আমেরিকাবাসি ভারতীয় লেখক, গণ-বক্তা এবং চিকিৎসক দীপক চোপড়ার 18-ই অক্টোবর 2015 সদ্গুরুর সঙ্গে এক কথোপকথন হয়েছিল "আধুনিক যুগে প্রাচীন জ্ঞান" বিষয়ের উপর। এই হল সেই কথাবার্তার উদ্ধৃতাংশ।

সঞ্চালক: এখানে উপস্থিত থাকতে পারাটা সত্যিই একটা বিশেষ সুযোগ, আর আকর্ষণীয় ব্যাপার এই যে অসাধারণ দুজন মানুষ এই বিষয়টায় উপনীত হয়েছেন একদম পৃথক দুটো দৃষ্টিকোণ থেকে। ডক্টর চোপড়া এখানে উপনীত হয়েছেন একজন চিকিৎসক, একজন বিজ্ঞানী এবং একজন অতীব বাক্যবাগিশ অন্বেষী হিসেবে। সদ্গুরু এখানে উপনীত হয়েছেন একজন অতিন্দ্রীবাদী হিসেবে, যিনি এক প্রকার অজ্ঞেয়কে দেখেছেন এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছেন এক বিশাল জ্ঞানরাশি নিয়ে।

সময়ের সঙ্গে আপনাদের নিজেদের চিন্তাধারার কি অনেক পরিবর্তন হয়েছে? আপনারা উভয়েই কি এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন?

দীপক চোপড়া: এই অনেক গুলো বছর পরে, সদগুরু, আপনার সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ আমার জন্য মহান সম্মানের। আমার মনে পড়ে আপনার সঙ্গে পোর্তো রিকোয় ফ্রিসবি খেলা। আমার চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে যখন আমি সামাজিক মূল-স্রোত থেকে বেরোতে শুরু করি, তথাকথিত বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা থেকে, এবং আমার মনের মধ্যে শরীর ও মনের সংযোগ স্থাপন করবার চেষ্টা করি। আর গত চার দশক ধরে, আমি এটা উপলব্ধি করেছি, যা বহু শতাব্দী ধরে মহান ঋষিদের কাছে স্পষ্ট প্রতীয়মান ছিল, যে এমন কোনো চিন্তা প্রণালী নেই যা কিনা আপনাকে সত্য অথবা প্রকৃত বাস্তবের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রণালী হোক, বা কোনও গণিতিক চিন্তা প্রণালী বা কোয়ান্‌টাম ফিজিক্স – এই সব কোন কিছুই আমাদের প্রকৃত বাস্তবের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান প্রদান করতে পারে না, কারণ প্রকৃত বাস্তব চিন্তা ভাবনার ঊর্ধ্বে।

আমরা মনে করি বিজ্ঞান আমাদের সত্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে, কিন্তু বিজ্ঞান এমন এক প্রক্রিয়া যা মনেরও নয়, আর পদার্থরও নয়।

এই অনেক গুলো বছর পরে, সদগুরু, আপনার সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ আমার জন্য মহান সম্মানের। আমার মনে পড়ে আপনার সঙ্গে পোর্তো রিকোয় ফ্রিসবি খেলা। আমার চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে যখন আমি সামাজিক মূল-স্রোত থেকে বেরোতে শুরু করি, তথাকথিত বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা থেকে, এবং আমার মনের মধ্যে শরীর ও মনের সংযোগ স্থাপন করবার চেষ্টা করি। আর গত চার দশক ধরে, আমি এটা উপলব্ধি করেছি, যা বহু শতাব্দী ধরে মহান ঋষিদের কাছে স্পষ্ট প্রতীয়মান ছিল, যে এমন কোনো চিন্তা প্রণালী নেই যা কিনা আপনাকে সত্য অথবা প্রকৃত বাস্তবের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রণালী হোক, বা কোনও গণিতিক চিন্তা প্রণালী বা কোয়ান্‌টাম ফিজিক্স – এই সব কোন কিছুই আমাদের প্রকৃত বাস্তবের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান প্রদান করতে পারে না, কারণ প্রকৃত বাস্তব চিন্তা ভাবনার ঊর্ধ্বে।

একজন আধুনিক মানুষের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু যেহেতু আমরা প্রাচীন জ্ঞান নিয়ে কথা বলছি, আপনি যদি যোগ-বশিষ্ঠ পড়েন, সেখানে বলা হয়েছে ব্রহ্মণ হলেন সেটা যা নিজে দৃশ্যমান নন কিন্তু যাকে ছাড়া কোন দর্শনই সম্ভব নয়, যা নিজে অপ্রত্যক্ষ কিন্তু যাকে ছাড়া কিছুই প্রত্যক্ষ নয়, যা ধারণাতীত কিন্তু যাকে ছাড়া কোনো ধারণা, সৃজনশীলতা, অন্তর্দৃষ্টি, স্বজ্ঞা, পছন্দ কোনোকিছুই সম্ভব নয়। যা সবকিছু আমরা ‘বাস্তব’ বলি সে সবই আসে এক অকল্পনীয়, মাত্রাহীন, অ-স্থানীয় ক্ষেত্র থেকে যা স্থান-কালের অতিরিক্ত। যেমন, ভগবান কৃষ্ণ যখন এর কথা বলেন - "জল যাকে সিক্ত করে না; বায়ু যাকে শুষ্ক করে না; অস্ত্র যাকে খন্ডিত করে না; অগ্নি যাকে দগ্ধ করে না; এটা আদি, অজাত, মৃত্যুর অতীত"। এটা মনের কাছে ধারণাতীত, কিন্তু এটা তখনই অভিজ্ঞেয় যখন আপনি সচেতনতায় স্থিত হন, যখন আপনি সত্তায় স্থিত হন, যখন আপনি অস্তিত্বে স্থিত হন, যাকে বলা হয় সচ্চিদানন্দ বা আমিই হলাম সেই তত্‌-ভম্‌-সি। এটা বুদ্ধির দ্বারা অনুভব করা সম্ভব নয়, এটা অতীন্দ্রিয় অনুভব।

সঞ্চালক: সদগুরু, আপনি তো প্রত্যক্ষ ভাবে এর নাগাল পেয়েছেন। আমাদের বলুন আপনার চিন্তাধারা কিভাবে বদলেছে।

সদগুরু: আমি চিন্তার ব্যাপারে বেশি কিছু বলতে পারব না কারণ বেশিরভাগ সময় আমার সেরকম কোন চিন্তাই থাকে না। আমার ক্ষেত্রে, আমার মধ্যে সর্বদা ঘটে চলা এই অনন্যসাধারন জীবন প্রবাহ অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। আমার মনের চিন্তার উদয় শুধু তখনই হয় যখন আমি শারীরিক ভাবে কিছু করতে চাই অথবা আমার চতুর্পাশে কিছু সংগঠিত করতে চাই - অন্যথায় দিনের পর দিন কেটে যাবে আমার মনে একটিও চিন্তার উদয় ছাড়াই। লোকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, "আপনি কিরকম সাধনা করেছেন"? আমার একটাই সাধনা ছিল। একদম ছোটবেলা থেকেই আমি কখনো নিজেকে কোন কিছুর সঙ্গে চিহ্নিত করিনি - না আমার পরিবারের সঙ্গে, না কোন সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ বা আমার চার পাশের অন্য কোনও কিছুর সঙ্গে। সে আমার মা-বাবাই হোক বা ভাই-বোনেরা - আমি তাদের সাথে জড়িত ছিলাম কিন্তু কখনো কারোর সঙ্গে বা কোনও কিছুর সঙ্গে নিজেকে চিহ্নিত করিনি।

চিন্তা কেবলমাত্র পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা সঞ্চিত তথ্য দিয়েই সম্ভব, যে তথ্য খুবই সীমিত। আর একটা বিষয় হল, ইন্দ্রিয়গুলো যে ধরণের তথ্য সংগ্রহ করে তা কেবল টিকে থাকার জন্যই উপযোগী।

আপনার বুদ্ধি যদি আপনার পরিচয়ের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে না পড়ে, জীবনের প্রকৃতি উপলব্ধি করতে প্রতিটি মানুষই সামর্থবান। আমি যখন বুদ্ধিমত্তার কথা বলি, যেমন দীপক চিহ্নিত করেছেন, সেটা আমাদের চিন্তা প্রণালীর অতিরিক্ত। দুর্ভাগ্যবশত, আজকের দিনে আমাদের যে ধরনের শিক্ষাগত ব্যবস্থা বর্তমান তার কারণে আমরা আমাদের বুদ্ধিমত্তার শুধুমাত্র একটি মাত্রার সঙ্গেই প্রতিশ্রুত, যেটাকে আমরা মেধা বলি, যা শুধুমাত্রই চিন্তা প্রণালী। চিন্তা শুধুমাত্র ঘটতে পারে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সংগ্রহ করা তথ্য থেকে, যা খুবই সীমিত। আপনি গোটা পৃথিবীর সকল গ্রন্থাগারের তথ্য সংগ্রহ করলেও, সেটা ব্রহ্মাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্তই সীমিত। আরেকটা জিনিস হল, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো যে তথ্য সংগ্রহ করে তার প্রকৃতি শুধুমাত্র আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই দরকারি। আমরা সবকিছু কিভাবে দেখি, কিভাবে শুনি, কিভাবে ঘ্রাণ নিই, কিভাবে স্বাদ নিই, আর স্পর্শ করি, এগুলো কেবল বেঁচে থাকার জন্যই প্রাসঙ্গিক। আমরা যদি জীবনকেই জানতে চাই তাহলে বোধের এই যন্ত্রগুলো কোনও কাজের নয়।

প্রকৃতি আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ দিয়েছে কেননা আমাদের জীবন রক্ষার জন্য এটা দরকারি। একইভাবে প্রত্যেকটি জীবের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য খুলে দিয়েছে প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয়। যদি জীবন রক্ষাটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তাহলে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই যথেষ্ট। কিন্তু আপনি যখন মানুষ হিসেবেই এসেছেন তাহলে কেবল জীবন রক্ষাটাই যথেষ্ট নয়। যদি আপনার পেট খালি থাকে তাহলে সমস্যা একটাই - খাদ্য। কিন্তু একবার পেট ভর্তি হয়ে গেলে, তখন সমস্যা হয়ে যায় একশটা। মানুষের প্রকৃতি এমনই, যে আপনি যাই করুন না কেন, আপনি সবসময়ই আপনার বর্তমান অবস্থার থেকে বেশী কিছু হতে চাইছেন। যেটা হতে চাইছেন সেটা যদি ঘটে যায়, তাহলে আবার তার চেয়ে বেশী কিছু একটা চাইবেন - এটা এক অন্তহীন অভীষ্ট। কোথাও, মানুষ সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি চায়, কিন্তু সে এটা করতে চেষ্টা করছে শারীরিক উপায়ে।

প্রকৃতি আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ দিয়েছে কেননা আমাদের জীবন রক্ষার জন্য এটা দরকারি। একইভাবে প্রত্যেকটি জীবের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য খুলে দিয়েছে প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয়। যদি জীবন রক্ষাটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তাহলে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই যথেষ্ট। কিন্তু আপনি যখন মানুষ হিসেবেই এসেছেন তাহলে কেবল জীবন রক্ষাটাই যথেষ্ট নয়। যদি আপনার পেট খালি থাকে তাহলে সমস্যা একটাই - খাদ্য। কিন্তু একবার পেট ভর্তি হয়ে গেলে, তখন সমস্যা হয়ে যায় একশটা। মানুষের প্রকৃতি এমনই, যে আপনি যাই করুন না কেন, আপনি সবসময়ই আপনার বর্তমান অবস্থার থেকে বেশী কিছু হতে চাইছেন। যেটা হতে চাইছেন সেটা যদি ঘটে যায়, তাহলে আবার তার চেয়ে বেশী কিছু একটা চাইবেন - এটা এক অন্তহীন অভীষ্ট। কোথাও, মানুষ সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি চায়, কিন্তু সে এটা করতে চেষ্টা করছে শারীরিক উপায়ে।

চিন্তা হল আপনার সংগ্রহ করা তথ্যেরই পূণরাবর্তন। এটা যদি আপনি এখনি বুঝে যান, তাহলে আপনার জীবন এমনভাবে রূপান্তরিত হবে যেটা আপনি কখনও কল্পনাও করতে পারেননি। আর তা না হলে, কোনো একদিন, আপনি এটা বুঝবেন শূককীটদের থেকে। তখন আপনি দেখবেন আপনি কনকিছুর সঙ্গেই পরিচিত নন!