আষাঢ়ের পূর্ণিমাকে বলা হয় গুরু পূর্ণিমা। গুরু পূর্ণিমা উদযাপন করার কারণ সদগুরু ব্যাখ্যা করছেন এবং, সর্বপ্রথম গুরু, আদি-যোগীর গল্পটি শোনাচ্ছেন।  

সদগুরু: প্রথম গুরুর জন্মের দিন হল গুরু পূর্ণিমা। যোগের সংস্কৃতিতে, শিবকে ভগবান মানা হয় না, তাকে আদি-যোগী বলে গণ্য করা হয়। সর্বপ্রথম যোগী। যেই দিন তিনি নিজেকে এক গুরু হিসেবে রূপান্তরিত করলেন, আদি-যোগীতে রূপান্তরিত করলেন, সেই পূর্ণিমার দিনটিকে গুরু পূর্ণিমা হিসেবে উদযাপন করা হয়।  

১৫০০০ বছর আগে, বছরের ঠিক এমন সময়ে, তিনি নজর ফেরালেন তার সাত শিষ্যের ওপর – যাদের আমরা আজ সপ্ত-ঋষি বলে জানি। চুরাশি বছর ধরে তারা নিজেদের তৈরি করছিলেন। তারপর যখন পৃথিবীর গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণমুখি হল, যেটাকে আমরা উত্তরায়ন-দক্ষিণায়ন বলি, সেই দিন আদি-যোগী সপ্তঋষিদের দিকে চেয়ে দেখলেন যে তারা উজ্জ্বল দীপ্তিশীল আধার হয়ে উঠেছে। তখন তিনি তাদের আর উপেক্ষা করতে পারলেন না। মন দিয়ে তাদের নিরীক্ষণ করলেন, এবং তার পরের পূর্ণিমাতে তাদের গুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। দক্ষিণমুখি হয়ে, যোগ-বিজ্ঞানের শিক্ষাপ্রদান শুরু করলেন।

প্রথম গুরুর জন্মের দিন হল গুরু পূর্ণিমা

The 112 ft statue of Adiyogi at the Isha Yoga Center | Why Do We Celebrate Guru Purnima? Sadhguru Answers | Guru Purnima: The Day the First Guru Was Born

 

যোগ-বিজ্ঞান মানে শরীর দোমড়ানো-মোচড়ানো নয়। বা আপনার নিঃশ্বাস ধরে রাখা নয়। এটা মানবতন্ত্রকে বোঝার বিজ্ঞান, যেটা আপনাকে এই যন্ত্রটিকে অনাবৃত করতে শেখাবে, আবার গড়ে তুলতেও শেখাবে। সমস্ত অস্তিত্ব ও সৃষ্টিকে বোঝার এবং উপলব্ধি করার এক নতুন মাত্রা আদি-যোগী শেখালেন মানুষদের। সৃষ্টির এক টুকরোকে সৃষ্টির কাছে ফিরে যাওয়ার, সৃষ্টির সাথে এক করে দেওয়ার এক পাকা রাস্তা তৈরি করে দিলেন। তিনি বললেন, “তুমি যদি এই রাস্তায় চলতে থাকো তাহলে শেষপর্যন্ত গিয়ে তোমার আর সৃষ্টিকর্তার মধ্যে কোনও তফাৎ থাকবে না।“ সফরটা এটাই – সৃষ্টি থেকে সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত।

যেই দিন তিনি নিজেকে এক গুরু হিসেবে রূপান্তরিত করলেন, আদি-যোগীতে রূপান্তরিত করলেন, সেই পূর্ণিমার দিনটিকে গুরু পূর্ণিমা হিসেবে উদযাপন করা হয়।

আদি-যোগী ধর্ম, দর্শন বা মতবাদের কোনও কথা বলেননি। উনি ব্যাখ্যা করলেন এক বিজ্ঞানের, এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যা কিনা সেই পরিধিগুলোকে মুছে ফেলতে পারে যেগুলো প্রকৃতি আপনার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।  

আমরা নিজেরা যে পরিধিগুলো তৈরি করি সেগুলোর মূল উদ্দেশ্য হল আত্মরক্ষা। ঠিক যেই উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ির চারদিকে দেওাল বানাই। কিন্তু যেই মাত্র আপনি এই উদ্দেশ্যের কথাটি ভুলে যান, ওই দেওয়ালগুলোই পরিণত হয় আত্ম-নির্বাসনের দেওয়ালে। এবং এই দেওয়ালগুলো সরলরেখার মতন সহজ নয়, এগুলোর রূপ অত্যন্ত জটিল।

আমি কেবলমাত্র আপনার মনের তৈরি গণ্ডীর কথা বলছি না, আমি বলছি সেই পরিধিগুলোর কথা যেগুলো প্রকৃতি নির্ধারিত করে দিয়েছে আপনার কল্যান ও আত্মরক্ষার জন্য। কিন্তু মানবপ্রকৃতি এমনই যে আপনি প্রকৃতরূপে ভালো থাকতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপনি সেই পরিধিগুলোকে অতিক্রম করছেন। এটা মানুষের এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। যখন সে বিপদে পড়ে তখন তার চারিদিকে সে চায় এক বলয়। কিন্তু যেই না বিপদ কেটে যায় তখনই সে চায় সেই বলয়টি অদৃশ্য হয়ে যাক।  

এরম একটা উন্নত ও অসামান্য ব্যাপার মানব ইতিহাসে প্রথমবার ঘটেছে, এটার উদযাপন করতেই গুরু পূর্ণিমা পালন করা হয়।

কিন্তু এই বলয়টি যখন আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী অদৃশ্য হয়ে যায়না, তখন আপনার নিজেকে বন্দী ও শ্বাসরুদ্ধ মনে হয়। কারণ একবার আপনার বুদ্ধি সূক্ষ্ম হয়ে গেলে যেকোনো সীমাবদ্ধতা আপনার কাছে অসহ্য লাগে। তখন মানুষের কাছে যন্ত্রণার চেয়ে বন্ধন বেশী অসহ্য হয়ে ওঠে। আর একবার কোনও মানুষ যদি নিজেকে বন্দী বলে বোধ করে তখন আর তার পীড়ার শেষ থাকে না।

গুরু পূর্নিমা আদিযোগীর পদ্ধতিগুলো আপন করার উৎসব

The 112 ft statue of Adiyogi at the Isha Yoga Center | Why Do We Celebrate Guru Purnima? Sadhguru Answers | Guru Purnima Celebrates Adiyogi’s Methods

 

আদি-যোগীর কাজ এটাই ছিল যে সচেতনতার সেই পদ্ধতিগুলো মানুষের কাছে নিয়ে আসবে যেগুলো দিয়ে তারা তাদের পরিধিগুলোকে অতিক্রম করতে পারবে। প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে রক্ষা করার জন্য চারপাশে বলয় সৃষ্টি করতে পারবে, এবং প্রয়োজন ফুরোলে সহজেই সেটাকে পরিত্যাগ করতে পারবে। 

এই দিনে, মানব ইতিহাসে প্রথমবার, মানুষকে এটা মনে করিয়ে দেওয়া হল যে তার জীবন পূর্ব-নির্দিষ্ট নয়।

কিভাবে তৈরি করতে হয় এই ঐন্দ্রজালিক দুর্গ যেটা কিনা আপনাকে বিপদজনক শক্তির থেকে রক্ষা করবে, কিন্তু যেটাকে আপনি দেখতে পান না? এটাই ছিল আদিযোগীর কাজ। প্রকৃতির মায়াবী রূপকে ব্যবহার করে তিনি এরম বহু পদ্ধতি নিয়ে এলেন সেই ঐন্দ্রজালিক দুর্গ তৈরি করার, যার ভিতরে-বাইরে আপনি সহজেই যেতে পারবেন কিন্তু কোন শত্রুই যেটা ভেদ করতে পারবেনা। এরম একটা উন্নত ও অসামান্য ব্যাপার মানব ইতিহাসে প্রথমবার ঘটেছে, এটার উদযাপন করতেই গুরু পূর্ণিমা পালন করা হয়।

এই দিনে, মানব ইতিহাসে প্রথমবার, মানুষকে এটা মনে করিয়ে দেওয়া হল যে তার জীবন পূর্ব-নির্দিষ্ট নয়। যদি আপনি ইচ্ছুক হন পূর্ণ উদ্যমে প্রচেষ্টা করতে, সৃষ্টির প্রত্যেকটি দরজা উন্মুক্ত আপনার কাছে।  

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে গুরু পূর্নিমা উদযাপন করা হয়

The 112 ft statue of Adiyogi at the Isha Yoga Center | Why Do We Celebrate Guru Purnima? Sadhguru Answers | Guru Purnima Is Celebrated Irrespective of Caste or Creed

 

অতএব এই দিনটি মানবজাতির জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। এভাবেই মেনে আসা হয়েছে এই দেশে, কিছু সময় আগে পর্যন্তও। গুরু পূর্ণিমা এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর মধ্যে একটি ছিল। ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে এটি উদযাপন করা হতো। টাকা বা ঐশ্বর্য ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হতো না। সর্বোচ্চ মান ছিল জ্ঞান। আর সেই কারণেই গুরুর স্থান ছিল সর্বোপরি। কিন্তু তারপর কোন কারণে আমরা অজ্ঞানতার পূজারী হয়ে উঠলাম, এবং গত পঁয়ষট্টি বছরে গুরু পূর্ণিমার গুরুত্ব হারিয়ে গেল, কারণ এই দেশের সরকার এই দিনে ছুটি ঘোষণা করা বন্ধ করে দিল।

গুরু পূর্ণিমা এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর মধ্যে একটি ছিল। ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে এটি উদযাপন করা হতো।

ব্রিটিশ অধিগ্রহনের আগে পূর্ণিমাতে আর অমাবস্যাতে দুই-তিন দিন করে ছুটি থাকত। মানে মাসে পাঁচ দিন থাকত কেবল আপনার মঙ্গল সাধনের জন্য, যখন আপনি মন্দিরে গিয়ে নিজের মঙ্গলের জন্য যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারতেন। ব্রিটিশ এসে রবিবার ছুটি ঘোষণা করে দিল। কী লাভ হল তাতে? আপনারা তো হাবিজাবি খেয়ে আর টিভি দেখেই দিনটি অপচয় করেন!

তো, এই কারণেই গুরু পূর্ণিমার উদযাপন বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় গোটা দেশেই। কিছু আশ্রমে এখনও হয়তো বিক্ষিপ্তভাবে এটা পালন করা হয়, কিন্তু বেশীরভাগ মানুষই অবগত নন এই দিনটির গুরুত্ব সম্বন্ধে – যে ধর্মের যাবতীয় ধারনা মানুষের মাথায় আসার অনেক আগেই আদি-যোগী এটা স্থাপন করে গেছেন যে একটা মানুষের পক্ষে তার বর্তমান অস্তিত্বকে অতিক্রম করা সম্ভব, এবং এটাকে সাধন করার যাবতীয় রাস্তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। মানুষের মনে আসা সকল ভাবনার সর্বশ্রেষ্ঠ এটাই – বিবর্তনের মাধ্যমে তার বর্তমান অস্তিত্বের পরিধিকে অতিক্রম করে অনুভব এবং অস্তিত্বের এক সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় পৌঁছনো সম্ভব।