রহশালা হিসেবে। ঠিক কোনখানে ওইসব তথ্য জমা রয়েছে। নির্দিষ্ট কোনও উপাদানের মধ্যে, যেমন হতে পারে আকাশ—কিংবা ওগুলো কি গোটা পর্বত জুড়েই ছড়িয়ে আছে?

সদগুরু: জ্ঞান সঞ্চয়ের দিক থেকে আকাশ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যদি প্রকৃতির পাঁচটি উপাদানের মধ্যে শুধু আকাশেই সেই তথ্য সঞ্চয় করা হয়, তা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। সেজন্যই প্রকৃতির পাঁচ-পাঁচটি উপাদান সমেত ওখানকার গোটা বস্তুগত কাঠামোটাকেই কাজে লাগানো হয়েছে সেই তথ্য সঞ্চয়ের জন্য। তার চেয়েও বড় কথা, ইন্দ্রিয়ের অজ্ঞাত একটি দিক এবং প্রকৃতির পাঁচ উপাদানের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্কহীন এক প্রাণশক্তিকেও ব্যবহার করা হয়েছে সেই চিরস্থায়ী সঞ্চয়ের উপায় হিসাবে—কৈলাশ হল আসলে তেমনটাই। আর এজন্যই ওখানকার উপাদানগুলো থেকে এক বিশেষরকম প্রতিধ্বনি ওঠে। কেননা ওই উপাদানগুলোর সব কটাই যে ইন্দ্রিয়ের ওই অজ্ঞাত দিকটির কারণেই চরম অবস্থায় রয়েছে।

আধুনিক পৃথিবীতে তথা আধুনিক বিজ্ঞানে জ্ঞান বলতে যা বোঝানো হয়, তা আসলে একগাদা সিদ্ধান্ত—যা উঠে এসেছে প্রকৃতির একটি নির্দিষ্ট দিক বা বিষয়কে পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এরই বিপরীতে কৈলাশের জ্ঞান কোনও সিদ্ধান্তের বোঝা নয়—বরং এটি এক শক্তিশালী উদ্দীপক। আপনি সেটি স্পর্শ করলেই আপনার মধ্যে এবং আপনার চারপাশে নানা দিক খুলে যেতে পারে। এ কোনও সিদ্ধান্তমুখী জ্ঞান নয়, বরং এক উদ্দীপনাময় শক্তি। যাকে ছুঁলেই আপনার নিজের মধ্যে এক আগুন জ্বলে উঠবে এবং তার উপলব্ধি আপনারই উপরে নির্ভরশীল।

প্রশ্নকর্তা:আপনি বলেছিলেন, সাধারণ মানুষ যা জানে না, শুধু কিছু ভাগ্যবান যোগীর কাছেই সেই অজ্ঞাত দিকটির সন্ধান থাকে এবং তাঁদের সেই বিরল জ্ঞান তাঁরা সঞ্চয় করে রাখেন হিমালয়ের বুকে। এজন্যই কি প্রতিবছর আপনি কৈলাশে যান?

সদগুরু: কৈলাশে কিন্তু কেউ নিজের স্বাক্ষর রেথে আসতে যান না। অন্তত প্রাণ থাকতেও আমি তা করতাম না। কারও কৈলাশে যাওয়ার কারণ হল, তা এত বিশাল যে, সেখানে একটা গোটা জীবনই কাটিয়ে দেওয়া যায়। এবার নিয়ে মোট দশবার হল আমার কৈলাশযাত্রা, যদিও আমার যাওয়া মানে ঠিক তীর্থযাত্রীদের মতন যাওয়া নয়। আমার ব্যাপারটা হল, আমি যেখানেই থাকি না কেন, চোখ বন্ধ করলেই দারুণ কাটাই—আমার কোথাও যাওয়ার দরকার পড়ে না। ফলে অস্থিরতার জন্য আমাকে যেতে হয় না ওখানে। শিবকে খোঁজার জন্য যেতে হয় না। এমনকী নিজেকে খুঁজতেও যেতে হয় না। শুধু কৈলাশের বিশুদ্ধ এক বিশালতাই আমাকে ওখানে টানে। কতবার আর কতভাবে আপনারা তাকে দেখছেন, তাতে কিছু এসে যায় না, কেননা তখনও তাকে দেখার আরও অনন্ত দিক পড়ে থাকে। ওখানে না-যাওয়ার পক্ষে তাই একটা কারণই হতে পারে—তা হল পা আর ফুসফুস।

কৈলাশের বিশুদ্ধ এক বিশালতাই আমাকে ওখানে টানে। কতবার আর কতভাবে আপনারা তাকে দেখছেন, তাতে কিছু এসে যায় না। কেননা তখনও তাকে দেখার আরও অনন্ত দিক পড়ে থাকে।

অবশ্যই যোগীদের পদচিহ্ন পড়ে আছে বহু জায়গায়—যেমন কিনা দক্ষিণ ভারতের ভেল্লিয়ানগিরি পাহাড়ে, কৈলাশে এবং হিমালয়ের আরও অনেক জায়গাতেই। যদিও ইতিমধ্যে এক সুদীর্ঘ সময় ও এক সীমাহীন ঘটনার স্রোত বয়ে গেছে, তবুও ওইসব পদচিহ্ন এখনও সুস্পষ্টই রয়েছে। এই পদচিহ্ন হল সেইসব মহাত্মার, যাঁরা তাঁদের শরীর বা মনের কোনও কীর্তি রেখে যাননি, বরং রেখে গেছেন তাঁদের গভীরতম প্রাণকেন্দ্রেরই এক কর্মস্বাক্ষর, যা অবশ্যই চিরস্থায়ী। এসব পদচিহ্ন তাই সংরক্ষিতই থাকবে, কিন্তু যা জরুরি তা হল সেগুলোর পরিবেশকেও একইভাবে সংরক্ষণ করা, যাতে অন্যান্য দর্শনার্থীরাও তা সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারেন। চারপাশের মানুষজনের এটিই এখন এক মহাদায়িত্ব। ধরুন, ধ্যানলিঙ্গের পাশেই আপনি এক জমজমাট বাজার খুলে বসলেন, সে ক্ষেত্রে ধ্যানলিঙ্গ তো তখনও একইভাবে অনুরণিত হবে, কিন্তু মানুষ তা অনুভব করতে পারবে না। এজন্যই কৈলাশ কিংবা অমনই অন্যান্য সব ক্ষেত্রেরও যথাযথ পরিবেশটুকুকে আজ প্রাণপণে রক্ষা করা উচিত।