সদগুরু: বহু মানুষ এরকম একটি ধারণাকে আঁকড়ে থাকেন যে, দুনিয়ায় সবার জন্যই একজন করে “সঠিক” সঙ্গী রয়েছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, এটি স্থির করে নক্ষত্রেরা। এমন ব্যাপক কল্পনাও রয়েছে যে স্বয়ং স্রষ্টাই আমাদের “আত্মার দোসর” নির্বাচন করেন। এই দুটি মতামতের পিছনে পরোক্ষ ধারণাটি এই যে, মানুষের প্রেমের উৎপত্তি হয় স্বর্গে, মাটির এই পৃথিবীতে নয়। কিন্তু মানুষ যে কথাটি ভুলে যায় তা হল, আত্মা কোনও কিছু বা কারও সঙ্গেই মিলিত হতে পারে না। এমনকী আত্মার কোনও সঙ্গীও লাগে না। আসলে আমরা যখনই আত্মার কথা বলি, আমরা সেই অসীম ও অনন্তের কথাই বলি। শুধু যা কিছু সীমাবব্ধ, তারই সঙ্গী প্রয়োজন। তা হলে স্বয়ং অনন্ত কেন সঙ্গী খুঁজবেন?

বাস্তববাদী হওয়ার সুবিধা এই যে, কাল যখন আপনাকে কোনও সীমাবদ্ধতার সামনে পড়তে হবে, তখন সেগুলিকে সামলানোর যঠেষ্ট পরিণত উপায় খুঁজে বার করবেন।

মানুষ কেন একজন সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়? এটা হতে পারে শারীরিক কারণে, যাকে আমরা যৌনতা বলি, আর তা একটা সুন্দর ব্যাপার বইকী। এটা হতে পারে মানসিক কারণে, যাকে আমরা সাহচর্য বলি, তাও একটা সুন্দর ব্যাপার বটে। এটা আবেগের কারণেও হতে পারে, যাকে আমরা প্রেম বলি, আর যা কিনা কোনও মধুরতম অভিজ্ঞতা হিসেবে একেবারে রূপকথার মতোই সমাদৃত। অবশ্যই শারীরিক সঙ্গলাভ, মানসিক সাহচর্য ও প্রেম মানুষের জীবনকে অপূর্ব করে তোলে। কিন্তু নিজের সামনে যদি সততার সঙ্গে দাঁড়ান, দেখবেন এরকম একটি ব্যবস্থার পিছনেও ধাওয়া করে দুশ্চিন্তা। 

যে সব সীমাবদ্ধতা আর শর্তের মধ্য দিয়ে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেই ব্যাপারে সৎ থাকাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। বাস্তববাদী হওয়ার সুবিধা এই যে, কাল যখন আপনাকে কোনও সীমাবদ্ধতার সামনে পড়তে হবে, তখন সেগুলিকে সামলানোর যথেষ্ট পরিণত উপায় খুঁজে বার করবেন। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই সীমাবদ্ধতা তৈরি করেন। তাঁরা “আত্মার দোসর” জাতীয় তকমাটি ব্যবহার করেন অথবা কখনও জাহির করেন যে, তাঁদের সম্পর্ক নাকি “সৃষ্টি হয়েছে স্বর্গে”। এত বেশি আত্ম-প্রবঞ্চনার কারণেই তখন মোহভঙ্গ ঘটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।

স্বর্গে কোনও বিবাহই নির্দিষ্ট হয় না

তবে কি বিয়ের কোনও খারাপ দিক আছে? মোটেই নয়। বিয়ে ব্যাপারটা খুবই সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা হতে পারে, যতক্ষণ না তাকেই চরম প্রাপ্তি বলে ভাবা হয়। প্রেম নিয়ে যদি আপনার মাত্রাতিরিক্ত মোহ থাকে, তবে সবচেয়ে সুন্দর ব্যক্তিটির সঙ্গে আপনার বিয়ে হলেও তা নির্ঘাৎ ভেঙে যাবে, কেননা চিরকাল নিজেকে আপনি ঠকাতে পারেন না। যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে এবং আনন্দকে সঙ্গী করে জীবন কাটাতে চান, তবে এটুকু মনে রাখা খুবই জরুরি, বিয়ে হল মানুষেরই ঠিক করা একটা ব্যাপার, স্বর্গীয় কিছু নয়।

আপনি কী করছেন না করছেন, শুধু সেটাই প্রেম নয়। কীভাবে আপনি নিজেকে তৈরি করেছেন, প্রেম তার সঙ্গে সম্পর্কিত।

এটা সত্যি যে, নির্দিষ্ট কিছু কর্মের সূত্রেই একজন মানুষ আরেকজন মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হন। যদিও তার মানে এই নয় যে, শুধু সেই কারণেই সেটা কোনও আদর্শ সম্পর্ক হতে পারে। এ ধরনের সম্পর্কের সাফল্য নির্ভর করে, কতখানি পরিণত ও অনুভূতিশীল মন নিয়ে এগোচ্ছেন, তার উপরেই।

প্রেমের ব্যাপারে আমি কোনও নিন্দা করছি না—বরং উল্টোটাই। মানুষের যত কিছু সুন্দর গুণ আছে, প্রেম তার মধ্যে অন্যতম। বহু সভ্যতাতেই প্রেমকে দাবিয়ে রাখা হত, অন্যরা আবার একে স্বর্গে চালান দেওয়ারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রেম হল এই গ্রহেরই ব্যাপার এবং তা সম্পূর্ণ মানবিক। কেন তা অস্বীকার করব?

প্রেমের কোনও উদ্দেশ্য লাগে না। প্রেম হল নিছকই একটি গুণ। যাঁকে আপনি ভালবাসেন, সেই মানুষটি যদি আপনার শারীরিক সান্নিধ্যে নাও থাকেন, তবুও তাঁকে আপনি ভালবাসতে পারেন। এমনকী যাঁদের ভালবাসেন, তাঁরা যদি আর নাও থাকেন, তবুও তো তাঁদের ভালবেসে যান। এর মানে হল, নিজের ওই সহজাত গুণটিকে প্রকাশের উপায় খুঁজতেই চারপাশের মানুষজনকে আপনি উদ্দীপক হিসেবে কাজে লাগান। যদি এই বৈষম্যমূলক বুদ্ধির পরিবর্তে সচেতনতাকে নিয়ে আসতে পারেন, তখন প্রেমই হবে আপনার একমাত্র পথ। আপনি কী করছেন না করছেন, শুধু সেটাই প্রেম নয়। কীভাবে আপনি নিজেকে তৈরি করেছেন, প্রেম তার সঙ্গে সম্পর্কিত।

সহজ কথায়, ভালবাসা হল, নিজের প্রতি জীবনের এক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। এই আকাঙ্ক্ষার সারকথা হল, সব কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার মতো অসীম হয়ে ওঠা। আর ভালবাসা যখন সর্বব্যাপী হয়, শুধু তখনই আপনি সেই অসীম, অনন্তকে স্পর্শ করতে পারেন। আর তখনই আপনি এক সহজ সত্যকে অনুভব করতে পারেন যে, আত্মার কোনও সঙ্গী লাগে না। কোনও কালেই লাগেনি।

সম্পাদকের মন্তব্য: “Compulsiveness to Consciousness” নামের এই ই-বুকের মাধ্যমে সদগুরু আপনাদের হাতে চিরস্থায়ী ও আনন্দময় সম্পর্ক গঠনের চাবিকাঠিটিকে তুলে দিতে চান— সে সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গেই হোক বা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে, কর্মস্থলের সহকর্মীদের সঙ্গে হোক কিংবা এক বিপুল অস্তিত্বের সঙ্গে।

Download Compulsiveness to Consciousness